আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা আধুনিক হলেও মানুষের চিন্তা-ভাবনা সে অর্থে আধুনিক হয়নি। অনেকে মনে করেন একজন শিক্ষার্থী যদি স্বীকৃত কোনো সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পারে তবে সে কোনোভাবেই মেধাবী নয়। এর চেয়ে অবাক করার বিষয় হলো আমাদের দেশে যদি কোনো শিক্ষার্থী বিজ্ঞান বিভাগে এসএসসি এবং এইচএসসি শেষ করে তবে সে খুবই মেধাবী। আর যদি ব্যবসায়ী শিক্ষা কিংবা মানবিক শাখার শিক্ষার্থী হয় তখন স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেওয়া হয় যে তাদের কোনো মেধা নেই।
যাই হোক একজন শিক্ষার্থী যখন বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি শুরু করে তখন একমাত্র সেই জানে কী পরিমাণ পরিশ্রম তাকে করতে হয়। যাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো তারা শহরের নামীদামি কোচিংগুলোতে ভর্তি হয়ে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নেয়। আর যাদের অর্থনৈতিক অবস্থা শোচনীয় তারা কোনো এক বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় ভাইয়ের পরামর্শমতো বাজার থেকে বই কিনে নিয়ে প্রস্তুতি শুরু করে।
এই শিক্ষার্থীরা রাত দিন এক করে, খাওয়া-দাওয়া হারাম করে প্রস্তুতি নেয়। সেখান থেকে কেউ সফল হয় আর কেউ হেরে যায়। আমাদের সমাজ যে সব শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষায় সফল তাদের যেমন মাথায় তুলে নাচে ঠিক তেমনি যারা ব্যর্থ তাদের সমালোচনা করতে করতে মৃত্যু পর্যন্ত ঠেলে দেয়।
প্রতিবছর দেশে ১২-১৪ লাখ শিক্ষার্থী এইচএসসি পরীক্ষা দেয়। যেমন ২০২৩ সালে মোট ১৩ লাখ ৫৯ হাজার ৩৪২ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। এইচএসসি শেষ করে প্রায় ৯০ ভাগ শিক্ষার্থীই ভর্তি পরীক্ষার অংশগ্রহণ করে। বাকিরা বিভিন্ন কারণে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে না।
যেমন এ বছর ২০২৩-২৪ সেশনের ভর্তি পরীক্ষায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চার ইউনিটের ৫৯৬৫ আসনের বিপরীতে আবেদন করে ২ লাখ ৭৯ হাজার ২ জন শিক্ষার্থী। যেখানে এ ইউনিটে মোট আবেদন পড়েছে ১ লাখ ১ হাজার ৬৬৩টি। প্রতি আসনের বিপরীতে ৮৪ জন শিক্ষার্থী ছিল। একইভাবে বি ইউনিটে আসন প্রতি ৫৩ জন, সি ইউনিটের আসন প্রতি ২৯ জন এবং ডি ইউনিটে আসন প্রতি ৬৩ জন শিক্ষার্থী আবেদন করে।
এবার আমরা একটু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে নজর দিই। চবিতে এবার ৪৯২৬ আসনের বিপরীতে আবেদন করে ২ লাখ ৫৬ হাজার ৬৯ জন শিক্ষার্থী। যেখানে প্রতি আসনের জন্য লড়াই করেছে ৫২ জন। একইভাবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৯০৪ আসনের বিপরীতে আবেদন করে ১ লাখ ৮৫ হাজার ৫০০ জন শিক্ষার্থী। সেখানেও আসন প্রতি আবেদন পড়েছে ৪৮টি।
যদি আমরা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে নজর দিই সেখানে ১৮৪৪ আসনের বিপরীতে মোট আবেদন পড়েছে ১ লাখ ৯৭ হাজার ৩৫৯টি। এভাবে আমরা যদি গুচ্ছ পদ্ধতির দিকে তাকাই সেখানে ২৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০,৬৬৮ আসনের বিপরীতে আবেদন করেছে ৩ লাখ ৫ হাজার ৩৪৬ জন শিক্ষার্থী। প্রতি আসনের বিপরীতে আবেদন সংখ্যা ১৫টি করে।
সর্বসাকল্যে স্বায়ত্তশাসিত ঢাবি, চবি, রাবি, জাবি এবং গুচ্ছের ২৪ বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ৩৭ হাজার ৩০৭টি আসনের বিপরীতে আবেদন পড়েছে ১২ লাখ ২১ হাজার ৮৭৬টি। গড় হিসেব অনুযায়ী প্রতিটি আসনের বিপরীতে ৩২.৭৫ (প্রায় ৩৩ জন) শিক্ষার্থী লড়াই করেছে। তাহলে একবার চিন্তা করুন তাদের কি চেষ্টার কোনো কমতি ছিল?
তারা দিনরাত এক করে পরিশ্রম করলেও সেই পরিশ্রমকে মূল্য দেওয়ার মতো আসনসংখ্যা কি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আছে? একবার চিন্তা করুন প্রায় ১৩ লাখ শিক্ষার্থী থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পায় মাত্র ৩৭ হাজার শিক্ষার্থী। যেখানে প্রতিবছর এইচএসসিতে জিপিএ ৫ পায় লাখো শিক্ষার্থী। তাহলে কি ভর্তি পরীক্ষায় সুযোগ পাওয়া ৩৭ হাজার শিক্ষার্থী ছাড়া বাকিরা মেধাবী নয়? এতে কি একজন শিক্ষার্থীর প্রকৃত মেধা যাচাই করা সম্ভব?
তাহলে আপনারা কীভাবে একজন শিক্ষার্থীর এত পরিমাণ সমালোচনা করেন যেখানে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়াই হয় শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির সুযোগ থেকে বাদ দেওয়ার জন্য। একজন শিক্ষার্থীর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ না পাওয়া মানে তার মধ্যে লালিত স্বপ্নের অবসান ঘটা। এ রকম কঠিন পরিস্থিতিতে যেখানে এই অসুস্থ সমাজের উচিত তাদের সান্ত্বনা দেওয়া, তাদের পাশে দাঁড়ানো সেখানে এই সমাজ তাদের মরার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো সমালোচনা দিয়ে যাচ্ছে। এতে করে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে ঝরে যাচ্ছে অনেক তাজা প্রাণ। এর জন্য দায়ী কারা?
এইতো সেদিন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে মেধাতালিকায় নাম না আসায় এক তরুণী পদ্মা নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। এমন আত্মহত্যার ঘটনা নতুন নয়। গত বছর এক শিক্ষার্থী আত্মহত্যার আগে মা-বাবাকে লিখে গেছেন, তোমাদের কাছে বিশ্ববিদ্যালয় বড় হয়ে গেছে তাই আমি বিদায় নিলাম। আর কত মৃত্যু দেখলে আপনারা সচেতন হবেন?
মো. রাকিব
শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ
সরকারি সিটি কলেজ, চট্টগ্রাম