চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যে সংস্কার দেখতে চাই

জুলাই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ এক নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে। জেন-জিরা অর্থাৎ বর্তমান প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা, যার নাম দিয়েছে বাংলাদেশ ২.০।  শিক্ষার্থীরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে  আপসহীন যুদ্ধ করেছে। স্বৈরাচার পতন ঘটিয়েছে। তাদের প্রিয় ব্যক্তি ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বানিয়েছে। শিক্ষার্থীরা ক্ষমতার পালাবদল চায় না বরং সিস্টেমের পরিবর্তন চায়। মানুষের বাক্‌স্বাধীনতা ফিরিয়ে দিতে চায়। কালোকে কালো; লালকে লাল বলার সাহস মানুষকে দিতে চাই। যার জন্য ছাত্ররা নিজেদের জীবন দিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো দেশ স্বাধীন করেছে।

এটা আমাদের জন্য আনন্দ, উৎসবের যে কোটা সংস্কার ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসসহ চট্টগ্রামের অলিগলি নিজেদের দাবি নিয়ে বিক্ষোভ করেছে। সরকার–সমর্থিত বাহিনীর মুখোমুখি হয়ে জীবন দেওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রও শহীদ হন। তার পরও ছাত্ররা ক্ষান্ত হয়নি। রাতের বেলায় পুলিশ দিয়ে বিভিন্ন হয়রানি তাদের আটকাতে পারেনি। তারা বন্দুকের গুলির মুখোমুখি হয়েও সাহস নিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলেছে। নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়ে লেজুড়বৃত্তিক কিংবা তাঁবেদার বাহিনীর পদত্যাগ চেয়েছে। ছাত্রদের বিক্ষোভের মুখে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির ভিসি ও প্রক্টরিয়াল বডিকে পদত্যাগ করতে হয়েছে। নতুন করে যে বাংলাদেশ শিক্ষার্থীরা গড়েছে, সে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন বর্তমান শিক্ষার্থী হিসেবে আমারও কিছু পর্যবেক্ষণ ও মতামত রয়েছে। আমি মনে করি এই ভাবনাটা শুধু আমার একার নয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে যারা দলীয় লেজুড়বৃত্তিক থেকে বের করে একটি বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপ দিতে চায়, তাদের সবার।

একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা হচ্ছে তার প্রাণকেন্দ্র। শিক্ষার্থীদের দেখভাল করার দায়িত্ব থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের ওপর। উপাচার্যকে চার বছরের জন্য নিয়োগ দিয়ে থাকেন রাষ্ট্রপতি। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থে; ছাত্রদের পক্ষে কাজ করার জন্য। বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি গবেষণাবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের উচিত কাজ করা। কেননা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কাজই তো হচ্ছে জ্ঞান ও নতুন ধারণা সৃষ্টি করা। শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ বিষয়ে দক্ষ হিসেবে গড়ে তোলা। তার জন্য যথেষ্ট কর্মপন্থা গ্রহণ করার মূল দায়িত্ব তো থাকে উপাচার্যের হাতেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের মান ও মর্যাদা বৃদ্ধি করতে পারলে ওই উপাচার্যের সুনামও হয় আকাশচুম্বী।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এযাবৎকাল পর্যন্ত অনেক উপাচার্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম তোয়াক্কা না করে অবৈধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত হতে। উদাহরণ হিসেবে সাবেক উপাচার্য ড. শিরীণ আখতারের কথা বলা যায়। তিনি অবৈধ পন্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দিতেন। এ ছাড়া তাঁর বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক দুর্নীতি, ক্ষমতাসীন ক্যাডার দিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার ও প্রশাসনিক অদক্ষতার অভিযোগ তাঁর সময়ে উঠেছে। শিক্ষার্থীরা এর পুনরাবৃত্তি কাউকে দেখতে চায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষমতার সদ্ব্যবহার, অর্থনৈতিক দুর্নীতিমুক্ত, বৈধ নিয়োগ ও প্রশাসনিক দক্ষতা রয়েছে এমন কাউকে উপাচার্যের আসনে দেখতে চাই। যিনি যোগ্যতা ও নেতৃত্বগুণে উপাচার্য হিসেবে সুযোগ পাবেন, এটাই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাম্য। এ ছাড়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানীয়দের দ্বারা ছাত্রদের ওপর আক্রমণ উপাচার্যের অদক্ষতার ফলে ঘটেছে বলে ছাত্ররা মনে করে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচন সর্বশেষ অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯০ সালে। এর পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ চাকসু নির্বাচন দেওয়া মনে করেনি। এর পেছনে রাজনীতি, প্রশাসনিক ও আইনি জটিলতা আছে বলে শোনা যায়। দীর্ঘ ৩৪ বছর ধরে চাকসু নির্বাচন না হওয়ায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চর্চার ঘাটতি লক্ষ করা যায়। এর পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের কোনো নির্বাচিত প্রতিনিধি না থাকার কারণে শিক্ষার্থীদের দাবিদাওয়া ও সমস্যাগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের কাছে পৌঁছানো যায়নি। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতান্ত্রিক পরিবেশের অস্তিত্ব এত দিন ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা চাকসু নির্বাচনের মাধ্যমে ক্যাম্পাসে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে মাঝেমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরব হতে দেখা যায়।

শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেশ কয়েক বছর ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যায় যে তাদের পরীক্ষার ফলাফল দিতে চার থেকে পাঁচ মাসও লেগে যায়, যা শিক্ষার্থীদের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা সৃষ্টি করে ও পরবর্তী ইয়ারের জন্য পড়ালেখায় মনোযোগ ব্যাহত হয়। এর পেছনে প্রশাসনিক, পাঠ্যক্রমের জটিলতা রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রশাসনিক প্রক্রিয়াকরণে বিভিন্ন স্তরে অনুমোদনে সময়ের প্রয়োজন, যা সময়সাপেক্ষ। এ ছাড়া পরীক্ষার খাতা শিক্ষকেরা নির্ধারিত সময়ে দেখতে অপারগতাও দেখা যায়। ফলাফল নির্ধারিত সময়ে প্রদান করতে প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার গতিশীলতার বিকল্প নেই। যার জন্য পরীক্ষার ফলাফল ডিপার্টমেন্টভিত্তিক প্রকাশ না করে প্রশাসন একত্রে প্রকাশ করলে সবাই সমান সময়ে পরীক্ষার ফলাফল পাবে।

পৃথিবীর নানা প্রান্তের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যখন সেমিস্টার শিক্ষাব্যবস্থার দিকে ঝুঁকছে, তখন মনে হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ফ্যাকাল্টির কর্তৃপক্ষের শিক্ষাব্যবস্থা সেমিস্টার করা নিয়ে কোনো মাথাব্যথাই নেই। বার্ষিক পরীক্ষা হওয়ার কারণে শিক্ষার্থীরা সারা বছর পড়ালেখা না করে শেষ এক মাস পড়ালেখা করতে চায়। যার ফলে টানা পড়ালেখায় বিরতিতে যেমনি শিখন ফল গভীর হয় না, তেমনি পড়ায় মনোযোগ বসানো কষ্টকর হয়ে ওঠে। এ ছাড়া সেমিস্টারভিত্তিক নির্দিষ্টসংখ্যক ক্লাস ও নির্ধারিত সময়ে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হলে যা শিক্ষার্থীদের পরিকল্পনা সুসংগঠিত করতে সাহায্য করবে। এর পাশাপাশি সেমিস্টারভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা একাডেমিক বছরে দুই ভাগে বিভক্ত করে নির্ধারিত সময়ে বিষয়বস্তু শেখার ওপর জোর দিয়ে গভীরভাবে কোনো বিষয়ের ওপর জ্ঞান অর্জন করা যায়। সেমিস্টারভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থায় সাপ্তাহিক বা মাসিক মূল্যায়ন সম্ভব হয়, যার মাধ্যমে সহজে ফিডব্যাকও পাওয়া যায়। এই পদ্ধতিতে স্বল্পমেয়াদি লক্ষ্য নির্ধারণ করা যায় এবং দ্রুত সময়ে ফলাফলও পাওয়া যায়। সমাজবিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষার্থীদের অনেক দিন ধরে সেমিস্টারভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা করতে দাবি জানিয়ে আসছে। শিক্ষার গতি বৃদ্ধি করতে সেমিস্টারভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থার বিকল্প নেই।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষের শিক্ষাব্যবস্থা যুগোপযোগী নয় বলে শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করছে। গৎবাঁধা মুখস্থ বিদ্যার ফুলঝুরি এখনো দৃশ্যমান। শিক্ষকদের সঙ্গে ছাত্রদের ক্লাসের বাইরে সংযোগও নেই। এর জন্য শিক্ষকেরা ক্লাসে অতিরিক্ত শিক্ষার্থী হওয়াকে দায়ী করছেন। এ ছাড়া বিগত সরকারের আমলে রাজনৈতিক পেশিশক্তি ব্যবহার করে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের জন্য ক্লাস উপযোগী শিক্ষকের অপ্রতুলতা দেখা দিচ্ছে। যার প্রমাণ পাওয়া যায় ছাত্ররা অনেক শিক্ষকের পড়া ক্লাসে বুঝতে পারে না। যার জন্য অনেক শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত এসেও অন্যের কাছে মাসিক বেতনে পড়তে হয়।

এত দিন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের সিটগুলো ছাত্রলীগের হাতে জিম্মি ছিল যার ফলে অনেক শিক্ষার্থীদের ভোগান্তির শিকার হতে হয়েছে। সময় এসেছে যোগ্যতার ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের এলোটমেন্ট দেওয়ার। অবশ্যই এর জন্য অর্থনৈতিক অবস্থা, একাডেমিক পারফরম্যান্স ও যাদের বাড়ি দূরে, তাদের প্রায়োরিটি দিতে হবে। বঙ্গবন্ধু হল ও অতীশ দীপঙ্কর হল দ্রুত খুলে দিতে হবে। বিগত প্রশাসন রাজনৈতিক কারণে হলের কাজ সমাপ্ত শেষ হওয়ার পরও হল খুলে দিতে পারেনি, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিগত বিরোধ কাজ বলে মনে হয়। এ ছাড়া ক্যাম্পাসে শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে ক্লাস খুলে দেওয়ার বিকল্প নেই। টিচার, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিয়মের মধ্যে আনতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার পরিবেশ যেমন নিশ্চিত করতে হবে তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা থাকতে হবে।

চবির ক্যাম্পাস থেকে শহরের দূরত্ব প্রায় ২২ কিলোমিটার। এত দূরের হওয়ার কারণে শহরের সঙ্গে ক্যাম্পাসের তেমন সংযোগ নেই। যার জন্য শহরে টিএসসি কেন্দ্র তৈরি করলে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি সেতুবন্ধন তৈরি হবে। বর্তমানে চবিতে ভর্তি পরীক্ষার ফি ব্যাংকে দাঁড়িয়ে, বৃহৎ লাইন মাড়িয়ে এসে দিতে হয়। যার ফলে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করতে হয়। যা এখনো অ্যানালগ যুগের সংকেত বহন করে। দ্রুতই ডিজিটাল মাধ্যমে ভর্তি ফি জমা নেওয়ার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এযাবৎকাল পর্যন্ত সাবেক ক্ষমতাসীনদের লেজুড়বৃত্তিক করে কার্যক্রম চালাত। শিক্ষার্থীবান্ধব যেকোনো কাজ করতে তারা যেন ভাবতেই পারত না। সময় এসেছে পরিবর্তনের। শিক্ষার্থীবান্ধব ক্যাম্পাস গড়তে শিক্ষার্থীবান্ধব উপাচার্যের বিকল্প নেই। আশা করি চবি ইতিহাসের সেরা যোগ্য ও দায়িত্ববান ভিসি পেতে যাচ্ছে। যাঁর নেতৃত্ব গুণে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আলোকিত হবে।

মো. রাসেল হোসেন

শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়