প্রসূতি মায়েদের অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার আর কত?

সৃষ্টিকর্তা নারী-পুরুষ উভয়কেই নিজ হাতে সৃষ্টি করলেও মাতৃত্বের মতো স্বর্গীয় অনুভূতি লাভের ক্ষমতা দিয়েছেন শুধু নারীকেই। একজন নারীর জীবনে সর্বোচ্চ খুশি, আবেগ, উৎকণ্ঠার সময় হলো মাতৃত্বকাল। কারণ, তার হাত ধরেই পৃথিবীতে আসে নতুন প্রজন্ম।

গর্ভবতী মা–সহ পরিবারের প্রত্যেক সদস্য যেমন আনন্দে থাকেন, তেমন বিভিন্ন দুশ্চিন্তাও এ সময় মাথায় ঘুরপাক খায়। প্রসূতি মায়ের স্বাভাবিক সন্তান জন্মদান নিয়ে এবং শেষ পর্যন্ত মা ও সন্তান দুজনেই সুস্থ থাকবে কি না?

পরিবারের সদস্যরা হয়তো সন্তান জন্মদানের সময়টুকু পর্যন্তই উৎকণ্ঠায় কাটান। পরবর্তী সময়গুলো নিয়ে ভাবেন না বললেই চলে। যার ফলে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারে কারও তেমন একটা ভ্রুক্ষেপ নেই। দেশে বিভিন্ন সমস্যার পাশাপাশি অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারও ক্রমেই বেড়ে চলেছে, যা বেশ শঙ্কাজনক।

সন্তান জন্মদানের সময় অস্ত্রোপচার একটি জীবন রক্ষাকারী পন্থা, কিন্তু যখন এই পন্থা অবলম্বন করা হচ্ছে অকারণে, সেটি রীতিমতো একপ্রকার অপরাধ। আগের যুগে সন্তান জন্মদানে ধাত্রীর প্রচলন ছিল, কিন্তু সে সময় মাতৃমৃত্যু এবং শিশুমৃত্যুর হারও বেশি ছিল। এ জন্য ক্রমে ক্রমে স্থানীয় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং হাসপাতালে সন্তান জন্মদানের হার বৃদ্ধি পেতে শুরু করল। বর্তমানে মাতৃমৃত্যু এবং শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস পেয়েছে, এটি নিঃসন্দেহে আনন্দজনক, কিন্তু একই সঙ্গে হার বাড়ছে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারের।

বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপে (২০২২) অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারের পরিসংখ্যানে পাওয়া গেছে, দেশে ১০০ সন্তান প্রসবে ৪৫ শিশুর জন্ম হচ্ছে অস্ত্রোপচারে। মোট সংখ্যার হিসাবে দেশে প্রতিবছর ১৬ লাখ শিশুর জন্ম হচ্ছে এভাবে। এর মধ্যে ১০ লাখের বেশি শিশুর জন্ম হচ্ছে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারে।

প্রসূতি মায়ের যদি অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিকস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃৎপিণ্ডের কোনো সমস্যা অথবা জরায়ুতে টিউমার থাকে এবং বাচ্চার অবস্থানের ত্রুটি থাকে, সে ক্ষেত্রে জীবন রক্ষাকারী পন্থা হিসেবে অস্ত্রোপচারকে বেছে নেওয়া যায়। কিন্তু কোনো কারণ ছাড়াই নির্ধারিত সময়ের আগে অস্ত্রোপচার কতটুকু যৌক্তিক?

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুযায়ী, প্রতি ১০০ গর্ভধারণে ১০ থেকে ১৫ জন মায়ের ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা দেখা যায়, সে ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার করা যেতে পারে। কিন্তু ১৫ শতাংশের বেশি অস্ত্রোপচার হলে তা অপ্রয়োজনীয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বর্তমানে দেশে ৩০ শতাংশ শিশুর জন্ম হচ্ছে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারে।

চিকিৎসাবিদদের মতে, যে কয়েকটি কারণে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার বাড়ছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, গর্ভবতী মায়েরা অথবা তাঁর পরিবার চায়, হেলথ চেকআপ এবং কিছু বেসরকারি হাসপাতালের মুনাফার প্রবণতা।

অনেক সময় দেখা যায়, অনাগত সন্তানের বিভিন্ন ত্রুটিপূর্ণ অবস্থান নিয়ে ভীতি থেকে তৎক্ষণাৎ অস্ত্রোপচার করতে বলা হয়। এতে পরিবারের লোকজন ভয় পান এবং সে মুহূর্তে তাঁদের ভয় পাওয়াই স্বাভাবিক। কারণ, এসব ঘটনার সত্যতা যাচাই–বাছাইয়ের ক্ষমতা সাধারণ মানুষের নেই।

আবার অনেক সময় দেখা যায়, পরিবারের লোকেরা আগে থেকেই চান অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার করাতে। কেউ হয়তো ভয়ে চান অথবা কেউ শারীরিক ঝুঁকি নিতে চান না, কেউ কেউ বলে থাকেন ফিটনেস ঠিক রাখতে।

তাঁদের মধ্যে অনেকের হয়তো অস্ত্রোপচার করার সময় বা করার পরেও তেমন কোনো সমস্যা দেখা দেয় না, যার ফলে এই পন্থাতেই তাঁরা বেশি আস্থা পান। কিন্তু সুপ্তভাবে বাচ্চারা কোনো দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত কিংবা বঞ্চিত হচ্ছে কি না, সেটা ভাবেন কজন?

এর যে কিছু ক্ষতিকর দিক রয়েছে, সেসব কেউ গুরুত্ব দিচ্ছেন না, ফলে এই হার কমার বদলে প্রতিনিয়ত বাড়ছে। অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারের ফলে সংক্রমণ ও মাত্রাতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হতে পারে এবং স্বাভাবিক প্রসবের তুলনায় এ ধরনের মায়েদের সুস্থ হতে সময় লাগে বেশি।

এ ছাড়া সন্তান বিভিন্ন দিক থেকে বঞ্চিত হয়, যেমন স্বাভাবিক প্রসবের সময় শিশু ভালো কিছু ব্যাকটেরিয়া লাভ করে, যা তার রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ায়। অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারে যেটি সম্ভব নয়। এ ছাড়া মা অসুস্থ থাকায় শিশুকে মায়ের থেকে কিছু সময় দূরে রাখা হয়, যার ফলে শিশু মায়ের দুধ পান করতে পারে না ঠিকমতো। অনেক সময় অস্ত্রোপচারে সামান্য ত্রুটি হলেও মা অথবা শিশুর মৃত্যু ঘটতে পারে। অস্ত্রোপচার করার আগে পরিবারের সব সদস্যের এ বিষয়গুলো জানা উচিত।

অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারের বড় অংশটি হচ্ছে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে। ৮৪ শতাংশ হচ্ছে বেসরকারি হাসপাতালে এবং ১৪ শতাংশ হচ্ছে সরকারি হাসপাতালে। সরকারি হাসপাতালে জনবল কম হওয়ায় সবাই ঝুঁকছে বেসরকারি হাসপাতালে। এই সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে কিছু বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক।

গবেষকেরা দেখেছেন, স্বাভাবিক প্রসবে গড়ে ৩ হাজার ৫৬৫ টাকা খরচ হয়। অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারের কারণে সেই খরচ বেড়ে যায় কয়েক গুণ।

অস্ত্রোপচার ব্যয়বহুল একটি চিকিৎসা, যেটি বহন করার সামর্থ্য সব পরিবারের নেই; কিন্তু অনেক সময় বাধ্য হয়ে তাঁদের করাতে হয়। সরকারের এবং চিকিৎসা খাতসংশ্লিষ্ট প্রশাসনের উচিত অতিসত্বর এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া এবং অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার রোধ করা। তার পাশাপাশি জনগণের সবার নিজ নিজ জায়গা থেকে জানা উচিত অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারের ভয়াবহতা এবং এটি কমাতে সাহায্য করা। প্রত্যেকে সচেতন হলে তবেই সম্ভব সুস্থ সমাজ, দেশ এবং জাতি গঠন করা।

রিয়া বসাক
শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
কুষ্টিয়া।