যাযাবর বা বিনয় মুখোপাধ্যায় রচিত ‘দৃষ্টিপাত’ গ্রন্থের স্মরণীয় উক্তি, ‘বিজ্ঞান দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগ।’ সার্বিক দিক বিবেচনায় যাযাবরের কথাটাকে অযথার্থ বলার উপায় নেই। তবে এটাও ঠিক, বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ উক্তির সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করার অবকাশ আছে ঢের। কারণ, এ দেশে বিজ্ঞান কেবল বেগেরই জন্ম দেয় না, আবেগেরও জন্ম দেয়। আর আবেগের জন্মদাতা বিজ্ঞান আবেগকেই কেড়ে নেবে, এটা যৌক্তিক কথা হতে পারে না।
আমার বক্তব্যের সমর্থনে একাধিক উদাহরণ উপস্থাপন করা অনাবশ্যক মনে করি। হাঁড়ির চাল যথাযথ সেদ্ধ হয়েছে কি না, তা বোঝার জন্য যেমন এক-দুটি চাল টিপলেই চলে, তেমনি একদিনের ঘটনার আদ্যোপান্ত শুনলে বুদ্ধিমান পাঠকমাত্রই, প্রতিদিনকার চিত্রটি আঁচ করতে পারবেন।
তারিখ ও সময় ৩ নভেম্বর, দুপুর। মহাখালী থেকে বাসে চড়েছি, ময়মনসিংহের উদ্দেশে। টার্মিনাল থেকেই বাসের অবস্থা যেন ‘চলিতে চরণ চলে না’। বনানী পার হওয়ার পর, বাস থেকে ‘বিজ্ঞানের বেগ’ পুরোপুরি উধাও হয়ে গেল। ‘ইঞ্জিন বন্ধ’ করে দেওয়া বাসটিকে মনে হলো ‘সমাধিপ্রাপ্ত সাধক’, বিকারহীন, মৃতবৎ। বহুক্ষণ পর বাসের চেতনা ফিরে এল। শম্বুকগতিতে একটু এগোয় আবার থেমে যায়। টঙ্গী এসে অস্তগামী সূর্যের লাল আভা দেখতে পেলাম। সেই আভার স্নিগ্ধতা, কোমল রূপ চৈতন্যের সর্বাঙ্গে গভীর আবেগের শিহরণ জাগাল।
অনির্বচনীয় কবিত্বের দোলা অনুভব করলাম। ঘোরের ভেতরে ছাইপাশ কী যেন, হয়তো মহাকাব্য কিংবা নাটক রচনা করতে লাগলাম। সংলাপের অংশ হিসেবে সড়ক বিভাগের লোকজনকে যেই না ‘শ্বশুরপক্ষের আত্মীয়’ জ্ঞান করে দুটো শব্দ উচ্চারণ করলাম, অমনি বাসের চাকা সজোরে চলতে লাগল। প্রকৃতিস্থ হতে হতে ভাবলাম, বিজ্ঞান দিয়েছে যানজট, যানজট দিয়েছে নিশ্চলতা। নিশ্চলতা দিয়েছিল বাঁধভাঙা আবেগ। আর আবেগ থেকে জাত হয়েছিলÑকত কী সাহিত্যকর্ম। তাহলে এটা কী করে সত্য হিসেবে পরিগণিত হয় যে বিজ্ঞান কেবলই বেগের জন্ম দেয়, আবেগের নয়?
গত কয়েক দশকে, আমাদের দেশ বেশ কটি ক্ষেত্রে অভাবনীয় উন্নতি সাধন করেছে। আমাদের গড় আয় এবং আয়ু—দুটোই বেড়েছে। শিক্ষা-স্বাস্থ্য-কৃষি-শিল্পকলা—সর্বত্রই লেগেছে অগ্রগতির ছোঁয়া। সব ক্ষেত্রেই বিজ্ঞান এসেছে আশীর্বাদ হয়ে, কেবল একটা ক্ষেত্রে বিজ্ঞান চরম অভিশাপ হয়ে দেখা দিয়েছে। আমাদের সড়ক এবং রেল যোগাযোগ, আপাতদৃষ্টে মনে হতেই পারে, বিজ্ঞানের কল্যাণে এ প্রপঞ্চও সমৃদ্ধ হয়েছে। কিন্তু এখানে একটা ‘শুভংকরের ফাঁকি’ আছে; এ ফাঁকির স্বরূপ নির্ণয় করা সহজ, তবে এ থেকে মুক্তি পাওয়া বেশ কঠিন।
গত দশকের আগের দুই দশকের দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক। তখন সড়কপথে (বা রেল) দুই-আড়াই ঘণ্টার মধ্যেই ঢাকা-ময়মনসিংহ যাতায়াত করা যেত। অথচ বর্তমানে, চার লেনের সড়ক-সুবিধা এবং আধুনিক মডেলের দামি গাড়িতে চড়েও ওই দুই-আড়াই ঘণ্টার দূরত্ব, ঠিক কতক্ষণে অতিক্রম করা যাবে, এটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। তিন তো নয়ই, চার-পাঁচ-ছয় ঘণ্টা, নাকি এর চেয়েও বেশি সময় রাস্তায় কাটাতে হবে,কেউ জানে না। সড়কপথের অবশ্য বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। সড়ক হতে পারে ভাঙাচোরা, খানাখন্দে ভরা কিংবা যানজটে ‘স্বাভাবিক সত্তা’হীন। চাইলেই গাড়ির গতি বাড়ানোর উপায় নেই। কিন্তু রেলপথ, ওখানে তো এ-জাতীয় বাধাবিঘ্ন নেই। তাহলে রেল যাতায়াতে এত সমস্যা, বিপত্তি কেন? গন্তব্যে পৌঁছাতে কেন সেটা ঘড়ির কাঁটা মেনে চলে না? ছেড়ে দিতে হয় ভাগ্যের ওপরে?
অপ্রিয় হলেও এটাই সত্য যে আমাদের রেলব্যবস্থার প্রায় পুরোটাই ব্রিটিশ আমলে নির্মিত। সে সময়ে জনসংখ্যা ছিল অনেক কম, তাই সিঙ্গেল লাইনের রেলপথ দিয়ে কাজ চালাতে অসুবিধা হতো না। পরবর্তীকালে জনসংখ্যার বৃদ্ধির পাশাপাশি রেলযাত্রীর সংখ্যা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ পর্যায়ে সময়ের দাবি মেনে সারা দেশব্যাপী রেলের ডাবল লাইন নির্মাণ করা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সেটা তো দূরের কথাÑ‘সিঙ্গেল লাইন’ স্থাপনেও কার্যকর কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি।
যাত্রীচাহিদা পূরণের জন্যে পুরোনো লাইনের যথাযথ সংস্কার ছাড়াই দিন দিন কেবল রেলগাড়ির সংখ্যাই বাড়ানো হয়েছে, এতে নানাবিধ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। বিপরীত দিক থেকে আসা গাড়ি কিংবা পেছনের দিক থেকে আসা দ্রুতগামী গাড়িকে পথ করে দেওয়ার জন্য অসংখ্য গাড়িকে কোনো নির্দিষ্ট স্টেশনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। বস্তুত রেলের ডাবল লাইন থাকলে প্রতিদিন সময়ের এই বিপুল অপচয় রোধ করা যেত। কর্মপরিকল্পনার সঙ্গে মাঠপর্যায়ের বিদ্যমান অবস্থা—এ দুইয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য না থাকায় গোটা রেলব্যবস্থা মারাত্মক ঝুঁকির ভেতর দিয়ে দিন পার করছে। দুর্ঘটনা যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে ‘শিডিউল বিপর্যয়’। একটা গাড়ি লেট করলে, যান্ত্রিক গোলযোগে পড়লে এর প্রভাব পড়ে ওই লাইনে চলাচলকারী প্রতিটি গাড়ির ওপরে। রেলের বর্তমান দুরবস্থায় মানুষের মনে ফিরে আসছে সেই পুরোনো প্রশ্ন, ‘১০টার ট্রেন কয়টায় আসবে?’
প্রতিদিন বাড়তি সময় নিয়ে বেরিয়েও আশ্বস্ত থাকা যায় না। আমাদের দেশে অনেক বিষয় নিয়েই তো পরিসংখ্যানিক কাজ করা হয়। যানজটে পড়ে প্রতিদিন কেবল ঢাকা শহরেই কত কর্মঘণ্টা বিনষ্ট হচ্ছে, এ হিসাব বের করার কোনো উপায় নেই?
বিজ্ঞানের বেগ-আবেগ, গতি-দুর্গতির প্রভাব এখন শুধু দূরপাল্লার দ্রুতযানের ওপরই নয়, এটা এখন সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়েছে নগর পরিবহনের বিভিন্ন যান, মফস্বল শহরের রিকশা, অটোরিকশা, সিএনজিচালিত গাড়ি, ঠেলাগাড়ির শরীরেও। বাসা থেকে চার-পাঁচ কিলোমিটার দূরের অফিস ১৫-২০ বছর আগে রিকশা বা বাসে চড়ে যে দূরত্ব অতিক্রম করা যেত অনধিক ৩০ মিনিটের মধ্যে, এখন সেটা অতিক্রম করতে গিয়ে দ্বন্দ্ব ও সংশয়ে থাকতে হয়, না জানি কোথায় গিয়ে অনতিক্রম্য যানজটে পড়তে হয়? অফিসে ঠিক সময়ে পৌঁছাতে পারব তো? প্রতিদিন বাড়তি সময় নিয়ে বেরিয়েও আশ্বস্ত থাকা যায় না। আমাদের দেশে অনেক বিষয় নিয়েই তো পরিসংখ্যানিক কাজ করা হয়। যানজটে পড়ে প্রতিদিন কেবল ঢাকা শহরেই, কত কর্মঘণ্টা বিনষ্ট হচ্ছে, এ হিসাব বের করার কোনো উপায় নেই?
অপ্রশস্ত রাস্তায় অপরিমেয় যানবাহন চলাচল করলেÑযানজটের সৃষ্টি হবেই। কিন্তু এটাই কি শেষ কথা? এর আড়ালে, আর কোনো কথা নেই?আছে বৈকি; পথ চলাচলকারী যাত্রীমাত্রেরই বিশেষ প্রবণতা, ‘অন্যরা চুলোয় যাক, যেনতেন প্রকারে আমাকেই যেতে হবে আগে।’ ধরা যাক, বাঁ পাশের রাস্তা বরাবর পূর্বমুখী যানগুলো জটে আটকা পড়েছে। ডান পাশের রাস্তা প্রায় ফাঁকা,তাই পশ্চিমমুখী যানগুলো, স্বাভাবিক গতিতে চলাচল করতে পারছে। এ ক্ষেত্রে ‘আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবর্জিত’ বাঁয়ের গাড়িচালকেরা সুযোগ পাওয়ামাত্রই ডানের রাস্তায় ঢুকে গিয়ে পূর্ব দিকে চলতে শুরু করেন।
এর ফলে ডান পাশের পশ্চিমমুখী গাড়ি চলাচল বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং একসময় দুই দিকের গাড়ি চলাচলই বন্ধ হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে আইন অমান্যকারীরা যদি কঠিন শাস্তির মুখে পড়তেন, তাহলে এ প্রবণতা অবশ্যই হ্রাস পেত। কিন্তু এ দেশে কার অপরাধের জন্য কে কাকে শাস্তি দেবে? স্বাধীন দেশে সবাই স্বাধীন নাগরিক, চালক বা পথিক যেমন, তেমনি স্বাধীন ট্রাফিকের লোকজন এবং তাঁদের নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষও।
কথা হলো, দূরপাল্লার রাস্তাই হোক আর মফস্সলের সরু রাস্তাই হোক, প্রতিদিন জ্যামে আটকা পড়ে ‘দীর্ঘশ্বাস’ ফেলা, ‘আতঙ্কে ভোগা’, এটা কি আমাদের অনিবার্য নিয়তি? ‘সময়ের মূল্য’ শীর্ষক রচনাটি, শিশুশ্রেণিতে পাঠ্য, বড়দের সেটা না পড়লেও চলে, না বুঝলেও চলে; তা–ই নয় কি?
বিধান মিত্র অধ্যাপক, নেত্রকোনা সরকারি কলেজ, নেত্রকোনা।