পরিবারের সঙ্গে শহীদ ডা. শামসুদ্দীনের শেষ ছবি। ১৯৭০ সালে তোলা।
পরিবারের সঙ্গে শহীদ ডা. শামসুদ্দীনের শেষ ছবি। ১৯৭০ সালে তোলা।

শহীদ শামসুদ্দীনের জন্য যথাযথ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা প্রদানের দাবি জানাই

শহীদ শামসুদ্দীন আহমেদ সিলেটের শুধু একজন কৃতী সন্তানই নন, ষাটের দশকের সেই দুর্বার গণ-আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত তাঁর জীবনগাথা আমাদের সবার জন্য অনুকরণীয়, অনুসরণীয়। তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে তাঁর ছোট ছেলে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী প্রখ্যাত চিকিৎসক ও মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি রণাঙ্গনে অংশ নেওয়া একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. জিয়াউদ্দিনের লেখা ‘শহীদ শামসুদ্দীনের কথা কি মনে রেখেছি’ শিরোনামের লেখাটি পড়ে মনে হলো, আসলেই এ দেশের লাখ লাখ শহীদের প্রতি আমরা কি যথাযথ মর্যাদা দিতে পেরেছি, পারছি? শহীদ শামসুদ্দীনের নামে শুধু একটি পাবলিক মেডিকেল কলেজের নামকরণ করাই কি তাঁর প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধা নিবেদন?

তাঁর নিজের সন্তানের লেখায় যে তথ্য, উপাত্ত, সত্য ঘটনার বিবরণ উঠে এসেছে, তার সঙ্গে পুরো পরিবারের অভিমানের একটি সুরও প্রতিটি লাইনে প্রতিধ্বনিত হয়েছে। শহীদ শামসুদ্দীনের মতো এমন একজন শহীদকে স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও আমরা সঠিক মূল্যায়ন করতে পারিনি! কোনো রাষ্ট্রীয় পদক তো দূরের কথা!! জাতি হিসেবে অবশ্যই এ দায় আমাদের নিতে হবে।

আমার জানামতে, এই বছরের স্বাধীনতা পদকের (মরণোত্তর) জন্য কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী ড. রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার সুপারিশ ও স্বাক্ষরসহ আবেদনপত্রটি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়ে এসেছিলেন আরেকজন বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল সালাম (বীর প্রতীক)। সেটি যথাসময়ে (৩ ডিসেম্বর ২০২৩ তারিখে, স্মারক নম্বর: ১০১৬) মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে শহীদ শামসুদ্দীন আহমেদকে ‘স্বাধীনতা পদক’-এর জন্য মনোনয়ন দেওয়ার সুপারিশসহ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু তারপর কী হলো, কোনো অজ্ঞাত কারণে এত বড় একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ অধ্যাপক ডা. শামসুদ্দীন আহমেদকে স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও আমরা যথাযথ সম্মান জানাতে পারলাম না, তা বোধগম্য নয়।

ডা. জিয়াউদ্দিনের লেখায় শহীদ শামসুদ্দীন আহমেদ সম্পর্কে অনেক ব্যক্তিগত তথ্য উঠে এসেছে। আমাদের জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান সব মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের পরিবারকে আমরা সম্মান জানাই। কিন্তু শহীদ শামসুদ্দীনের ছোট ছেলে যেমন শুধু মুক্তিযুদ্ধেই অংশগ্রহণ করেননি, করোনার ভয়ানক আগ্রাসনের সময় যখন বাংলাদেশ ভ্যাকসিন সংকটে পড়েছিল, তখন যে চারজন প্রবাসী চিকিৎসক অসুস্থ মানবতার সেবায় পাঁচ মিলিয়ন ভ্যাকসিন ও সাড়ে তিন শ ভেন্টিলেটর সংগ্রহ করে দিয়েছিলেন, তিনি তাঁদেরই অন্যতম একজন।

সাক্ষাৎকারের সময় ঝানু প্রশ্নকর্তা নাহরিন আহমেদের কাছে জানতে চেয়েছিলেন গাজা, ইউক্রেন, সিরিয়ায় ভূমিকম্প, যুদ্ধ ইত্যাদি চলাকালে তিনি কেন স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে রণাঙ্গনে চিকিৎসকের দায়িত্ব পালনে আগ্রহী হলেন। তখন তিনি একটিই উত্তর দিয়েছেন, ‘আমি আমার দাদার দেখানো পথে চলতে চাই, দুস্থ মানবতার সেবা করতে চাই।’ কিন্তু আশ্চর্য হলেও সত্য, তাঁর সেই দাদাকে আজও আমরা রাষ্ট্রীয় সম্মান দিতে পারিনি!!

তেমনি শহীদ ডা. শামসুদ্দীন আহমেদের নাতনি যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী ডা. নাহরিন আহমেদ যেভাবে তাঁর পিতামহের পদাঙ্ক অনুসরণ করে যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় দীর্ঘদিন ধরে আর্তমানবতার সেবা করে চলেছেন, একজন নারী হয়েও সংঘাত-সংকুল জনপদে ছুটে বেড়িয়েছেন, বাংলাদেশ থেকে আমরা কতজন সেটা করতে পেরেছি? এমন কয়জন বাংলাদেশি আছেন, যাঁদের সেবার ব্রতকে সম্মান জানিয়ে সিবিএস, সিএসবিসির মতো আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ঘণ্টাব্যাপী সাক্ষাৎকার নিয়েছে, প্রতিবেদন করেছে।

সাক্ষাৎকারের সময় ঝানু প্রশ্নকর্তা নাহরিন আহমেদের কাছে জানতে চেয়েছিলেন গাজা, ইউক্রেন, সিরিয়ায় ভূমিকম্প, যুদ্ধ ইত্যাদি চলাকালে তিনি কেন স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে রণাঙ্গনে চিকিৎসকের দায়িত্ব পালনে আগ্রহী হলেন। তখন তিনি একটিই উত্তর দিয়েছেন, ‘আমি আমার দাদার দেখানো পথে চলতে চাই, দুস্থ মানবতার সেবা করতে চাই।’ কিন্তু আশ্চর্য হলেও সত্য, তাঁর সেই দাদাকে আজও আমরা রাষ্ট্রীয় সম্মান দিতে পারিনি!!

যে মানুষ স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিলেন, সেই মহামানবের আদর্শের আলোকবর্তিকা তাঁর পরিবারও বহন করে চলেছে। এমন উদাহরণ এখন তেমন দেখতে পাই না। তাই শহীদ শামসুদ্দীনের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর পরিবারকেও সশ্রদ্ধ সালাম জানাই।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বুকে ধারণ করা এ দেশের একজন নাগরিক হিসেবে শহীদ অধ্যাপক ডা. শামসুদ্দীন আহমেদের জন্য যথাযথ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা প্রদানের দাবি জানাই।

রাশেদা কে চৌধূরী
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা