অভিমত

পেনশনের টাকা পেতে কেন শিক্ষকদের এত ভোগান্তি?

শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতি উন্নতির শিখরে যেতে পারে না। তবে এই জাতি গড়ার কারিগরই তাঁর ন্যায্য অধিকার কতটুকু পান? আজকে আলোচনা করব অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের কল্যাণ ট্রাস্ট এবং পেনশনের টাকা পেতে ভোগান্তি নিয়ে।

আমার বাবা শিক্ষকতা করতেন একটি এমপিওভুক্ত আলিয়া মাদ্রাসায়। গত ৭ মে ৩৫ বছরের শিক্ষকতা জীবনের ইতি টেনেছেন। আমার বাবার এই পঁয়ত্রিশ বছরের শিক্ষকতা জীবনে কত-শত শিক্ষার্থীদের আলোর পথ দেখিয়েছেন। কত শিক্ষার্থী তাঁর দেওয়া প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে আজ জীবনে অনেক বড় পর্যায়ে গিয়ে দেশসেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। এ রকম হাজার-হাজার শিক্ষক উন্নত জাতি গড়ার জন্য অমূল্য ভূমিকা রাখছেন।

তবে এই শিক্ষকরাই জীবনের চরম পর্যায়ে এসে অর্থকষ্টে করেন মানবেতর জীবন-যাপন। আমরা জানি, এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরা সরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের চেয়ে বেতন বলুন ভাতা বলুন সকল সুযোগ-সুবিধা অনেকাংশে কম পেয়ে থাকেন। যেমন আমার আব্বুর মাসিক যা বেতন পেতেন তা দিয়ে আমাদের ভাই-বোনদের পড়ালেখার খরচ আর পারিবারিক ভরণ-পোষণ সম্ভব হয়ে উঠত না। তারপরেও মোটামুটিভাবেই আমাদের দিন চলে যেতো। কিন্তু বর্তমানে আব্বু অবসরে আছেন। পরিবারেও মোটামুটি ভালো অর্থসংকট বিরাজমান। আসলে এটা যে শুধু আমাদের পরিবারের অবস্থা তা কিন্তু নয়, আমি মনে করি এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রায় অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের একই অবস্থা।

এমন অনেক শিক্ষক আছেন যারা টাকার অভাবে নিজের চিকিৎসা পর্যন্ত করাতে পারছেন না। এই আহাজারি আপনি যদি কল্যাণ ট্রাস্টের অফিসে যান তাহলে অবশ্যই দেখবেন।

এবার আসি মূল আলোচনায়। প্রতিবছর প্রায় ২৫ হাজার শিক্ষক অবসরে যাচ্ছেন। তার মানে প্রতি বছরে পেনশনের টাকা পেতেও আবেদন জমা হয় প্রায় ২৫ হাজারের কাছাকাছি। কিন্তু তাঁদের কল্যাণ ট্রাস্টের অর্থ আর পেনশনের অর্থ পেতে সময় লাগছে প্রায় ৫ বছর। হাঁ, ঠিক বলছি প্রায় ৫ বছর। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে এই পাঁচ বছর এই শিক্ষকেরা কীভাবে জীবনযাপন করছেন। কেন এসব শিক্ষকেরা ৩০ বছরের অধিক সময় জাতি গঠনে সেবা দিয়ে জীবনের শেষ সময়ে অফিসে থেকে অফিসে দৌড়াদৌড়ি করবেন নিজের কষ্টের সঞ্চয় হাতে পাওয়ার জন্য?

একজন শিক্ষক যখন অবসরে যান তখন তাঁর পেনশনের টাকা দুই ভাগে পেয়ে থাকেন। প্রথমে কল্যাণ ট্রাস্টের অর্থ, তারপরে পান পেনশনের অর্থ। জানিয়ে দেওয়া ভালো এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও কর্মচারীদের পেনশন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ১৯৯০ সালে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্ট এবং ২০০২ সালে অবসর সুবিধা বোর্ড প্রতিষ্ঠিত হয়। একটা ছোট্ট ঘটনা তুলে ধরি।

আব্বু পেনশনের টাকা পেতে আবেদন করবেন, তাই অভিজ্ঞতার জন্য আরেকজন শিক্ষকের নিকট পেনশন বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চান। সেই শিক্ষক বলেন, আপনি যদি কোনো রকম উপঢৌকন দেওয়া ছাড়া টাকা পেতে চান, তাহলে কল্যাণ ট্রাস্টের অর্থ পেতে কমপক্ষে দুই বছর আর মূল পেনশনের টাকা পেতে আরও তিন বছরের মতো সময় লাগবে। উপঢৌকনের পরিমাণটা বলছি না তবে মোট অর্থের ১০ শতাংশ হবে। এই হচ্ছে আমাদের কল্যাণ ট্রাস্ট এবং অবসর সুবিধা বোর্ডের অবস্থা।

এখন সবকিছু শুনে আমার আব্বু উপঢৌকন ছাড়া টাকা পাওয়ার আশায় আছেন। কিন্তু সেই টাকা পেতে যদি ৫ বছর আমাদের অপেক্ষা করতে হয় তবে বলতে পারি আমার দেশে শিক্ষকদের সম্মান হয়তো দিনমজুরের চেয়েও কম। বাবা অবশ্য এই সমস্যা নিয়ে লিখতে না করেছেন। কিন্তু কী করব কোনো এক প্রতিবাদী শক্তি ভেতর থেকে নাড়া দিচ্ছে।

একটি সমীকরণে দেখা যাচ্ছে, বছরে প্রায় ২৫ হাজার শিক্ষক তাঁদের পেনশনের অর্থের জন্য আবেদন করেন এবং তাদের পেনশনের টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু বছরে শিক্ষকদের দেওয়া ১০ শতাংশ চাঁদা এবং তার মুনাফা থেকে আয় হয় ১৪১০ কোটি টাকা। যেখানে বছরে ঘাটতি প্রায় ৭০০ কোটি টাকা। তাই অনেকে মনে করছেন, অর্থ সংকটের জন্য এ রকম সমস্যা হচ্ছে। কিন্তু এই ঘাটতি পূরণে আহামরি কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। এতে করে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের শেষ জীবনে নেমে আসছে চরম ভোগান্তি।

তবে আশার বাণী ইতিমধ্যে আমাদের প্রধানমন্ত্রী নানান পদক্ষেপ নিয়েছেন। যা অবশ্যই প্রশংসনীয়। আমার এই লেখার মাধ্যমেও আমাদের প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাচ্ছি। এ সরকার দেশের উন্নয়নের জন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব শিক্ষার উপরই দিচ্ছে। তাহলে এই শিক্ষায় যারা অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন তাঁরা কেন এত ভোগান্তিতে পড়বেন, তাও তাঁদের কষ্টে অর্জিত অর্থ পেতে। পরিশেষে আমরা দুর্নীতিমুক্ত এমন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্ট এবং অবসর সুবিধা বোর্ড চাই যেখানে শিক্ষকেরা কোনো রকম হয়রানি ছাড়া নিজের পেনশনের টাকা উত্তোলন করতে পারবেন।

মো. রাকিব
সরকারি সিটি কলেজ, চট্টগ্রাম