ক্রিকেট নিয়ে দেশের মানুষ স্বপ্ন দেখে, যে স্বপ্নের বিস্তৃতি বাস্তবতা থেকে কয়েক গুণ বড়! আমাদের স্বপ্ন বিশ্বকাপের সোনালি ট্রফিটা উঁচিয়ে ধরা। অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হাত ধরে সেই অধরা ট্রফি ধরা দিলেও জাতীয় দল যেন ট্রফি থেকে বহু আলোকবর্ষ দূরে অবস্থান করছে।
বিশ্বকাপসহ বৈশ্বিক টুর্নামেন্টগুলোতে বাংলাদেশের সফলতার চেয়ে ব্যর্থতার পাল্লা কয়েক গুণ ভারী। ওডিআই কিংবা টি-২০ ফরম্যাটের বিশ্বকাপ তো দূরের কথা, চ্যাম্পিয়নস ট্রফি কিংবা এশিয়া কাপের মতো আসরেরও ট্রফিশূন্য আমরা! অথচ আমাদের গৌরব করার মতো থাকতে পারত সোনালি সময়! ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারিয়ে চমক দেখালেও ২৫ বছরে কেবল কিছু চমকেই সীমাবদ্ধ আমাদের বিশ্বকাপের যাত্রাগুলো!
সাতটি ওডিআই বিশ্বকাপের মধ্যে ২০০৭ বিশ্বকাপে ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারানো কিংবা ২০১৫ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে যাওয়া এবং ২০১৯ বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ আমাদের যাত্রা। তবে ভুলে গেলে চলবে না, বিশ্বকাপে আমরা আয়ারল্যান্ড-নেদারল্যান্ডসের মতো দলের সঙ্গেও হেরেছি। সেমিফাইনালে খেলার মতো যোগ্যতা এখনো হয়নি আমাদের! অথচ ক্রিকেট নিয়ে সমর্থকদের পাগলামি সব সময়ই আকাশচুম্বী। বিশ্বের যে প্রান্তেই বাংলাদেশের খেলা, সেই মাঠই যেন মিরপুরের মতো বাংলাদেশি দর্শকে পরিপূর্ণ!
দেশের ক্রিকেট কতটা এগিয়েছে? সফলতার বিবেচনায় ২০১৭ সালের চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেমিফাইনাল, ২০১৫ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল, তিনবার এশিয়া কাপের রানার্সআপ ট্রফি। যদি এগুলোকে সফলতা হিসেবে ধরা হয়, তবে দেখা যাবে এই ঘটনাগুলো ঘটেছে ২০১২ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে। এ সময়ের মধ্যে ঘরের মাঠে ভারত–পাকিস্তান কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারানোর সুখস্মৃতিও আছে!
মূলত সাকিব, তামিম, মুশফিক, মাশরাফি কিংবা রিয়াদের ক্যারিয়ার যদি আমরা বিবেচনা করি, তবে দেখা যাবে, এই সময়গুলোতে তাঁরা তাঁদের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে ভালো সময়গুলো পার করেছেন! এ সময়ে তাঁদের কিছু জাদুকরি পারফরম্যান্সের ওপর ভর করেই বদলাতে থাকে বাংলাদেশের ক্রিকেট।
বিশেষ করে ২০১৭ সালের চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে হারতে বসা ম্যাচে সাকিব–রিয়াদের অবিশ্বাস্য দুটি শতকে ভর করে সেমিফাইনালে খেলে বাংলাদেশ। ২০১৫ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের সঙ্গে রিয়াদের শতক কোয়ার্টার ফাইনালের পথ তৈরি করে দেয়। এই সময়গুলোতে মুশফিক দলের ব্যাটিংয়ের প্রধান স্তম্ভ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।
তবে ২০১৯ সালের পর মাশরাফির অনুপস্থিতি, পরবর্তী সময়ে মুশফিক–রিয়াদ কিংবা তামিমের বিভিন্ন ফরম্যাটে অনিয়মিত হওয়ার কারণে বাংলাদেশ দলও যেন নিজেদের হারিয়ে খুঁজছে। বিশেষ করে গত ওডিআই বিশ্বকাপের যাচ্ছেতাই পারফরম্যান্স কিংবা এবারের টি–২০ বিশ্বকাপেও হতাশাজনক পারফরম্যান্স আমরা দেখলাম। ২০১৯ ওডিআই বিশ্বকাপও কেটেছে হতাশায়। ২০২৩ বিশ্বকাপ নিয়ে সমর্থকদের আকাশচুম্বী চাহিদা থাকলেও বাংলাদেশ বিশ্বকাপ ইতিহাসের অন্যতম বাজে বিশ্বকাপ উপহার দেয়। ব্যাটিংয়ে এক রিয়াদ ছাড়া নেই কারও বলার মতো পারফরম্যান্স!
প্রকৃতির নিয়মেই একটা সময় সবাইকে বিদায় বলতে হয়, দেশের ক্রিকেটের এক সোনালি প্রজন্ম তাদের ক্যারিয়ারের গৌধূলিলগ্নে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এদের কারও কি বিকল্প তৈরি হয়েছে আদৌ? কারও ব্যাট কি মুশফিকের মতো নির্ভরযোগ্য প্রমাণ করতে পেরেছে কিংবা সাকিবের মতো অপরিহার্য কেউ হতে পেরেছে, নাকি তামিম ইকবালের মতো ওপেনিংয়ে নির্ভরতা দিতে পেরেছে?
মোটা দাগে বলা যায়, তাঁদের বিকল্প তৈরি হয়নি, কিংবা তৈরি করা সম্ভব হয়নি কিংবা তৈরি করার মতো সৃজনশীলতা বোর্ড–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন। এই দলে লিটন দাস, সৌম্য সরকারের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার প্রায় ১০ বছরের অথচ প্রতিনিয়ত তাঁরা অধারাবাহিকতায় যেন একজন আরেকজনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। অথচ এঁদের বারবার সুযোগ করে দিতে অনেকের ক্যারিয়ার নষ্ট করা হয়েছে কিংবা নতুনদের তেমন সুযোগ দেওয়া হয়নি। ১০ বছর পরেও এঁরা তথাকথিত ট্যালেন্ট তকমা নিয়েই কেবল আছেন, পারফরম্যান্সের বেলায় ষোলো আনা ফাঁকি!
মিডল অর্ডারে তরুণ হৃদয় ছাড়া নতুনদের মধ্যে কার ওপর ভরসা করা যায়? মেহেদী মিরাজ ছাড়া নির্ভরতা দিতে পারে, এমন অলরাউন্ডারেরও অভাব আমাদের। সব ফরম্যাট থেকে যখন সাকিব, তামিম, মুশফিক, রিয়াদরা অবসরে যাবেন, এই দলের কী অবস্থা হবে? যে দল নিয়ে আমাদের এত আশা, আদৌ কি তারা আধুনিক ক্রিকেটে মানানসই?
আমাদের আরেকটি বড় সমস্যা হলো কোনো ক্রিকেটার দুই ম্যাচ পারফর্ম করলেই মিডিয়া তাদের জাতীয় বীর বানিয়ে দেয়, আর এ কারণেই সাব্বিরের মতো ট্যালেন্ট খেলোয়াড়ও সময়ের সঙ্গে হারিয়ে যায়, লিটন থাকেন গা ছাড়াভাবে। পারফর্ম না করেও দুটি সুন্দর শট খেলে বাহবা পেয়ে যান। এগুলো অর্থহীন, পারফর্ম না করলে সৌন্দর্য দিয়ে কী করব আমরা!
আমাদের ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্ট হয়, কিন্তু সেটা দেশের ক্রিকেটে কতটা ভূমিকা রাখে। যেন দায়সারা একটা টুর্নামেন্ট চালিয়ে নিতে পারলেই খুশি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। দেশের ক্রিকেটাররা খুব বেশি ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টে ডাক পান না, আবার দু–একজন ডাক পেলেও বিসিবির অনাপত্তিপত্র কপালে জোটে না। তাই ভারতের মাঠে বিশ্বকাপ জেনেও তাসকিনকে আইপিএলে খেলতে দেওয়া হয় না অথচ একই সিরিজে দক্ষিণ আফ্রিকা তাদের মূল খেলোয়াড়দের আইপিএলে পাঠিয়ে নতুনদের নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে সিরিজ খেলে।
এ বছর আইপিএলে দুর্দান্ত পারফর্ম করতে থাকা মোস্তাফিজকে জিম্বাবুয়ের সঙ্গে খেলানোর জন্য দেশে নিয়ে আসা হয়। অথচ ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দলগুলোর খেলোয়াড়েরা বিশ্বের প্রায় সব কটি ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে অংশ নেন। এতে যেমন অভিজ্ঞতা বাড়ে, তেমনি তাঁরা বিভিন্ন কন্ডিশনে মানিয়ে নিতে পারেন।
আবার বড় দলগুলো ছোট দলগুলোর সঙ্গে বিকল্প খেলোয়াড়দের সুযোগ দিয়ে পাইপলাইন ঠিক রাখে আর আমরা! জিম্বাবুয়ের সঙ্গেও আমাদের মূল একাদশই যদি খেলে, বিকল্প খেলোয়াড় তৈরি হবে কীভাবে? আর তাই বলা যায়, আমাদের পাইপলাইনে ছিদ্র! বিকল্প খেলোয়াড় আমাদের হাতে গোনা। তাই পারফর্ম না করেও শান্ত টিকে যান, আবার দলের অধিনায়কও হন। লিটন চরম অধারাবাহিক হয়েও গা ছাড়া ভাব নিয়ে একের পর এক ম্যাচ খেলে যান। কারণ, তিনি জানেন পারফর্ম না করলেও তাঁর জায়গা স্কোয়াডে পাকা!
সবকিছু মিলে বলা যায়, ক্রিকেটে আমরা ক্রান্তিকাল পার করছি, শিগগিরই কোনো শিরোপার আশা করা আমাদের জন্য বোকামি। তবে সত্যিকারের পরিকল্পনা করে এগোতে পারলে সামনের দিনগুলোতে ভালো করা সম্ভব। কারণ, ভুলে গেলে চলবে না আমাদের একটা প্রজন্ম আছে, যারা বিশ্বকাপ জেতা স্কোয়াডের সদস্য। নতুনদের তৈরি করতে ঘরোয়া কোচদের আধুনিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তৈরি করা উচিত। এ দলকে খেলার মধ্যে রাখা, নতুন কিছু মাঠ তৈরি করা কিংবা মাঠগুলোকে স্পোর্টিং উইকেট বানাতে হবে। কোচিং প্যানেলে বড় নামের পরিবর্তে কার্যকরী নাম যুক্ত করতে হবে। বিশেষ করে দলের মধ্যে সিনিয়র-জুনিয়র গ্রুপিং তৈরি করে, এমন কোনো কোচ রাখা যাবে না।
গত ওডিআই বিশ্বকাপ চলাকালে বর্তমান কোচ বলেছিলেন, যাঁরা সেমির স্বপ্ন দেখেন, তাঁরা ঘুম থেকে জাগুন। চলমান টি–২০ বিশ্বকাপে সুপার এইটে ওঠার পরে তাঁর মন্তব্য ছিল, এখন যা হবে তা বোনাস! ভাবতে অবাক লাগে, এমন মনোভাবের একজন কীভাবে একটি দেশের জাতীয় দলের কোচ হন! এ ধরনের কোচকে পুনরায় নিয়োগ দেওয়া বিসিবির নির্বুদ্ধিতার পরিচয় বহন করে।
ট্রফির স্বপ্ন আমরা সমর্থকেরা দেখব, এটাই স্বাভাবিক। সে ক্ষেত্রে বোর্ড কর্তা, কোচিং স্টাফ আর সর্বোপরি খেলোয়াড়দের সঠিক পরিকল্পনা ও তার বাস্তবতায়নেই আমরা বড় কোনো ট্রফি জিততে পারব। নয়তো দায়িত্ব এড়িয়ে চলা ও একঘেয়ে কর্মকাণ্ড ভবিষ্যতে এই দলের অবস্থা হতে পারে কেনিয়ার মতো। ওহ, সেটা তো সম্ভব না। কারণ, আমাদের যে ৯০০ কোটি আছে, সেটা সুদ–আসলে বাড়ুক, তাতে ক্রিকেটের অবস্থা আর যা–ই হোক!
কে এম মাসুম বিল্লাহ
ব্যাংক কর্মকর্তা
দুমকি, পটুয়াখালী