সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন। ২ জুন, মঙ্গলবার, শাহবাগ এলাকা, ঢাকা।
সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন। ২ জুন, মঙ্গলবার, শাহবাগ এলাকা, ঢাকা।

একাত্তরে জীবনযুদ্ধ করা সেসব মানুষের জন্য কোটা কই

একাত্তর সালের এক পরিবারের গল্প জানি—যুদ্ধের কিছু মাস আগে শারীরিক অসুস্থতায় পরিবারপ্রধান মারা গেছেন, মারা যাওয়ার সময় তাঁর পাঁচজন সন্তান রেখে যান। বড় তিন মেয়েকে এর আগে বিয়ে দেওয়া হয়েছে আর সন্তানদের মধ্যে যে সবচেয়ে ছোট, তার বয়স তখন চার বছর। এর মধ্যেই দেশে বেজে উঠল যুদ্ধের দামামা। এই পরিবার থেকে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য উপযুক্ত কোনো সদস্য কি অবশিষ্ট ছিলেন?

মা জননী তাঁর পিতৃহীন দুই অবুঝ সন্তানকে নিয়ে যুদ্ধের সময় প্রতিনিয়ত জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করে কোনো রকমে টিকে ছিলেন স্বাধীন বাংলার অপেক্ষায়।

এ রকম অসংখ্য পরিবার আছে, যাদের কারোরই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার সুযোগ ছিল না। পরিস্থিতি ও বাস্তবতা বিবেচনায় সেটি অস্বাভাবিক ও অযৌক্তিক কিছু নয়। অথচ আজ বঙ্গবন্ধুর বৈষম্যহীন স্বাধীন বাংলায় সেই পরিবারের পরবর্তী প্রজন্মকে শুনতে হচ্ছে—‘তোমার দাদা যুদ্ধ না করে ঘরে বসে ছিলেন। সুতরাং তোমার চেয়ে আমার দেশের প্রতি অধিকার বেশি।’

বীর মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। দেশের স্বাধীনতার জন্য যাঁরা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছিলেন, তাঁদের প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা। তাঁদের জন্য রাষ্ট্রীয় ভাতাসহ বিভিন্ন সুবিধা দিচ্ছে সরকার। খেতাব, শারীরিক অসামর্থ্যসহ নানা বিবেচনায় সর্বোচ্চ ৪৫ হাজার টাকা পর্যন্ত ভাতা, রেশন, দুই ঈদে বোনাসসহ যুদ্ধাহত ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবার ২২টি আলাদা সুবিধা পেয়েথাকে।

আমি মনে করি, নিজ হাতে স্বাধীন করা দেশ থেকে এটি তাঁদের প্রাপ্য, প্রয়োজনে এই সুযোগ–সুবিধা আরও বাড়ানো যেতে পারে; কিন্তু চাকরির ক্ষেত্রেও যদি তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য কোটা–সুবিধা দেওয়া হয়, তা গোটা জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বৈষম্য তৈরি করবে।

আমার দাদার মোট ৮ সন্তান এবং ২৩ জন নাতি–নাতনি। একই পরিবারের এত মানুষ যদি কোটা ব্যবহারের সুযোগ পান, তাহলে শিক্ষিত বেকার তরুণদের জন্য চাকরির বাজার নিঃসন্দেহে সংকুচিত হয়ে যাবে।

কোটা মূলত পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম প্রজন্ম কোটা ব্যবহার করে ভালো অবস্থান তৈরি করলে তাঁরা তো আর পিছিয়ে পড়াদের দলে থাকছেন না। তাহলে দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রজন্মের কোটা ব্যবহারের যৌক্তিকতা কোথায়?

আমাদের প্রতিবেশী বন্ধুরাষ্ট্র ভারতেও সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা রয়েছে। ভারতে মোট চার ধরনের কোটা রয়েছে; উপজাতি কোটা, বিভিন্ন জাতভিত্তিক কোটা, অন্যান্য অনগ্রসর মানুষের জন্য কোটা এবং বিভিন্ন রাজ্যে সংখ্যালঘু কোটা।

সব মিলিয়ে মোট ৪৯ দশমিক ৫ শতাংশ কোটা থাকলেও ভারতে কোটার জন্য রয়েছে একটি সুষ্ঠু ব্যবস্থা। একটি পরিবারে কতজন কোটা–সুবিধা গ্রহণ করতে পারবেন, তা–ও নির্দিষ্ট করা। উচ্চশিক্ষা ও চাকরিতে কোটা–সুবিধা নেওয়ার ক্ষেত্রেও আছে আলাদা নিয়ম।

আমাদের দেশেও কোটার প্রয়োগে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা আনা প্রয়োজন। যেখানে কোটা ব্যবহার করে একটি পরিবারের একজন সরকারি চাকরি পেয়ে গেলে সেই পরিবারের জন্য আর কোটার ব্যবহার চলবে না। বিষয়টা তো মূলত ওই পরিবারের তখন কোটারই প্রয়োজন হওয়ার কথা নয়।

উচ্চশিক্ষা ও চাকরির কোটা আলাদা আলাদা করা হোক। যিনি উচ্চশিক্ষার জন্য কোটা–সুবিধা গ্রহণ করেছেন, তাতেই তিনি চাকরি পেতে উপযুক্ত; কিন্তু তাঁকে প্রতিযোগিতায় অন্যদের সঙ্গে সমানভাবে অংশ নিতে হবে।

মুক্তিযুদ্ধ কোটা যদি সম্পূর্ণ বাতিল না–ও করা হয়, সেটিকে ৩০ শতাংশ থেকে ৫–১০ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে। সেই সঙ্গে অন্যান্য কোটারও সংস্কার করতে হবে।

আফসানা সাথী
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ই-মেইল: afsanasathi804@gmail.com