সরকারি তথ্যমতে, প্রতিবছর বিশ্বের ১৭২টি দেশে সরকারিভাবে বৈধ কাজের ভিসা নিয়ে প্রবাসে পাড়ি দেন প্রায় ১০ লাখ মানু্ষ। বিভিন্নভাবে আরও নানা ভিসা নিয়ে মোট পাড়ি দেন ২০ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক। এই প্রবাসীরা প্রবাসে দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে প্রতি মাসে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতিতে রাখছেন অসামান্য অবদান। রাষ্ট্র ও সমাজ এসব মুখে স্বীকার করলেও বাস্তবতায় প্রবাসীরা সব সময় অবহেলিত। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি কর্তৃক প্রবাসীদের হয়রানির শেষ নেই।
আমি নিজে একজন প্রবাসী। আমি জানি, প্রবাসী বাংলাদেশিরা কত কষ্ট করে টাকা উপার্জন করেন। প্রবাসীরা এখানে খেয়ে না–খেয়ে পরিবারের জন্য, দেশের জন্য রেমিট্যান্স পাঠান। বলা যায়, একজন প্রবাসী কোনো চাহিদা আর বিলাসিতা ছাড়া গোটা একটা জীবন পরিবার ও দেশের জন্য উৎসর্গ করে দেন।
দেশে থাকাকালীন যে কাজ আত্মসম্মানের কারণে করতে পারেন না, অথচ তার চেয়ে শতগুণ নিম্নমানের কাজ হলেও প্রবাসীরা করেন কোনো অজুহাত না দেখিয়ে। দেশে থাকা মানুষজন দুই ঈদে কত সুন্দর ঈদ পালন করে, যার নতুন জামা কেনার সামর্থ্য নেই, তাকেও কেউ না কেউ কিছু দেয়।
কিন্তু প্রবাসে ঈদে নতুন জামা কিনতে খুব কম প্রবাসীকেই দেখি, মুষ্টিমেয় কয়েকজন হয়তো কেনেন। তবু প্রবাসীরা পরিবারের ঈদের খরচ কিন্তু পাঠিয়ে দেন, পরিবার ঈদ করে, সবাই নতুন জামা কেনে। প্রবাসীরা এটুকুতেই শান্তি খোঁজেন।
প্রবাসীকে বলা হয় ‘রেমিট্যান্স–যোদ্ধা’, তবে এই যোদ্ধাদের সম্মানটা কোথাও দেওয়া হয় না। উল্টো হতে হয় নানা জায়গায় লাঞ্ছনার শিকার। সমাজ কিংবা রাষ্ট্র কোথাও প্রবাসীদের যথাযোগ্য মর্যাদা দেওয়া হয় না। একজন প্রবাসী দেশের টানে দীর্ঘদিন পর ছুটিতে যান এবং তাতেও ভোগান্তির শেষ নেই।
দেশের বিমানবন্দরগুলোতে কতিপয় কর্মকর্তাদের হাতে প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হতে হয় প্রবাসীদের। বিমানবন্দরে প্রবাসীদের সঙ্গে করা হয় অমানবিক আচরণ। এ ছাড়া দিনরাত মেধা ও শ্রম দিয়ে পরিবারের জন্য কেনা দামি মালামালও চুরি হয় দেশের বিমানবন্দরগুলোতে। এমতাবস্থায় পরিবর্তন করতে হবে, দেশের বিমানবন্দরগুলোতে যাত্রীদের মালামালের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দিতে হবে। যাত্রীদের সম্মানের ব্যাপারে ওপরমহলের সার্বক্ষণিক নজরদারি জোরদার করতে হবে।
সভা–সেমিনারে কিংবা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের গোলটেবিলে প্রবাসীদের নিয়ে কত গুণগান বা কত বাহবা দেওয়া হয়, অথচ বাস্তবে রাষ্ট্রীয় কোনো প্রতিষ্ঠান প্রবাসীদের সম্মান করে না। পাসপোর্ট অফিস থেকে শুরু করে ট্রেনিং সেন্টার—সবখানে একজন প্রবাসীকে ভোগান্তির শিকার হতে হয়।
প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সে ভর করে দেশের অর্থনীতি এগিয়ে যাচ্ছে, তা স্বীকার করা হয়। কিন্তু বিমানবন্দরে প্রবাসীদের হয়রানি বন্ধে কোনো কার্যকর ভূমিকা পালন করা হয় না। ইমিগ্রেশনে ঢুকলে মনে হয়, আমি কোনো অপরাধী এবং অপরাধ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছি।
বিমানবন্দরে প্রবাসীদের সঙ্গে আনা মালামাল চেকের নামে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসিয়ে রাখা এবং প্রবাসীর সঙ্গে থাকা নগদ অর্থ বকশিশের নামে নিয়ে নেওয়া বিমানবন্দরের প্রতিদিনের চিত্র। বিমানবন্দরে একজন প্রবাসীর সঙ্গে অসদাচরণ থেকে শুরু করে লাগেজ ছুড়ে ফেলা, এমনকি গায়ে হাত তোলার মতো ঘটনাও নতুন কিছু নয়।
বিমানবন্দরে পরিচ্ছন্নতাকর্মী থেকে শুরু করে একেবারে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা—সবারই হাবভাব একই। নানা সময়ে প্রবাসীরা এসব নিয়ে অভিযোগ জানালেও কোনো প্রতিকার এখনো পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশের বিমানবন্দরের যাত্রীসেবা নিয়ে সন্তুষ্ট হয়েছে, অথবা হয়রানির শিকার হয়নি—এমন প্রবাসী খুঁজে পাওয়া দুর্লভ। মাঝেমধ্যে সরকার প্রবাসী হয়রানি বন্ধে কিছু পদক্ষেপ নিলেও বাস্তবে এখনো বিমানবন্দরের চিত্র একই, বরং দিন দিন প্রবাসী হয়রানির মাত্রা আরও বাড়ছে।
শুধু বিমানবন্দরেই নয়, দূতাবাসে গিয়েও ভোগান্তির শেষ নেই। দূতাবাসেও দালাল চক্রকে না ধরলে এক দিনের কাজের জন্য তিন মাস ঘুরতে হয়।
প্রবাসজীবনের একটি বড় সমস্যা প্রবাসীর লাশ দেশে নেওয়া। প্রবাসে এসে অনেকে রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান, অনেকে আত্মহত্যা করেন, কেউ সড়ক দুর্ঘটনায় বা কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনাসহ নানা কারণে মারা যান। দেখা যায়, মৃত প্রবাসীর লাশ যে সংখ্যক দেশে ফেরে, তার চেয়ে অনেক বেশিসংখ্যক লাশ বিদেশেই থেকে যায়। দেশে পরিবারের সদস্যরা প্রিয় মানুষকে শেষ দেখাও দেখতে পারেন না। নানা জটিলতা ও বাধাবিপত্তির কারণে লাশ দেশে আনতে বা পাঠাতে সমস্যা হয়।
এ ছাড়া লাশ দেশে পাঠাতে দরকার হয় মোটা অঙ্কের টাকা, যা অনেক প্রবাসীর পরিবারের পক্ষে দেওয়া সম্ভব হয় না। মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে দেখা যায়, কোনো প্রবাসী মারা গেলে দেশে পাঠানোর জন্য চাঁদা তুলতে হয়, যা খুবই দুঃখজনক। এ ছাড়া লাশ নিয়ে দূতাবাসের সহায়তা নিতে গেলেও ভোগান্তির শেষ থাকে না। বিশ্বের যেকোনো দেশে বাংলাদেশি মারা গেলে প্রবাসীর লাশ দেশে বিনা খরচে যাবে, এমনটা চান প্রবাসীরা ও তাঁদের পরিবার।
রাষ্ট্র প্রবাসীদের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ রেমিট্যান্স পেয়ে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হয় বিধায় রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো কোনো প্রবাসী প্রবাসে মৃত্যুবরণ করলে সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় খরচ ও দায়িত্বে প্রবাসীর লাশ স্বজনদের কাছে পৌঁছে দেওয়া। কিন্তু মৃত প্রবাসীর লাশ দেশে ফেরত পাঠানো বিষয়ে যে পরিমাণ হয়রানির শিকার হতে হয়, তা যেকোনো মানদণ্ডে চরম অমানবিক।
এ ছাড়া কোনো প্রবাসী যদি ঋণ করে প্রবাসে গিয়ে ঋণ পরিশোধের আগেই প্রবাসে মৃত্যুবরণ করেন, তাহলে সেই ঋণ পরিশোধের ব্যাপারেও রাষ্ট্র থেকে কোনো সহযোগিতা পাওয়া যায় না। প্রবাসীরা বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স পাঠালে রাষ্ট্র উপকৃত হয়, প্রবাসীদের বাহবা দেওয়া হয়। বিপরীতে প্রবাসী বিদেশে মৃত্যুবরণ করলে রাষ্ট্র চোখ বন্ধ করে রাখে, যাতে কোনো কিছুই না দেখা যায়।
প্রবাসীরা যাতে নিরাপদে সফর করতে পারেন, সে জন্য সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে এবং তা যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রয়োজনে প্রবাসীদের জন্য প্রবাসী সুরক্ষা আইন করতে হবে। প্রবাসীরা দেশের সূর্যসন্তান, তাই প্রবাসীদের যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করতে হবে। বিভিন্ন দেশে থাকা বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মীদের আরও আন্তরিক হতে হবে। প্রবাসীর লাশ বিনা খরচে দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। প্রবাসীরা ভালো থাকলে বাড়বে রেমিট্যান্স, রেমিট্যান্স বাড়লে আরও ভালো থাকবে প্রাণের বাংলাদেশ।
মিনহাজ বিন মাহবুব
বাঁশখালী, চট্টগ্রাম
(বর্তমানে কাতারের দোহাপ্রবাসী)