প্রতিক্রিয়া

ডিজিটাল লেনদেনে সাঁওতাল-ওঁরাও জনগোষ্ঠী পিছিয়ে কেন

টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ফলে তৃণমূল পর্যায় থেকেও নারী-পুরুষনির্বিশেষে সবারই জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখার সুযোগ তৈরি হয়। বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তিতে সব জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণকে গতিশীল করতে ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের (ডিএফএস) গুরুত্ব অপরিসীম।

ডিএফএস হলো কোনো কাগজপত্র ছাড়াই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ব্যাংকিং কার্যক্রম, যার মধ্যে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) অন্যতম। ইতিমধ্যেই এমএফএস বাংলাদেশে খুবই জনপ্রিয়তা পেয়েছে। দেশে বিকাশ, নগদ, রকেট, এমক্যাশ, উপায়সহ বর্তমানে ১৩টি প্রতিষ্ঠান মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে আর্থিক সেবা দিচ্ছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশ পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) সহযোগিতায় সমতলে বসবাসকারী এথনিক জনগোষ্ঠীর সঙ্গে এমএফএসের সম্পৃক্ততার ওপর একটি গবেষণা পরিচালিত হয়। সেখানে গবেষণার মিশ্র পদ্ধতি অনুসরণ করে উত্তরবঙ্গের রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাঁওতাল ও ওঁরাও জনগোষ্ঠীর এমএফএস গ্রহণের হার, এই সার্ভিস গ্রহণে অসুবিধা ও ঝুঁকিগুলো অনুসন্ধান করার চেষ্টা করা হয়েছে।

বাংলাদেশ সরকার-স্বীকৃত ৫০ ধরনের এথনিক জনগোষ্ঠী রয়েছে (বিবিএস, ২০২২), যার মধ্যে সমতল এলাকায় সাঁওতাল, ওঁরাওসহ ২০টি জনগোষ্ঠীর উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু গবেষক দল উত্তরাঞ্চলের মাঠপর্যায়ে এর বাইরেও আরও কিছু এথনিক জনগোষ্ঠীর সন্ধান পেয়েছে, যারা সরকারি নথিতে এখনো স্থান পায়নি।

সমতলের এই এথনিক জনগোষ্ঠীর মানুষেরা বেশির ভাগ এলাকায় গুচ্ছভিত্তিক বসবাস করেন। তাঁদের জীবনধারণের পদ্ধতি সম্প্রদায়গত ঐতিহ্য দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত। বেশির ভাগ মানুষ দরিদ্র, যাঁদের অনেকের কাছেই শিক্ষার আলো পৌঁছায়নি। গবেষণালব্ধ ফলাফল থেকে জানা যায়, ৯৫ শতাংশ মানুষ এখনো কৃষিশ্রমিক হয়ে কোনোমতে খেয়েপরে বেঁচে আছেন। ভাষা, ধর্ম বা সংস্কৃতির পার্থক্য এবং নিজেদের পেশা পরিবর্তনের মানসিকতার অভাব তাদের মূল স্রোতোধারার জনগোষ্ঠী থেকে পিছিয়ে রেখেছে।

গবেষকেরা এই জনগোষ্ঠীর পিছিয়ে থাকার পেছনে কিছু কারণ চিহ্নিত করেছেন। একদিকে তাঁদের সঞ্চয়ের মনোবৃত্তির অভাব, অন্যদিকে এই মনোবৃত্তি গড়ে না ওঠার পেছনে রয়েছে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কারণ। এসব এথনিক জনগোষ্ঠীর মানুষেরা উপার্জিত অর্থের বেশ কিছু অংশ ব্যয় করেন নিজেদের ঐতিহ্যগত উৎসবে। চুয়ানি বা ঘরে তৈরি মদ সেবনও তাদের ঐতিহ্য ও জীবনাচারণের অংশ।

তবে কেউ কেউ সেটির প্রতি অতিরিক্ত আসক্ত হয়ে পড়েন, এর ফলে অর্থনৈতিক সংকটে পড়েন। এতে তাঁদের সঞ্চয়ের খাতা থাকে শূন্য। তাই এমএফএসে নিজেদের সম্পৃক্ত করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। গবেষক দলকে শিক্ষিত যুব সম্প্রদায়ের অনেকে অভিযোগ করেন, এই আসক্তির ফলে সন্তানের জন্য আসা উপবৃত্তির টাকাতেও ভাগ বসাতে চান তাঁরা। সে টাকা না পেলে পরিবারের নারীকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করতেও দ্বিধা করেন না।

৭৪৯ জন উত্তরদাতার তথ্যের ভিত্তিতে মাঠপর্যায়ের গবেষণা ফলাফল থেকে জানা যায়, প্রায় ৮৪ শতাংশ মানুষ এজেন্ট বা কারও সহায়তায় এমএফএস অ্যাকাউন্ট খুলেছেন। বিপরীতে অর্থ লেনদেন করেন মাত্র ৪২ শতাংশ। অ্যাকাউন্টধারীদের মধ্যে ৭৫ শতাংশ পুরুষ আর মাত্র ২৫ শতাংশ নারী সক্রিয় ব্যবহারকারী।

জানা যায়, সরকার পরিচালিত সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর ভাতা পেতে এবং সন্তানের উপবৃত্তির টাকা পেতে তাঁদের অনেকেরই এই অ্যাকাউন্ট খুলেছেন। তাই কম শিক্ষিত বা অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন মানুষেরা যখন কেবল সরকারি ভাতা ও এ-সংক্রান্ত অর্থ আসে, তখনই তাঁরা ডিজিটাল লেনদেন করে থাকেন।

সুতরাং অ্যাকাউন্ট থাকা মানেই যে নিয়মিত মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস নিচ্ছেন, তা বলা যাবে না। দেখা গেছে, উত্তরদাতাদের মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশ জনগোষ্ঠী কেবল বিভিন্ন ধরনের ভাতা, সন্তানের উপবৃত্তি, শহরে কাজ করতে যাওয়া স্বামী বা সন্তানের প্রেরিত অর্থ উত্তোলনে ডিজিটাল সেবা গ্রহণ সীমিত রেখেছেন।

গবেষণা এলাকায় পেশাগতভাবে পুরুষের পাশাপাশি নারীর অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য হলেও গবেষণা এলাকায় নারী-পুরুষের মধ্যে ডিজিটাল ডিভাইড মোটাদাগে চোখে পড়েছে। মুঠোফোনের মালিকানা না থাকা ও প্রযুক্তিগত জ্ঞানের অভাব পুরুষের তুলনায় নারীদের এমএফএস থেকে পিছিয়ে রাখছে বেশ কয়েক ধাপ।

তবে এর মধ্যেও যে নারীরা ডিজিটালি লেনদেন করছেন, তাঁদের লেনদেনের গোপন পিন নম্বরটিও তাঁরা পরিবারের অন্য সদস্য, নয়তো প্রতিবেশী বা এজেন্টের সঙ্গে শেয়ার করেন। নিয়মিত এমএফএস ব্যবহার না করার কারণ হিসেবে তাঁরা সিম কার্ড হারিয়ে যাওয়া বা মুঠোফোন নষ্ট হওয়াকে চিহ্নিত করেছেন।

অন্যদিকে এমএফএস পরিষেবা ফি বেশি হওয়া এবং দুর্বল মোবাইল নেটওয়ার্ক এ সেবা গ্রহণে অন্তরায় বলে জানা গেছে। এ জন্য নিয়মিত ডিজিটাল আর্থিক পরিষেবা গ্রহণ করতে এখনো এই জনগোষ্ঠীর অনেকেই দ্বিধাগ্রস্ত।

এর বাইরেও গবেষক দল আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ খুঁজে পেয়েছে, যা এই জনগোষ্ঠীকে এমএফএস থেকে বিচ্ছিন্ন রেখেছে, বিশেষত নারীদের। স্বল্প আয়ের এই নারীদের অনেকে মনে করেন, এমএফএস অ্যাকাউন্টে টাকা জমা রাখার সুযোগ থাকলেও তা থেকে তাঁরা কোনো মুনাফা পান না। কিন্তু সপ্তাহান্তে তাঁরা যদি ৫০ টাকাও স্থানীয় কোনো এনজিওতে রাখেন, তা থেকে তাঁদের মুনাফা আসবে এবং বিপদে-আপদে এসব এনজিও বা সমিতি থেকে তাঁরা ঋণ নিতে পারেন।

২০১০ সালে দেশে চালু হওয়া এমএফএস আজ প্রায় এক যুগ পেরিয়েছে। ক্যাশবিহীন লেনদেনে অনেকেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করলেও সমতলের এথনিক ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তি এখনো অনেক কম।

দেশের সব অঞ্চলের মানুষ এখনো এই সার্ভিসের সুফল সমানভাবে ভোগ করতে পারছেন না।

টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের (এসডিজি) মূল লক্ষ্যই হচ্ছে ‘কাউকে বাদ দিয়ে নয়’। উত্তরবঙ্গের সাঁওতাল, ওঁরাওসহ সমতলের আরও অনেক প্রান্তিক জনগোষ্ঠী রয়েছে, তাদের বাদ দিয়ে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত হতে পারে না। তাই সাঁওতাল, ওঁরাও ও অন্যান্য জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে বিশেষ উদ্যোগ প্রয়োজন। পাশাপাশি মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) জনপ্রিয় করতে সংশ্লিষ্ট এলাকায় সচেতনতামূলক বিভিন্ন কার্যক্রম চালু করা জরুরি।

  • আশরাফী বিনতে আকরাম সহযোগী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, হাজী মোহাম্মাদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর asrafiakram.soc@gmail.com

  • সায়েমা জেরিন শিক্ষার্থী (এমএসএস), সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, হাজী মোহাম্মাদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর