‘যখন আমি থাকব না, কী করবি রে বোকা!’

শুধু কি ঝড়-ঝাপটা থেকেই সুন্দরবন আমাদের রক্ষা করছে? না, বরং লাখ লাখ মানুষের জীবন ও জীবিকার উৎসও এই সুন্দরবন।
শুধু কি ঝড়-ঝাপটা থেকেই সুন্দরবন আমাদের রক্ষা করছে? না, বরং লাখ লাখ মানুষের জীবন ও জীবিকার উৎসও এই সুন্দরবন।

সুন্দরবন, বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষে প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা পৃথিবীর একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল। বাংলাদেশের গর্ব করার মতো যে কয়টা গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে, তার মধ্যে সুন্দরবন একটি। এটি শুধু বাংলাদেশের সম্পদ নয় বরং পৃথিবীর সম্পদ। দেশকে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য একমাত্র প্রাকৃতিক দূর্গ। বাংলাদেশে সবশেষ আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’। মোখার আগের ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংকে প্রতিহত করে বরাবরের মতোই নিজের সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে এই বৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনটি। ইউনেস্কো অনেক আগেই সুন্দরবনকে ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ’ ঘোষণা করেছে এবং এর প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষার তাগিদ দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু অমূল্য সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণে তদারকের কোনো বালাই নেই, বরং নানাভাবে সুন্দরবনকে ধ্বংস করা হচ্ছে।

২০২২ সালের ২৫ অক্টোবর ঘণ্টায় ৭৪ কিলোমিটার গতিবেগে আছড়ে পড়ে সিত্রাং। এর আগে আছড়ে পড়া আম্পান, ইয়াস, বুলবুল, ফণী, সিডর, নার্গিসের মতো শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়কে অনেকটা নীরবভাবে একাই প্রতিহত করেছে সুন্দরবন। এ যেন বাংলাদেশের জন্য চীনের মহাপ্রাচীর। ঘূর্ণিঝড়ের গতি ও জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা কমিয়ে দিয়ে সুন্দরবন আমাদের ঠিক কী পরিমাণ জীবন ও সম্পদ বাঁচিয়েছে, তা এককথায় কল্পনাতীত। ঘূর্ণিঝড়ের সময় ঢাকায় বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৭৪ কিলোমিটার আর আম্পানের সময় কলকাতায় ছিল ১১২ কিলোমিটার। সুন্দরবন না থাকলে ঢাকাতেও ১০০ কিলোমিটারের বেশি গতি নিয়ে ঝড়টি চলে আসত। আম্পান কলকাতায় যেভাবে তাণ্ডব চালিয়েছে, সুন্দরবন না থাকলে আমাদের দশা কিছুটা কলকাতার মতোই হতো।

শুধু কি ঝড়-ঝাপটা থেকেই সুন্দরবন আমাদের রক্ষা করছে? না, বরং লাখ লাখ মানুষের জীবন ও জীবিকার উৎসও এই সুন্দরবন। এ বন থেকে গোলপাতা, মধু, মাছ, কাঠ এবং অন্যান্য বনজসম্পদ সংগ্রহ করে জীবন চলে বিপুলসংখ্যক মানুষের। প্রতিবছর সুন্দরবন থেকে পর্যটন ও বন বিভাগের বিশাল অঙ্কের রাজস্ব আয় হয়ে থাকে। বাংলাদেশ জনসংখ্যার দিক থেকে অধিক ঘনত্বের একটি দেশ। আয়তনের তুলনায় জনসংখ্যা এখানে অস্বাভাবিক বেশি। আর এই বিপুল জনগোষ্ঠীর বেঁচে থাকার জন্য নিঃশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণের জন্য যে অক্সিজেন প্রয়োজন, আমাদের বায়ুমণ্ডলে তার সবচেয়ে বড় জোগানদাতা এই সুন্দরবন। পাশাপাশি মানুষ, পশুপাখি প্রশ্বাসের সঙ্গে প্রতি মুহূর্তে যে পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড বাতাসে ছাড়ছে এবং মিল-কারখানা থেকে কার্বনসহ পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর যেসব উপাদান নির্গত হচ্ছে, সেসব শোষণ করে আমাদের বায়ুমণ্ডলকে পরিশুদ্ধ করছে এই বন। এর জন্য সুন্দরবনকে বলা হয় বাংলাদেশের ফুসফুস।

সুন্দরবনের গুরুত্ব বলে বোঝানো সম্ভব নয়। কিন্তু তারপরও এর ক্ষতি করা থেকে আমারা বিরত হচ্ছি না। অবাধে গাছ কাটা, চিংড়ির ঘের দেওয়া এবং সুন্দরবনের চারপাশে অসংখ্য শিল্পকারখানা নির্মাণ করা, যা সুন্দরবনকে ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ২০১৮ সালের এক পরিসংখ্যান বলে, সুন্দরবন এলাকায় ৩২০টি শিল্পকারখানা স্থাপনের নীতিগত অনুমতি দিয়েছে জাতীয় পরিবেশ কমিটি। এর ফল এখান থেকে সৃষ্ট তেজস্ক্রিয় পদার্থ, জ্বালানি সুন্দরবনের পরিবেশকে অসুস্থ করে তুলছে। নির্বিচার বৃক্ষনিধনের ফলে সুন্দরবনের আয়তন ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার থেকে এখন ৪ হাজার বর্গ কিলোমিটারের এসে ঢেকেছে।

পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় যেখানে মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ বনাঞ্চল থাকা দরকার, সেখানে আমাদের আছে মাত্র ১০ শতাংশ। প্রতিনিয়ত এভাবে সুন্দরবনকে সংকুচিত করা হলে এই ১০ শতাংশও থাকবে না। বর্তমানে ভারতের অংশ নিয়ে সর্বমোট ছয় হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা হবে। অন্যদিকে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে নানা তর্ক-বিতর্ক হয়েছে, সচেতন নাগরিক সমাজ এর বিরুদ্ধে মানববন্ধনসহ অনেক কার্যক্রম করেছে। বিশেষজ্ঞরা এই রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হলে সুন্দরবনের কী কী ধরনের ক্ষতি হবে, তা নিয়ে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরলেও সরকার বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে বদ্ধপরিকর। ইতিমধ্যে নির্মাণকাজ প্রায় শেষের দিকে।

১৯৯৯ সালে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় সুন্দরবনের চারপাশের ১০ কিলোমিটার এলাকাকে পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করলেও তা অমান্য করে এসব শিল্পকারখানার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে বলে পরিবেশবিদেরা অভিযোগ করেছেন।

এ ছাড়া এলপিজি বোতলজাত করার কারখানার মতো মারাত্মক পরিবেশদূষণকারী শিল্পকারখানাও স্থাপন করা হচ্ছে সুন্দরবনের আশপাশে। পরিবেশবিদেরা মনে করছেন, এসব শিল্পকারখানা সুন্দরবনের পরিবেশকে ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে। জাতীয় পরিবেশ কমিটি থেকে যতই বন ও বনের প্রাণীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য শর্তের কথা বলা হোক না কেন, তাতে ধ্বংস ঠেকানো যাবে না। সুন্দরবনকে ঘিরে শিল্পকারখানা গড়ে উঠার অর্থই হচ্ছে, এর ক্ষতি সাধন করা।

সুন্দরবন মহান আল্লাহপাকের এক অপরূপ নিয়ামত আমাদের জন্য। কিন্তু আমরা নির্বিচার কীভাবে ধ্বংস করছি। ঘূর্ণিঝড়–জলোচ্ছ্বাস থেকে যেভাবে রক্ষা করছে, ঠিক তেমনি জীববৈচিত্র্য রক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা রাখছে সুন্দরবন।

সুন্দরবনকে বলা যায় আমাদের প্রাকৃতিক অক্সিজেন সিলিন্ডার। কিন্তু হায় নির্বিচার ধ্বংস করা ছাড়া আর কিছুই করছি না। মানুষের এই ধ্বংস লীলা দেখে সুন্দরবন নিশ্চয়ই বলছে ‘যখন আমি থাকব না, কী করবি রে বোকা’। কাজেই আমাদের উচিত সুন্দরবনকে রক্ষা করা। পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর বিবেচিত শিল্পকারখানাগুলোকে যদি দূরে সরিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন হয়, তাহলে সেটাই করতে হবে। অন্য জায়গায় চাইলেই আমরা একটা শিল্পকারখানা গড়ে তুলতে পারব কিন্তু চাইলেই অন্য জায়গায় একটা সুন্দরবন গড়ে তুলতে পারব না।

সুন্দরবনে সক্রিয় চোরাকারবারী, বনদস্যুদের নির্মূল করতে হবে। পাশাপাশি বনবিভাগের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধেও কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। আমরা যদি আমাদের কর্তব্য ও দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হই, তাহলে সুন্দরবন শুধু একাই ধ্বংস হবে না, বরং আমাদের ধ্বংসও অনিবার্য হয়ে উঠবে। সুতরাং নিজেদের স্বার্থের জন্য হলেও সুন্দরবনকে বাঁচতে দেওয়া উচিত।


আহমেদ জুনাইদ
শিক্ষার্থী
আনন্দমোহন কলেজ, ময়মনসিংহ
ই–মেইল: ahamedjunaeid01@gmail.com