শিক্ষাক্রম আমূল পরিবর্তন করা যায় না

 বাংলাদেশে যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রমের অন্যতম প্রবর্তক প্রয়াত প্রফেসর কফিল উদ্দিন আহমেদ বলতেন, ‘পৃথিবীর কোনো দেশের শিক্ষা ও আইনব্যবস্থা আমূল পরিবর্তন করা যায় না।

আমূল পরিবর্তন করতে গেলে মূল না থাকার সম্ভাবনাই বেশি।’কথাগুলো মনে পড়ল, ১৬ জানুয়ারি ২০২৪ দৈনিক প্রথম আলোয় প্রকাশিত তারিক মনজুরের, ‘প্রাথমিকের পাঠ্যবই কেন নতুন করে লেখা দরকার’ শিরোনামের লেখাটি পড়ে।

 জনাব মনজুর অভিযোগ করেছেন, ‘নতুন শিক্ষাক্রম ভালো কি মন্দ, এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা কম হয়নি। কিন্তু দরকারি একটা আলাপ আলোচনায় আসেনি। সেটি হলো, নতুন শিক্ষাক্রম অনুসরণ করা হয়েছে কেবল মাধ্যমিক স্তরে।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রাথমিকে মূলত পুরোনো শিক্ষাক্রমই একটু অদলবদল করে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে।’

পাঠকের জানার জন্য বলে রাখা দরকার, তারিক মনজুর ২০২৩–২৪ সালে প্রণীত প্রাথমিক স্তরের বাংলা বিষয়ের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির বইয়ের লেখক।

অন্যদিকে তিনি মাধ্যমিক স্তরের বাংলা বিষয়ের কারিকুলাম প্রণেতা এবং ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম ও নবম শ্রেণির লেখক। তাহলে তাঁর ভাষায় ‘একটু অদলবদল করে চালিয়ে দেওয়া’ পুরোনো শিক্ষাক্রমেই প্রাথমিকের তিনটি বই তিনি লিখেছেন! সবকিছু জেনেও তিনি নিজেকে এই প্রক্রিয়া থেকে বিযুক্ত করার চিন্তা করেননি। 

 অনেকেই জানেন, ১৯৮৮ সাল থেকে গবেষণা শুরু করে ১৯৯২ সালে এসে বাংলাদেশে প্রাথমিক স্তরে যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম চালু হয়। সেই সঙ্গে প্রথম থেকেই কার্যক্রমভিত্তিক শিখন শেখানো (অ্যাক্টিভিটি বেইসড টিচিং লার্নিং) পদ্ধতি গ্রহণ করার প্রচেষ্টা নেওয়া হয়।

অর্থাৎ যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রমের সঙ্গে সক্রিয় শিখন (অ্যাক্টিভ লার্নিং) পদ্ধতি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। কারণ, তা শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক এবং মুখস্থ বিদ্যা (রোট মেমোরিজেশন) ও নিষ্ক্রিয় শিখনকে নিরুৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে প্রণীত হয়েছিল।

অন্যদিকে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাক্রম ২০২১ সাল পর্যন্ত উদ্দেশ্যভিত্তিক হিসেবে পরিচালিত হয়ে আসছিল। যেখানে শিক্ষক শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনায় পাঠ্যপুস্তকের পাঠকেন্দ্রিক কিছু উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য নিয়োজিত থাকতেন।

ফলে এটি শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক ছিল না। শিক্ষাক্রমে পাঠ–সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন রকম কার্যাবলির উল্লেখ থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটি শিক্ষার্থীকে পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তু মুখস্থ করার দিকে উৎসাহিত করত।

 ইতিমধ্যে গত তিন দশকে পৃথিবীর দেশে দেশে যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম গ্রহণের জোয়ার শুরু হলে ২০১৮ সালে এসে বাংলাদেশে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাক্রম যোগ্যতাভিত্তিক কাঠামোতে রূপান্তরিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়।

এনসিটিবির প্রাথমিক শিক্ষাক্রম শাখা থেকে এই উদ্যোগকে স্বাগত জানানো হয় এবং দুই স্তরের শিক্ষাক্রম সমন্বয় করার জন্য একটি অভিন্ন জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা প্রণয়নের প্রস্তাব করা হয়।

সেক্ষেত্রে পূর্বের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও ২৯টি প্রান্তিক যোগ্যতার পরিবর্তে অভিন্ন রূপকল্প, অভিলক্ষ্য, ১০টি মূল যোগ্যতা ও ১০টি শিখনক্ষেত্রভিত্তিক যোগ্যতার সন্নিবেশে যে শিক্ষাক্রম রূপরেখা প্রণয়নের কাজ শুরু হয়, সেটির ওপর ভিত্তি করে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাক্রম পরিমার্জন করা হয়।

২০২১ সালেও পূর্বের ন্যায় যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম প্রণয়নের পরীক্ষিত রীতি অনুযায়ী মূল শিখন ক্ষেত্রভিত্তিক যোগ্যতা থেকে প্রাথমিক স্তরের শিখনক্ষেত্রভিত্তিক যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়।

পরবর্তী সময় বিষয়ভিত্তিক আবশ্যকীয় শিখনক্রম প্রণয়ন করা হয়। সবশেষে বিষয়ভিত্তিক বিস্তৃত শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করা হয়।

এ ক্ষেত্রে ২০১৭-১৮ সালে পরিচালিত পরিস্থিতি বিশ্লেষণ ও চাহিদা নিরূপণ এবং প্রচলিত শিক্ষাক্রমের কার্যকারিতা যাচাই নামক দুটি গবেষণা থেকে প্রাপ্ত সুপারিশের ভিত্তিতে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাক্রম পরিমার্জন করা হয়।

 অন্যদিকে এনসিটিবির মাধ্যমিক শাখা প্রাথমিক স্তরের যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম প্রণয়নের তিন দশকের অভিজ্ঞতা ও রীতিনীতিকে কাজে না লাগিয়ে শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তনের লক্ষ্যে অভিনব পদ্ধতিতে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাক্রম প্রণয়নে অগ্রসর হয়।

তারা শিখন শেখানো পদ্ধতি, পাঠ্যপুস্তকের বিন্যাস ও মূল্যায়ন পদ্ধতি ইত্যাদি সব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় প্রচলিত কোনো কিছুর সঙ্গে মিল না রেখে নতুন নতুন ধ্যানধারণা প্রবর্তনে উদ্যোগী হয়। ফলে সম্পূর্ণ নতুন এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন পর্যায়ে এসে বিপুল বাধার সম্মুখীন হচ্ছে।

 প্রাথমিক স্তরের এবারের শিক্ষাক্রমে শুধু ১০টি মূল যোগ্যতাই নয়, টেকসই উন্নয়ন অভিলক্ষ্য, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও রূপকল্প ২০৪১ বিবেচনায় যোগ্যতাগুলো পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে। যোগ্যতার ব্যবহারিক সংজ্ঞার সঙ্গে শিখনের জ্ঞানমূলক, আবেগিক ও মনোপেশিজ ক্ষেত্রের পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে। শিখন শেখানো কার্যক্রমকে অধিকতর বাস্তবায়নযোগ্য করা হয়েছে।

প্রাথমিকের এই শিক্ষাক্রমে পাঠ্যপুস্তকের আঙ্গিকে ও বিষয় বস্তুতেও পরিবর্তন আনা হয়েছে। কার্যক্রমভিত্তিক শিখন তথা সক্রিয় শিখনকে গুরুত্ব দিয়ে পাঠ্যপুস্তক রচনা করা হয়েছে, যাতে শিক্ষার্থীদের বুদ্ধিবৃত্তিক চাপ (কগনিটিভ লোড) সহনীয় পর্যায়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে জাপানের পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের কলাকৌশল প্রয়োগ করা হয়েছে

এ ছাড়া প্রাথমিক স্তরের পরিমার্জিত শিক্ষাক্রমে বিষয়ভিত্তিক যোগ্যতাগুলোকে সহজ থেকে কঠিন, জানা থেকে অজানা এবং নিকট থেকে দূর— ক্রমে সাজানো হয়েছে।

শ্রেণিভিত্তিক আবশ্যকীয় শিখনক্রমে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত যথাযথ ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়েছে। শিক্ষাক্রমে যোগ্যতা, শিখনফল ও পরিকল্পিত কাজগুলো অন্তর্ভুক্তিমূলক করে পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে।

 উপরন্তু, প্রাথমিকের এই শিক্ষাক্রমে মূল্যায়ন পদ্ধতি ও কৌশল এবং ধারাবাহিক মূল্যায়নের নির্দেশনা সংযোজন করা হয়েছে। মূল্যবোধ ও নৈতিকতার যোগ্যতাগুলোকে অভিন্ন রেখে বিভিন্ন ধর্ম অনুযায়ী শিখনফল বিন্যাস করা হয়েছে।

সংগীত এবং চারু ও কারুকলা বিষয়কে শিল্পকলা নামে এবং শারীরিক শিক্ষা বিষয়কে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য শিক্ষা নামে পুনর্বিন্যস্ত করা হয়েছে।

 প্রাথমিকের এই শিক্ষাক্রমে পাঠ্যপুস্তকের আঙ্গিকে ও বিষয় বস্তুতেও পরিবর্তন আনা হয়েছে। কার্যক্রমভিত্তিক শিখন তথা সক্রিয় শিখনকে গুরুত্ব দিয়ে পাঠ্যপুস্তক রচনা করা হয়েছে, যাতে শিক্ষার্থীদের বুদ্ধিবৃত্তিক চাপ (কগনিটিভ লোড) সহনীয় পর্যায়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে জাপানের পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের কলাকৌশল প্রয়োগ করা হয়েছে।

 এখানে শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক শ্রেণি কার্যক্রমকে বাস্তবমুখী করার জন্য শিক্ষক সহায়িকায় সক্রিয় শিখনের বহুমাত্রিক কলাকৌশল, যেমন অনুসন্ধানমূলক শিখন, সমস্যা সমাধানভিত্তিক শিখন, প্রকল্পভিত্তিক শিখন, প্রতিফলনমূলক শিখন, অভিজ্ঞতামূলক শিখন ইত্যাদি সংযোজন করা হয়েছে।

সংখ্যার ধারণাকে গুরুত্ব দিয়ে তৃতীয় শ্রেণি থেকেই প্রাথমিক বিজ্ঞান বিষয়ে কম্পিউটার কোডিং সংযোজন করা হয়েছে।

 প্রাথমিক শিক্ষার মাঠ প্রশাসনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে এবারের প্রাথমিক শিক্ষাক্রমটিকে জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২১–এর মূল বিষয়বস্তুগুলোর ওপর ভিত্তি করে এবং গবেষণালব্ধ ফলাফলের আলোকে পরিমার্জন করা হয়েছে।

শিক্ষাক্রম পরিবর্তন (কারিকুলাম চেঞ্জ) বিষয়ে বিশেষজ্ঞগণ বলে থাকেন, সাধারণত কোনো শিক্ষাক্রমের ৮ থেকে ১০ ভাগ পরিমার্জন করা যুক্তিসংগত।

 এতৎসত্ত্বেও অভিন্ন জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২১–এর আলোকে প্রাথমিক স্তরে এবার বিভিন্ন বিষয়ের শিক্ষাক্রমে এবং পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে ২০ থেকে ৫০ ভাগ পরিবর্তন করা হয়েছে।

তবে সুখের বিষয়, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর তার মাঠ প্রশাসনের সব পর্যায়ে এই পরিমার্জিত শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জকে গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করে স্মার্ট নাগরিক তৈরিতে উদ্যোগী হয়েছে।

  •  ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান সাবেক সদস্য, প্রাথমিক শিক্ষাক্রম, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড।