স্বৈরাচারের পতনের মধ্য দিয়ে আমরা বাংলাদেশের নতুন এক অধ্যায়ে প্রবেশ করেছি। জেন–জিরা, যারা নাম দিয়েছে বাংলাদেশ ২.০। ইতিমধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ এবং বণ্টন শেষ হয়েছে। এখন সময় সিস্টেম পরিবর্তন করার। স্বৈরাচারমুক্ত বাকস্বাধীনতার এই সময়ে সবাই কথা বলছেন, মতামত দিচ্ছেন।
এটা আমাদের জন্য আনন্দের, উৎসবের। কোটা সংস্কার ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বরাবরের মতো ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। ঠিক একইভাবে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বরাবরের মতো শিক্ষার্থীদের পাশে থাকতে অক্ষম হয়েছে এবং নৃশংস দমন–পীড়ন ও হত্যাকাণ্ডের পরও সরকারি লেজুড়বৃত্তি/তাঁবেদারি করে গেছে।
তাই এখন সময় এসেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে সংস্কার করে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা এবং ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী হিসেবে এ বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কারে আমারও বেশ কিছু পর্যবেক্ষণ ও মতামত আছে। আমি মনে করি, এ ভাবনাটা শুধু আমার একার নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে যাঁরা দলীয় লেজুড়বৃত্তি থেকে বের করে এনে বিশ্বমানের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ দান করতে চান, তাঁদের সবার।
আমি মনে করি, আমার এই প্রস্তাবনা বা মতামত শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়েও এটা প্রয়োগ করা যেতে পারে। তবে সেটা একান্তই সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ব্যাপার এবং সংস্কার তাদের দাবি অনুযায়ীই হওয়া উচিত।
প্রথমেই আসছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর নিয়োগ, সিনেটে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী প্রতিনিধির অনুপাত এবং তাদের নির্বাচন পদ্ধতি বিষয়ে। তবে তার আগে এ বিষয়টি কেন প্রয়োজন, তা বলে রাখার প্রয়োজন বোধ করছি। আমরা লক্ষ করেছি, কোটা সংস্কার নিয়ে শিক্ষার্থীদের অত্যন্ত যৌক্তিক ও ন্যায্য দাবিকে দমানোর জন্য যখন সরকার দমন-পীড়নের নীতি অবলম্বন করল তখন ঢাবি প্রশাসনসহ অধিকাংশ শিক্ষক চুপ থেকে গেলেন। যদিও তাঁদের এই অবস্থান নিয়ে আমি আশ্চর্য হইনি।
সরকার যখন শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য সারা দেশে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করল, তখন ঢাকা প্রশাসন তাদের নিরাপত্তা দিতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়। শিক্ষার্থীদের আতঙ্ক নিয়ে হল থেকে বের হতে হয়েছে। হল ছাড়া এই শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় ভাই-বোনেরা বা অনাবাসিক বন্ধুরা তাদের বাসায় জায়গা দিলেও অধিকাংশ শিক্ষক এই পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হন। তাঁদের ভেতর কয়েকজন আবার দায়সারা স্ট্যাটাস দিয়ে দায়িত্ব শেষ করেন।
শিক্ষকদের এই অবস্থান দেখে আমার মনে হয়েছিল, শ্রেণিকক্ষের বাইরে ও সরকারের তোষামোদি ছাড়া আর কোনো দায়িত্ব নেই তাঁদের। আমার সবচেয়ে অবাক লেগেছে, পেনশন নিয়ে শিক্ষকেরা কলাভবনের ফটকে আন্দোলন করতে পেরেছেন, কিন্তু শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়াতে পারেননি।
এর ভেতর ব্যতিক্রম ছিলেন ‘বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক’ এবং কয়েকজন প্রকৃত শিক্ষক। যাঁরা এই শিক্ষার্থীদের জন্য ঢাল হয়ে থেকেছেন, তাঁদের মুক্ত করে এনেছেন। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে তাঁরা জবাব চেয়েছেন এবং নিরাপত্তার দাবি জানিয়েছেন। শুধু তা–ই নয়, ওই রকম নিরাপত্তাহীনতার সময়ে তাঁরা সরকারের ফ্যাসিবাদী আচরণের তীব্র সমালোচনা করে সমাবেশ করেছেন। তাঁদের হাত কেঁপেছে, কিন্তু গলা কাঁপেনি।
এবার ফিরে আসা যাক ভাইস চ্যান্সেলর নিয়োগ, সিনেটে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী প্রতিনিধির নির্বাচন পদ্ধতি বিষয়ে। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাইস চ্যান্সেলর নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি।
সিনেট গঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশের অনুচ্ছেদ ২০(১)(এ)(বি)(সি) অনুযায়ী ভাইস চ্যান্সেলর, প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (প্রশাসন), প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (শিক্ষা) এবং কোষাধ্যক্ষ, অনুচ্ছেদ ২০(১)(ডি) অনুযায়ী সরকার কর্তৃক মনোনীত পাঁচজন সরকারি কর্মকর্তা, অনুচ্ছেদ ২০(১)(ই) অনুযায়ী মাননীয় স্পিকার কর্তৃক মনোনীত পাঁচজন সংসদ সদস্য, অনুচ্ছেদ ২০(১)(এফ) অনুযায়ী মাননীয় চ্যান্সেলর কর্তৃক মনোনীত পাঁচজন শিক্ষাবিদ, অনুচ্ছেদ ২০(১)(জি) অনুযায়ী সিন্ডিকেট কর্তৃক মনোনীত গবেষণা সংস্থার পাঁচজন প্রতিনিধি, অনুচ্ছেদ ২০(১)(এইচ) অনুযায়ী একাডেমিক পরিষদ কর্তৃক মনোনীত অধিভুক্ত ও উপাদানকল্প কলেজসমূহের পাঁচজন অধ্যক্ষ, অনুচ্ছেদ ২০(১)(আই) অনুযায়ী একাডেমিক পরিষদ কর্তৃক মনোনীত অধিভুক্ত ও উপাদানকল্প কলেজসমূহের ১০ জন শিক্ষক, অনুচ্ছেদ ২০(১)(জে) অনুযায়ী চেয়ারম্যান মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড-ঢাকা, অনুচ্ছেদ ২০(১)(কে) অনুযায়ী রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট কর্তৃক নির্বাচিত ২৫ জন প্রতিনিধি, অনুচ্ছেদ ২০(১)(এল) অনুযায়ী শিক্ষক কর্তৃক নির্বাচিত ৩৫ জন শিক্ষক প্রতিনিধি এবং অনুচ্ছেদ ২০(১)(এম) অনুযায়ী ডাকসু কর্তৃক মনোনীত পাঁচজন ছাত্র প্রতিনিধিকে নিয়ে।
একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণই হলো সেখানকার শিক্ষার্থীরা। অথচ আন্দোলনের সময়ে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক ভাইস চ্যান্সেলর নিয়োগ পদ্ধতি এবং সিনেটের শিক্ষার্থীবান্ধব পদক্ষেপ না নেওয়ার ফলে এই সিস্টেমের কোনো নৈতিক ভিত্তি থাকেনি, শিক্ষার্থীদের কোনো উপকারে আসেনি। এখন কথা হতে পারে—‘তাহলে এই সিস্টেমের বিকল্প কী?’
বিকল্প খুবই সহজ, বিশ্ববিদ্যালয় আইন/অধ্যাদেশ পরিবর্তন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাইস চ্যান্সেলর, প্রশাসনিক পদসমূহ এবং ৩৫ জন শিক্ষক প্রতিনিধিকে সব শিক্ষার্থীর, শিক্ষকের, কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত করতে হবে। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন থাকবে সরকারি লেজুড়বৃত্তিমুক্ত এবং শিক্ষার্থীদের কাছে দায়বদ্ধ।
এই নির্বাচন পদ্ধতি প্রণীত হলে প্রশাসনিক পদের প্রার্থীরা নিজেদের যোগ্যতা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিধ উন্নয়ন বিষয়ে নির্বাচনের আগে একাধিক প্যানেলের মাধ্যমে ইশতেহার তৈরি করতে বাধ্য হবেন এবং প্রচারণায় যাবেন, যা শিক্ষার্থীদের অনুকূলেই যাবে বলে আমি মনে করি। একই সঙ্গে এই প্যানেলগুলোকে সিন্ডিকেট, ভিসি মনোনীত শিক্ষাবিদ, সিন্ডিকেট মনোনীত গবেষণা সংস্থার সদস্য কারা হবেন, তা তাদের নির্বাচনী ইশতেহার বা হলফনামায় অথবা প্রচারণায় ব্যবহার করার আইন করলে তাতে শিক্ষার্থীদের সিন্ডিকেট সদস্য নিয়েও একটা স্পষ্ট ধারণা থাকবে।
অন্যদিকে, অনুচ্ছেদ ২০(১)(কে) অনুযায়ী রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট কর্তৃক নির্বাচিত ২৫ জন প্রতিনিধির স্থানে কোনো শিক্ষক প্রতিনিধি না থাকার বিধান রাখা প্রয়োজন। এতে সিনেটে তাঁবেদারি শিক্ষকদের কর্তৃত্ব কমবে। অনুচ্ছেদ ২০(১)(এম) অনুযায়ী ডাকসু কর্তৃক মনোনীত পাঁচজন ছাত্র প্রতিনিধি বাড়িয়ে ২৫ জন করতে হবে এবং নিয়মিত ডাকসু নির্বাচন করতে হবে।
এতে ঢাকা সিনেটে বর্তমান ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ বাড়বে এবং তাদের অধিকার নিশ্চিত হবে। প্রতিনিধিত্বশীল ঢাকা সিনেট গড়তে সেখানে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য পদ তৈরি করা যেতে পারে। এতে সব অংশীজনের অংশগ্রহণে ঢাকা সিনেট হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সবার সমস্যা-সংকট নিরসন, সুযোগ-সুবিধা প্রদান এবং উন্নয়নবিষয়ক স্ট্র্যাটেজি নির্মাণের কেন্দ্রবিন্দু। এতে শিক্ষার্থীরাও শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পাশে থাকবে, শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও শিক্ষার্থীদের স্বার্থবিরোধী কোনো কাজ করতে আগ্রহী হবেন না।
তখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ‘বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক’–এর মতো মেরুদণ্ডওয়ালা শিক্ষক এমনিতেই তৈরি হয়ে যাবে। এ ছাড়া অনুচ্ছেদ ২০(১)(ই) অনুযায়ী মাননীয় স্পিকার কর্তৃক মনোনীত পাঁচজন সংসদ সদস্য পদগুলো বিলুপ্ত করতে হবে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারের প্রভাব বিস্তার রোধ করা সম্ভব হবে। বিশ্ববিদ্যালয় হবে সত্যিকার অর্থেই স্বায়ত্তশাসিত।
এ ছাড়া ডাকসু নির্বাচনের পাশাপাশি হল সংসদ নির্বাচন করা অত্যন্ত জরুরি। কারণ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি চলেই আবাসিক হলগুলোর সিট বরাদ্দ নিয়ে।
হল সংসদ নির্বাচনের ফলে একদিকে যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈধ এবং বর্তমান শিক্ষার্থীরা তাদের মেধা ও প্রয়োজনের ভিত্তিতে হলগুলোয় সিট বরাদ্দ পাবে, অন্যদিকে দলীয় ছাত্ররাজনীতির ভয়াল থাবা থেকে সাধারণ শিক্ষার্থীরা রক্ষা পাবে।
হলের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রভোস্ট ও শিক্ষকদের সঙ্গে নিয়ে হলগুলোয় ক্যানটিন, লাইব্রেরি, সংস্কৃতিকেন্দ্র ও ক্লাবগুলোকে করবেন শিক্ষার্থীবান্ধব, মানসম্মত ও আধুনিক। গেস্টরুমের র্যাগিং কালচার দূর হয়ে সেখানে হবে শিক্ষার্থীদের মিলনমেলা।
আরিফ বিল্লাহ্ যোগাযোগকর্মী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থী