‘একজন রাজনীতিসচেতন ভাষাসংগ্রামী ও চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশীরের ‘রক্তাক্ত একুশে’ লিনোকাটে ক্ষিপ্রগতিতে কাটা এক একটি আঁচড় যেন প্রতিবাদের ভাষা, প্রতিবাদের চিহ্ন।’
‘একজন রাজনীতিসচেতন ভাষাসংগ্রামী ও চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশীরের ‘রক্তাক্ত একুশে’ লিনোকাটে ক্ষিপ্রগতিতে কাটা এক একটি আঁচড় যেন প্রতিবাদের ভাষা, প্রতিবাদের চিহ্ন।’

প্রতিক্রিয়া

‘রক্তাক্ত একুশে’ নিয়ে ডাকটিকিট নয় কেন

১৯৭২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম স্মারক ডাকটিকিট। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ডাক বিভাগের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়। স্মারক এ ডাকটিকিটের বিষয় ছিল ভাষা আন্দোলন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে ভাষাশহীদদের স্মরণে আয়তাকার পরিসরে হালকা লাল-সবুজ রঙে ভাষা আন্দোলনের প্রতীক শহীদ মিনার উপজীব্য ছিল এ ডাকটিকিটের নকশায়।

রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবির ধারাবাহিকতা শেষ পর্যন্ত রূপ নিয়েছিল বাঙালির আধুনিক সংস্কৃতি গড়ার ভিত হিসেবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের পূর্বাপর প্রেক্ষাপটের সূত্রপাত স্পষ্টভাবেই ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গণে ভাষা আন্দোলনের ঘটনায় রক্ত ঝরেছিল যে চত্বরে, সেখানে হয়েছিল ‘শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ’ নির্মাণ, যা পরবর্তী সময়ে রূপ নিয়েছিল ‘শহীদ মিনার’-এ।

ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে গড়ে ওঠা এ শহীদ মিনার গত শতকের ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশের জন্মের চিন্তার সূতিকাগার। যদিও ১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির ‘শহীদ দিবস’ থেকেই বিকশিত হচ্ছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে বাঙালির সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অঙ্গীকারের ভাষা।

স্বাধীন বাংলাদেশে গুঁড়িয়ে দেওয়া কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের নতুন করে গড়া কাঠামোর পেছনে যুক্ত করা হয় লাল বৃত্ত। শহীদ মিনারের পেছনে থাকা লাল বৃত্তসহ চিত্রটি অবলম্বন করে ভাষা আন্দোলনের রজতজয়ন্তীতে ১৯৭৭ সালে বিশেষ খাম প্রকাশ করেছিল ডাক বিভাগ। ১৯৮৭ সালেও ভাষা আন্দোলনের ৩৫ বছরে প্রকাশিত হয় দুটি স্মারক ডাকটিকিট ও উদ্বোধনী খাম। এসব স্মারকে প্রতীক হিসেবে এসেছে শহীদ মিনার। স্মারক ডাকটিকিটের একটিতে আঁকা হয়েছে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে তরুণদের মিছিল এবং ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’ লেখা প্ল্যাকার্ড হাতে পুলিশের গুলিতে রক্তাক্ত এক ভাষাসংগ্রামী।

১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে মর্যাদা দেয় ইউনেসকো। এর পরের বছর ২০০০ সালে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদ্‌যাপন উপলক্ষে প্রকাশিত উদ্বোধনী খামের নকশায় মুদ্রিত হয় গোলাকার লাল বৃত্তের সামনে সরলরেখায় আঁকা শহীদ মিনার। ২০০২ সালে ভাষা আন্দোলনের সুবর্ণজয়ন্তীতে প্রকাশিত ডাকটিকিট ও উদ্বোধনী খামে শহীদ মিনার এসেছিল অনিবার্যভাবে।

২০০৯ সালের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন পর্বের আলোকচিত্র কোলাজ করে একটি স্যুভেনির শিট প্রকাশ করে ডাক বিভাগ। এতে আ জা ম তকীয়ূল্লাহ, আমানুল হক ও রফিকুল ইসলামের তোলা আলোকচিত্র ব্যবহার করা হয়। এ সময় প্রকাশিত একটি ডাকটিকিটে কালো রঙের সীমারেখার মাঝে ১৯৭২ সালে ভাষা শহীদদের স্মরণে প্রকাশিত প্রথম স্মারক ডাকটিকিটটি যুক্ত করা হয়েছিল।

মুজিব বর্ষে ২০২১ সালে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে প্রকাশিত ডাকটিকিটে শহীদ মিনারের পাশে একটি আলোকচিত্র ব্যবহার করা হয়। আলোকচিত্রটিতে দেখা যায়, ১৯৫৪ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে শহীদ দিবসে একটি মিছিলের সামনের সারিতে পাশাপাশি হেঁটে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী।

২০২১ সালের ১১ মার্চ মুজিব বর্ষে ভাষা আন্দোলনকে বিষয় হিসেবে গ্রহণ করে প্রকাশিত হয় আরেকটি ডাকটিকিট। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে স্বতঃস্ফূর্ত সাধারণ ধর্মঘট পালনের সময় ছাত্র-জনসাধারণের মিছিল যাচ্ছিল সচিবালয়ের দিকে। তখন লাঠিপেটা করে হাইকোর্টের সামনে মিছিলটি ছত্রভঙ্গ করে দেয় পুলিশ। এ সময় হামলায় গুরুতর আহত শওকত আলীকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ ঘটনার আলোকচিত্র দিয়ে প্রকাশিত হয় এ ডাকটিকিট।

২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত উদয় শংকর বিশ্বাসের লেখা বই ‘ফিলাটেলিক একুশ’ থেকে জানা যায়, ভাষা আন্দোলনকে উপজীব্য করে ডাক বিভাগের সিলমোহরেও প্রতীক হিসেবে শহীদ মিনার এসেছে নানা সময়ে। ১৯৬৩ সালে উদ্বোধন হওয়া আজকের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার বাংলাদেশের ডাকটিকিটে বিষয় হিসেবে ব্যবহার হয়েছে বিভিন্ন সময়ে নানাভাবে।

ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন পর্বের আলোকচিত্রও নানাভাবে এসেছে ডাকটিকিটে। তবে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনাবলির অনুপ্রেরণায় একই বছর ভাষাসংগ্রামী ও চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশীরের লিনোকাট মাধ্যমে আঁকা ঐতিহাসিক চিত্রকর্ম ‘রক্তাক্ত একুশে’ নিয়ে আমরা এখনো ডাকটিকিট বা উদ্বোধনী খাম প্রকাশ হতে দেখিনি। যদিও ভাষা আন্দোলনের পর ৭০ বছরেরও বেশি সময় হয়েছে অতিবাহিত। এ ছাপচিত্র ভাষা আন্দোলন বিষয়ে প্রথম চিত্রকর্ম হিসেবে গণ্য করা হয়। অবশ্য কোনো কোনো লেখায় এ চিত্রকর্ম ভাষা আন্দোলন নিয়ে প্রথম ছাপচিত্র বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।

শিল্পী মুর্তজা বশীর ‘আমার একুশে চিত্রাবলী’ লেখায় জানাচ্ছেন, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঘটনার তিন-চার মাসের মধ্যে দুটি রূপে ‘রক্তাক্ত একুশে’ চিত্রকর্মটি এঁকেছেন। প্রথম রূপটি এখন অনেক বেশি পরিচিত। এ চিত্রকর্মের দ্বিতীয় রূপটি ১৯৫৩ সালে কবি হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ সংকলনে প্রথম প্রকাশিত হয়। শিল্পী মুর্তজা বশীর ছাড়াও শিল্পী বিজন চৌধুরীর আঁকা বেশ কয়েকটি রেখাচিত্র এ সংকলনে মুদ্রিত হয়েছিল। এ সংকলনের প্রচ্ছদ করেছিলেন শিল্পী আমিনুল ইসলাম।

২১ ফেব্রুয়ারিতে গুলি চালানোর পর রক্তাক্ত বরকতকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন মুর্তজা বশীর। ভাষা আন্দোলনের সেই দিন নিয়ে লিখেছেন সাহিত্যগুণসম্পন্ন এক অনবদ্য লেখা ‘একটি বেওয়ারিশ ডায়েরির কয়েকটি পাতা’। একজন রাজনীতিসচেতন ভাষাসংগ্রামী ও চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশীরের ‘রক্তাক্ত একুশে’ লিনোকাটে ক্ষিপ্রগতিতে কাটা এক একটি আঁচড় যেন প্রতিবাদের ভাষা, প্রতিবাদের চিহ্ন।

‘রক্তাক্ত একুশে’ ছাপচিত্রটির দুটি রূপের প্রধান পার্থক্য সম্পর্কে শিল্পী মুর্তজা বশীর বলেছেন, ‘গুলিবিদ্ধ ছাত্রকে যে ছাত্র ধরেছে, তার ডান হাতে প্ল্যাকার্ডটি থাকলেও দ্বিতীয় চিত্রটিতে (দ্বিতীয় রূপ) তা নেই। তার জামার বুকপকেটে কলম, যা প্রথম চিত্রটিতে (প্রথম রূপ) ছিল না। প্রথম ছবিটির ডান দিকে নিচে ‘এম’ ও ‘বি’ দুটি আদ্যক্ষর, অর্থাৎ মুর্তজা বশীর একসঙ্গে খোদিত, কিন্তু অন্যটিতে নেই। তবে প্রথম ছবিটি আঁকতে গিয়ে যেভাবে লিনোকাটে আঁচড় ও অক্ষরের বিন্যাস করা হয়েছে, দ্বিতীয়টিতে তা অনুপস্থিত। মূলত আমার প্রকাশভঙ্গির সুস্পষ্ট বক্তব্য তুলে ধরার জন্য একই বিষয় ও ভঙ্গি দুইভাবে আঁকা হয়েছে।’

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনার পরপরই বিষয় হিসেবে সেই সময়ের কয়েকজন শিল্পী চিত্রকর্ম আঁকার কথা কোনো কোনো লেখা বা সাক্ষাৎকারে উল্লেখ আছে। যদিও এত বছরেও ভাষা আন্দোলন নিয়ে ওই সময়ে আঁকা মূল চিত্রকর্ম, চিত্রকর্মের আলোকচিত্র বা প্রকাশনার খোঁজ আমরা এখনো পাইনি। তবে ১৯৫৪ সালে দ্বিতীয় সাহিত্য সম্মেলন উপলক্ষে আয়োজিত বর্ধমান হাউসে অনুষ্ঠিত চিত্র ও আলোকচিত্রের প্রদর্শনীতে ‘রক্তাক্ত একুশে’ ছাপচিত্র প্রদর্শিত হয়। এ চিত্রকর্ম ছাড়া ভাষা আন্দোলন বিষয়ে আর কোনো চিত্রকর্ম ছিল না বলে বিভিন্ন লেখায় উল্লেখ করেছেন শিল্পী মুর্তজা বশীর।

‘এম’ ও ‘বি’ দুটি আদ্যক্ষর একসঙ্গে লেখা ‘রক্তাক্ত একুশে’ ছাপচিত্রের প্রথম রূপটির মূল চিত্র সংগ্রহ রয়েছে বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন শিল্পসংগ্রাহকের কাছে। মূল ছাপচিত্রটিও সংগ্রহ করেছে এশিয়ার আধুনিক ও সমকালীন শিল্পকলা সংগ্রহ করা জাদুঘর জাপানের ফুকোওকা এশিয়ান আর্ট মিউজিয়াম।

২১ ফেব্রুয়ারিতে গুলি চালানোর পর রক্তাক্ত বরকতকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন মুর্তজা বশীর। ভাষা আন্দোলনের সেই দিন নিয়ে লিখেছেন সাহিত্যগুণসম্পন্ন এক অনবদ্য লেখা ‘একটি বেওয়ারিশ ডায়েরির কয়েকটি পাতা’। একজন রাজনীতিসচেতন ভাষাসংগ্রামী ও চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশীর ‘রক্তাক্ত একুশে’ লিনোকাটে ক্ষিপ্রগতিতে কাটা এক একটি আঁচড় যেন প্রতিবাদের ভাষা, প্রতিবাদের চিহ্ন। প্রাণের বিনিময়ে, রক্তের বিনিময়ে পাওয়া আমাদের এই একুশে ফেব্রুয়ারি। তাই এ চিত্রকর্মের শিরোনাম বাংলাদেশের এ অগ্রগামী ডাকটিকিট সংগ্রাহক রেখেছিলেন ‘রক্তাক্ত একুশে’।

মুক্তিযুদ্ধ করে রক্তের বিনিময়ে পাওয়া আমাদের আজকের ৫০ বছর পেরিয়ে যাওয়া এই বাংলাদেশ। রক্তের ঋণ শোধ করতে ইতিহাসের মুখোমুখি হতে হয় সন্দেহাতীতভাবেই। ইতিহাস থেকে নিতে হয় শিক্ষা। চলতে হয় ইতিহাসের পথ ধরে। রাষ্ট্র ও নাগরিককে হতে হয় ব্যাপকভাবে ইতিহাসসচেতন। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস থাকা এমন ঐতিহাসিক চিত্রকর্ম ‘রক্তাক্ত একুশে’ কবে বাংলাদেশের ডাকটিকিটে দেখার সুযোগ পাওয়া যাবে?

  • আশফাকুর রহমান লেখক ও সাংবাদিক
    ই-মেইল: ashfak21@gmail.com