নতুন কারিকুলামে শিক্ষকদের অনীহা, শিক্ষার্থীদের আগ্রহ

নতুন কারিকুলাম শিক্ষাব্যবস্থাকে একেবারে শেষ করে দিল! কী হবে এসব শিক্ষা কারিকুলাম দিয়ে? চাকরির বাজারে গেলে তো সেই এমসিকিউ পরীক্ষা দিয়েই চাকরি নিতে হবে—এমন কথা এখন বেশির ভাগ অভিভাবকের মুখেই শোনা যায়। কেবল অভিভাবক নয়, কিছু শিক্ষকদের মুখেও প্রতিদিন এমন কথার চর্চা হয়। এমনকি শ্রেণিকক্ষেও শিক্ষার্থীদের সামনে নতুন কারিকুলামের নানা সমালোচনা করেন, যেটা শিক্ষার্থীদের পাঠের আগ্রহের পরিবর্তে অনীহা সৃষ্টি করে। অথচ আমি শিক্ষার্থীদের দেখেছি, তারা নতুন কারিকুলামে শিখতে কতটা কৌতূহলী। বই পড়ে মুখস্থ করে পরীক্ষায় লিখতে হবে এমন গতানুগতিক ধারা থেকে তারা বেরিয়ে এসে যেন স্বস্তির নিশ্বাস নিচ্ছে। প্রতিদিন নতুন নতুন কাজ শিখছে, একজন অন্যজনের কাজের গঠনমূলক সমালোচনা করছে, কীভাবে ভালো করা যায়, তার পরামর্শ দিচ্ছে।

বর্তমান কারিকুলাম সহযোগিতামূলক। যেখানে প্রথম, দ্বিতীয় হওয়ার কোনো চাপ নেই। আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে—ঠিক এভাবে দলগতভাবে সবাইকে নিয়ে ভালো কিছু করার জন্য তারা খুবই আন্তরিক। দুর্ভাগ্য! আমরা অধিকাংশ অভিভাবক, শিক্ষকেরা এখনো আন্তরিক হতে পারলাম না। আমরা পরে আছি, আমাদের সেই অতীতে। আমাদের সময় শিক্ষাব্যবস্থা ভালো ছিল, আমরাই সেরা ছিলাম, এমনটা জাহির করতে মরিয়া আমরা। কিন্তু আমরা যে শুধু মুখস্থ করে সার্টিফিকেট অর্জন করেছি, দক্ষতা অর্জন করতে পারিনি—এটা কখনো বলি না। বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠান অন্য দেশ থেকে দক্ষ লোক নিয়োগ দেয়। এর কারণ হিসেবে তারা বলেছে—এ দেশের ছেলেমেয়েদের মধ্যে দক্ষতার অভাব রয়েছে। আমাদের সন্তানেরা এখন দক্ষ হয়ে উঠছে; আমরা এটা মেনে নিতে পারছি না।

দেশের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েও আমরা অনেকেই একটা প্রেজেন্টেশন তৈরি করতে পারি না। প্রতিকূল পরিবেশে নিজেদের টিকিয়ে রাখতে পারি না। কীভাবে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে, তা জানি না। অথচ আমরা আমাদের মুখস্থবিদ্যা নিয়ে গর্ব করে দিন যাপন করছি, যা কেবল কয়েকটা সার্টিফিকেটে সীমাবদ্ধ।

এই কারিকুলামের পাঁচ মাস অতিবাহিত হয়েছে। এর মধ্যে আমি দেখেছি, তারা শিখছে কীভাবে অন্য মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়। বিভিন্ন প্রজেক্ট তৈরি করছে। শ্রেণিকক্ষের বাইরে গিয়েও নানা শ্রেণির মানুষের সাক্ষাৎকার নিচ্ছে। নতুন কারিকুলাম যেন তাদের বইয়ের মধ্যে দুচোখ আটকে না রেখে বাইরের বিশ্বকেও দেখার সুযোগ করে দিল। আগুন লাগলে কার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে? পরিবারের এক মাসের বাজেট তৈরি, মর্যাদা বজায় রেখে কীভাবে যোগাযোগ করতে হবে? বিজ্ঞানের নানা বিষয় তারা হাতে–কলমে শিখছে।

গণিত এখন শুধু সূত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, খেলার মাধ্যমে গণিত শিখছে। গণিতের বাস্তব প্রয়োগ করছে। দুই বন্ধু ইংরেজিতে কথা বলছে, যেটা আমরা অনেক ইংরেজি শিক্ষকও পাঠদান করতে গেলে ঠিকভাবে ইংরেজিতে পাঠদান করতে পারি না। এ রকম আরও নানা কাজ তারা প্রতিদিন শিখছে। শিক্ষার্থীদের এখন আর কেউ বলে না, আমি প্রথম হব। তাদের চিন্তাভাবনায় পরিবর্তন এসেছে। এখন আমি বলতে কিছু নেই, আমরা এটা করব, আমরা ওটা করব—এভাবে সবাইকে নিয়েই তারা ভাবতে শিখছে।

আমাদের শিক্ষার্থীদের মধ্যে যথেষ্ট মেধা রয়েছে। তারা হাতে-কলমে শিখতে পারছে। শিক্ষা যে কেবল মুখস্থ করা নয়, আনন্দেরও হতে পারে, তার প্রমাণ বর্তমান শিক্ষা কারিকুলাম। শ্রেণিকক্ষে তারা পড়ালেখার কাজ শেষে বাকি সময় মা-বাবার সঙ্গে বেড়াতে পারছে। বিভিন্ন খেলাধুলা করছে, যার ফলে তাদের পরিপূর্ণ শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ঘটছে।

নতুন এ শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের সারা রাত জেগে পড়ালেখা করে পরীক্ষায় বসতে হচ্ছে না। এখানে কোনো নম্বর পদ্ধতি নেই। নম্বর ছাড়াও যে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা যায়, তার উদাহরণ বর্তমান শিক্ষাক্রম। আগে বছরের নির্দিষ্ট সময়ে পরীক্ষায় খাতা-কলম নিয়ে বসতে হতো। নম্বরের চাপ থাকত। বর্তমানে সেখানে শেখা ও প্রয়োগের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। গতানুগতিক পরীক্ষার পরিবর্তে রয়েছে বছরব্যাপী ধারাবাহিক মূল্যায়ন।

ধারাবাহিক মূল্যায়নের কারণে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে নিয়মিত ক্লাস করতে হচ্ছে। একজন শিক্ষার্থী এ ক্ষেত্রে শিক্ষকের পাশাপাশি নিজেও নিজেকে মূল্যায়ন করতে পারছে। এ ছাড়াও রয়েছে আচরণগত মূল্যায়ন ও বছরে দুবার সামষ্টিক মূল্যায়ন। আচরণগত মূল্যায়নের কারণে একজন শিক্ষার্থী আচরণগতভাবেও যেমন শুদ্ধ হয়ে উঠছে, তেমনিভাবে ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় বুঝতে শিখছে। অন্যের মতামতকে সম্মান করছে। বিভিন্ন পরিবেশে কীভাবে নিজেকে মানিয়ে নিতে হবে, সেই দক্ষতা অর্জন করছে।

শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে শিক্ষকদের ভূমিকাই গুরুত্বপূর্ণ। ইতিমধ্যে শিক্ষকদের অনলাইনে-অফলাইনে নানা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কীভাবে পড়াতে হবে? কীভাবে মূল্যায়ন করতে হবে তার স্পষ্ট গাইডলাইন দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমরা কী করছি? অফলাইন ট্রেনিংয়ের কিছু কিছু শিক্ষককে এটাও বলতে শুনেছি যে ট্রেনিং করে আর কী হবে? এটা তো করি কিছু টাকা ভাতা পাব তার জন্য। স্কুলে কি এসব বাস্তবায়ন করা সম্ভব নাকি?

যেখানে আমরা মানসিকভাবেই প্রস্তুতি নিয়ে রাখছি এটা সম্ভব নয়, সেখানে অকারণেই কারিকুলামের দোষ দিচ্ছি—কারিকুলাম এ রকম না ওরকম হলে ভালো হতো, এ রকম হলে ছাত্রছাত্রীরা কিছু শিখবে না। এত দিন তো বই নিয়ে বসত! এখন পড়ালেখা গোল্লায় যাচ্ছে। আর অনলাইন ট্রেনিংয়ের অবস্থা তো আরও খারাপ। সরকার এত টাকা খরচ করে আমাদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করছে। অথচ আমরা অনলাইন ব্যবহার করতেও আগ্রহী নই। মুক্তপাঠ এখন আমাদের সবার পরিচিত একটা প্ল্যাটফর্ম। কিন্তু মুক্তপাঠে কীভাবে লগইন করতে হয়, কীভাবে কোর্স করতে হয়, সার্টিফিকেটের জন্য আবেদন করতে হয়—এসব আমরা অনেকেই জানি না। এখানেও শিখতে অনীহা আমাদের।

বাসায় বসে মুঠোফোনের মাধ্যমে যখন ইচ্ছা তখন শেখা যাচ্ছে, কিন্তু সে সুযোগটাও আমরা নিচ্ছি না। এলাকার কম্পিউটারের দোকানদারকে বলছি কোর্সটা করতে। সে করে দিচ্ছে কিংবা অন্য সহকর্মীকে বলছি, কোর্সটা করে সার্টিফিকেট প্রিন্ট করে রেখে দিতে; সে করে দিচ্ছে। আবার কেউ কেউ মুঠোফোনে কোর্স চালু করে সাউন্ড অফ করে রাখছি। এভাবে ফাঁকি দিয়ে যাঁরা সার্টিফিকেট অর্জন করেন, তাঁরাই আবার এই শিক্ষা কারিকুলাম নিয়ে কঠোর সমালোচক। তাঁরা জানেনই না এই কারিকুলাম কীভাবে সাজানো হয়েছে? শুধু শুনেছেন—নতুন কারিকুলাম! পরীক্ষা হবে না! আর হায় হায় করতে লাগল—পড়ালেখা শেষ! শিক্ষার্থীদের জীবন নষ্ট করে দিল! অথচ প্রশিক্ষণগুলো যদি ঠিকভাবে নিত, তাহলে বুঝতে পারত যে নতুন শিক্ষা কারিকুলাম কতটা সময়ের সঙ্গে মানানসই এবং একজন শিক্ষার্থীকে দক্ষ করে গড়ে তোলার জন্য কতটা কার্যকরী।

এখন আমাদের ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে শ্রেণিকক্ষে যেতে হবে। তাহলেই বর্তমান সরকারের নেওয়া নতুন কারিকুলাম ফলপ্রসূ হবে এবং আগামীর বাংলাদেশ পাবে একটি অভিজ্ঞতাসম্পন্ন জাতি।

ফোরকান
সহকারী শিক্ষক
পিরোজপুর সরকারি উচ্চবিদ্যালয়