যে কারণে সড়ক দুর্ঘটনার তথ্যব্যাংক প্রয়োজন

দেশে প্রতিদিনের সড়ক দুর্ঘটনায় বহু মানুষ আহত-নিহত হন। এসবের অল্প কিছু গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। অর্থাৎ অসংখ্য দুর্ঘটনা প্রতিদিন অপ্রকাশিত থাকে। শুধু ভুক্তভোগী পরিবার-পরিজন এবং স্থানীয় মানুষ ছাড়া অন্যরা জানতে পারেন না এসব দুর্ঘটনার তথ্য।

সারা দেশে ২২ হাজার ৪৭৬ কিলোমিটার আঞ্চলিক সড়ক ও জাতীয় মহাসড়ক এবং ২ লাখ ১৭ হাজার কিলোমিটার গ্রামীণ সড়ক রয়েছে। এসব সড়কে চলাচল করে ৫৬ লাখ নিবন্ধিত মোটরযান (বর্তমান সময় পর্যন্ত)।

এর বাইরে লাখ লাখ অটোরিকশা-অটোভ্যান, নছিমন-করিমন-ভটভটিসহ নানা রকমের অনিরাপদ যানবাহন ঝুঁকিপূর্ণভাবে চলাচল করে এই সড়ক-মহাসড়কে। এসব যানবাহনের চালকেরা যেমন অপ্রশিক্ষিত, যাত্রী ও পথচারীরাও তেমনি নিরাপদে চলাচল বিষয়ে অনভ্যস্ত ও অনভিজ্ঞ।

দেশের মোটরসাইকেলচালকদের একটি বড় অংশ কিশোর ও যুবক। এঁরা বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালিয়ে প্রতিনিয়ত নিজেরা দুর্ঘটনায় পতিত হচ্ছেন এবং অন্যদের আক্রান্ত করছেন।

আমাদের আঞ্চলিক ও গ্রামীণ সড়কগুলো অবকাঠামো এবং পরিবেশগতভাবে অনিরাপদ। সড়কের সঙ্গে মানুষের ঘরবাড়ি। ঘরের দরজা খুললেই সড়ক। এসব সড়কে শৃঙ্খলা বাস্তবায়নকারী বাহিনীর উপস্থিতি বা নিয়ন্ত্রণ না থাকায় অহরহ দুর্ঘটনা ঘটে।

কিন্তু  যেসব দুর্ঘটনায় তাৎক্ষণিক নিহতের ঘটনা ঘটে না বা অনেক মানুষ গুরুতর আহত হয় না—সেসব দুর্ঘটনায় মামলা হয় না এবং পুলিশের তালিকায় আসে না। ফলে পুলিশের তালিকায় দুর্ঘটনার সংখ্যা কম থাকে। এ বিষয়ে একটি উদাহরণ দিলেই বোঝা যাবে। ২০২১ সালে পুলিশের রিপোর্ট অনুযায়ী সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৫ হাজার ৪৭২টি। আহত ৪ হাজার ৭১৩ জন এবং নিহত হয়েছেন ৫ হাজার ৮৪ জন। এই প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, দুর্ঘটনার সংখ্যার চেয়ে আহত এবং নিহতের সংখ্যা কম।

যেটা অস্বাভাবিক। কারণ, পুলিশ যে ধরনের দুর্ঘটনা তালিকাভুক্ত করে, সেসব দুর্ঘটনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অনেক বেশি আহতের ঘটনা ঘটে। তাই পুলিশের সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিবেদনে দুর্ঘটনার সংখ্যার চেয়ে নিহত বা আহতের সংখ্যা কম হওয়ার কথা নয়। উল্লেখ্য, ওই একই বছরে গণমাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি করা রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনে দেখা যায়, সারা দেশে ৫ হাজার ৩৭১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৬ হাজার ২৮৪ জন নিহত  এবং ৭ হাজার ৪৬৮ জন আহত হয়েছে।

এখানে পুলিশের তথ্যের সঙ্গে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্যের বিরাট পার্থক্য দৃশ্যমান। অন্যান্য সংগঠনের তথ্যের সঙ্গে পার্থক্য আরও বেশি। তবে এ ক্ষেত্রে আমরা কোনো রিপোর্টকেই বস্তুনিষ্ঠ বলছি না।

সড়ক দুর্ঘটনায় হেড ইনজুরি বেশি হয়। আমাদের দেশে জেলা ও বিভাগীয় শহরে নিউরোসার্জারি বিভাগ খুবই দুর্বল এবং অপ্রতুল। তাই দুর্ঘটনার পরে হেড ইনজুরি রোগীকে মফস্বল শহর থেকে ঢাকায় পাঠানো করা হয়। ঢাকায় আসার পথে গোল্ডেন আওয়ার (দুর্ঘটনা পরবর্তী ছয় ঘণ্টা) পেরিয়ে অনেকে মারা যায়। হাসপাতালে চিকিৎসা–সংকটেও অনেকে মৃত্যুবরণ করে।

সব মিলিয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত রোগীদের একটি বড় অংশ চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এ রকম মৃত্যুর ঘটনা জেলা, বিভাগ এবং রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে অহরহ ঘটে থাকে। কিন্তু যেহেতু সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে সরকারের কাছ থেকে চিকিৎসাসহায়তা বা ক্ষতিপূরণ বাবদ আর্থিক সহায়তা পাওয়া যায় না, তাই ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার মামলা করে না।

তারা মামলাকে আইনি হয়রানি হিসেবে বিবেচনা করেন। এ কারণেই এসব মৃত্যুর ঘটনা পুলিশের তালিকাভুক্ত হয় না। গণমাধ্যমেও তেমন প্রকাশিত হয় না। এভাবেই সড়ক দুর্ঘটনার তথ্যের একটি বড় ঘাটতি তৈরি হয়।

এই পরিস্থিতিতে কয়েক বছর যাবৎ রোড সেফটি ফাউন্ডেশনসহ কয়েকটি সংগঠন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিবেদন তৈরি করছে। এসব প্রতিবেদন মূলত সেকেন্ডারি তথ্যভিত্তিক।

উল্লেখ্য, গণমাধ্যমে প্রকাশিত সড়ক দুর্ঘটনার সংবাদে অনেক তথ্যগত উপাদান থাকে না। যেমন দুর্ঘটনার মূল কারণ, কোন যানবাহন দায়ী, দুর্ঘটনার প্রকৃত ধরন, সড়কের অবস্থা, আক্রান্তের বয়স, পেশা ও ঠিকানা ইত্যাদির উল্লেখ থাকে না।

থাকার কথাও নয়। ফলে গণমাধ্যমের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী কারণগুলো যেমন পাওয়া যাচ্ছে না, তেমনি আহত-নিহতের প্রকৃত চিত্রও পাওয়া যাচ্ছে না। উল্লেখ্য, সড়ক দুর্ঘটনার তথ্যব্যাংক বলতে শুধু আহত-নিহতের সংখ্যা বোঝায় না। দুর্ঘটনার দায়ী কারণগুলো ও আহত–নিহতের প্রকৃত চিত্র বাধ্যতামূলকভাবে থাকতে হয়। এ কারণে শুধু গণমাধ্যমের ওপর নির্ভর করে সড়ক দুর্ঘটনার বস্তুনিষ্ঠ তথ্যব্যাংক বা প্রতিবেদন তৈরি করা সম্ভব নয়।

আবার সড়ক দুর্ঘটনা বিষয়ে বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনে একটির সঙ্গে অপরটির সংখ্যাগত বিস্তর পার্থক্য হচ্ছে। বেসরকারি সংস্থাগুলোর চেয়ে পুলিশের প্রতিবেদনে দুর্ঘটনা ও আহত-নিহতের সংখ্যা অনেক কম থাকছে। সড়ক দুর্ঘটনার এই সংখ্যাগত পার্থক্যের বিতর্ক অবসানে বিআরটিএ গত জানুয়ারি মাস থেকে সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিবেদন প্রকাশ শুরু করেছে। কিন্তু বিআরটিএর প্রতিবেদনের সঙ্গে পুলিশের প্রতিবেদন মিলছে না।

পুলিশ, বিআরটিএ এবং বেসরকারি সংস্থাগুলো যে পদ্ধতি ও প্রক্রিয়ায় সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য সংগ্রহ করে, তাতে সড়ক দুর্ঘটনার সঠিক চিত্র বা খুব কাছাকাছি চিত্র তুলে আনা সম্ভব নয়। আসলে প্রকৃত চিত্র অনেক বেশি ভয়াবহ। সড়ক নিরাপত্তাবিশেষজ্ঞদের মতে, সড়কে যাতায়াতের সময় ৩০০০ অনিরাপদ কাজ বা আচরণের ফলে ৩০০টি ‘দুর্ঘটনা ঘটতে যাওয়ার মতো ঘটনা’ ঘটে। এই ৩০০ ঘটনা ২৯টি আহত হওয়ার ঘটনা বা সম্পদ নষ্ট হওয়ার মতো ঘটনা ঘটায়।

অথচ দুটিই সরকারি প্রতিষ্ঠান। ফলে বড় ধরনের বিতর্ক তৈরি হচ্ছে। বিআরটিএ বেসরকারি সংস্থাগুলোর তথ্যকে অতিরঞ্জিত আখ্যায়িত করছে। কিন্তু নিজেদের কাছে বস্তুনিষ্ঠ তথ্য না থাকার কারণে চূড়ান্তভাবে চ্যালেঞ্জ করতে পারছে না। এই পর্যায়ে বিআরটিএ বেসরকারি সংস্থাগুলোকে প্রতিবেদন প্রকাশের পূর্বে দুর্ঘটনাগুলো সরেজমিন তদন্ত করার পরামর্শ দিচ্ছে। যেটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কারণ, যেহেতু বেসরকারি সংস্থাগুলোর সারা দেশে প্রশিক্ষিত লোকবল নেই, তাই তাদের পক্ষে এক মাসের দুর্ঘটনা সরেজমিনে তদন্ত করতে বছর তিনেক সময় লাগবে।

কথা হলো, পুলিশ, বিআরটিএ এবং বেসরকারি সংস্থাগুলো যে পদ্ধতি ও প্রক্রিয়ায় সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য সংগ্রহ করে, তাতে সড়ক দুর্ঘটনার সঠিক চিত্র বা খুব কাছাকাছি চিত্র তুলে আনা সম্ভব নয়। আসলে প্রকৃত চিত্র অনেক বেশি ভয়াবহ। সড়ক নিরাপত্তাবিশেষজ্ঞদের মতে, সড়কে যাতায়াতের সময় ৩০০০ অনিরাপদ কাজ বা আচরণের ফলে ৩০০টি ‘দুর্ঘটনা ঘটতে যাওয়ার মতো ঘটনা’ ঘটে। এই ৩০০ ঘটনা ২৯টি আহত হওয়ার ঘটনা বা সম্পদ নষ্ট হওয়ার মতো ঘটনা ঘটায়।

আবার এই ২৯টি ঘটনা ১টি মারাত্মক আহত হওয়া বা নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটাতে ভূমিকা রাখে। অর্থাৎ একটি নিহত হওয়ার ঘটনার পেছনে ৩০০০ অনিরাপদ আচরণ, ৩০০ ‘দুর্ঘটনা ঘটতে যাওয়ার মতো ঘটনা’ এবং ২৯টি আহত হওয়ার ঘটনা থাকে। তাই দুর্ঘটনা পরিমাপের এই বিশ্বমানের পদ্ধতি অনুযায়ী বলা যেতে পারে, দেশে সড়ক দুর্ঘটনা প্রকাশিত সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি ঘটে।

এই উদ্বেগজনক প্রেক্ষাপটে প্রশিক্ষিত জনবল ও আধুনিক যোগাযোগপ্রযুক্তির মাধ্যমে মাঠপর্যায় থেকে এবং হাসপাতাল থেকে সরাসরি তথ্য সংগ্রহ করে সড়ক দুর্ঘটনার তথ্যব্যাংক তৈরি করতে হবে। এ জন্য বড় ধরনের লজিস্টিক সাপোর্টের প্রয়োজন, যা বেসরকারি সংস্থার পক্ষে এখনই সম্ভব নয়। তবে সরকারের পক্ষে সম্ভব এবং করা উচিত।

সড়ক দুর্ঘটনার পেছনে বহু কারণ দায়ী এবং এই কারণগুলো একটির সঙ্গে অপরটি নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত। অর্থাৎ বহু কারণের সমষ্টিগত ফলাফল সড়ক দুর্ঘটনা। যেমন সড়কের ত্রুটি, যানবাহনের ত্রুটি, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ ও আবহাওয়াগত সমস্যা, চালকের অদক্ষতা, বেপরোয়া আচরণ, ক্লান্তিজনিত ঘুম, পথচারীর অসচেতনতা নানাবিধ কারণে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। এ ক্ষেত্রে কোনো দুর্ঘটনা কোন কারণে ঘটেছে, তার তথ্য নির্দিষ্টভাবে সংগ্রহ করা জরুরি।

তা না হলে দুর্ঘটনার কারণগুলোর সমাধান করা কঠিন। যদিও আমাদের দেশের সড়ক দুর্ঘটনার কারণগুলোর অধিকাংশই আমরা জানি এবং সব সময় দৃশ্যমান। কিন্তু গোষ্ঠী স্বার্থে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে এসব কারণের সমাধান করা হয় না। তবে এভাবে চলতে দেওয়া যায় না। পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনায় নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির বহু পরিবার একেবারে বিপন্ন হয়ে পড়ছে। তারা সামাজিক অর্থনীতির মূল স্রোত থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। দেশে আর্থসামাজিক সংকট তীব্র হচ্ছে।

এই বাস্তবতায় সরকারের উচিত সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যাগত পার্থক্য নিয়ে বিতর্কে না জড়িয়ে সমস্যাকে স্বীকার করে সরকারি উদ্যোগে বা সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে আধুনিক যোগাযোগপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সড়ক দুর্ঘটনার একটি বস্তুনিষ্ঠ তথ্যব্যাংক তৈরি করা। কারণ, সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে টেকসই ও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হলে সঠিক তথ্য থাকতে হবে। এটা রাষ্ট্রীয় নীতি-কৌশল ও নৈতিকতার বিষয় এবং সময়ের দাবি।

মনে রাখতে হবে, সমস্যাকে অস্বীকার করে সমাধান করা যায় না, বরং সমস্যাকে স্বীকার করে দায়ভার কাঁধে নিয়ে সমাধানের পথ বের করাই বুদ্ধিমানের কাজ।

  • সাইদুর রহমান নির্বাহী পরিচালক, রোড সেফটি ফাউন্ডেশন।