‘পর্যটনশিল্প-ব্যবসা থেকে কীভাবে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা যায়, তা কড়ায়–গন্ডায় কাজে লাগায় মালদ্বীপ।’
‘পর্যটনশিল্প-ব্যবসা থেকে কীভাবে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা যায়, তা কড়ায়–গন্ডায় কাজে লাগায় মালদ্বীপ।’

মালদ্বীপ ভ্রমণের কেচ্ছা-কাহিনি

আপনার ভ্রমণতালিকার শীর্ষে মালদ্বীপকে রাখুন। আমি নিশ্চিত, ভ্রমণ শেষে আপনি আমাকে পরামর্শের জন্য ধন্যবাদ জানাবেন। পাঠক, এটি আমার কথা নয়। গত ২৭ মে ‘মালদ্বীপের রাজনীতি ও উন্নয়ন যে পথে যাচ্ছে’ শীর্ষক শিরোনামে মতামত কলামে মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের অত্যন্ত সুপাঠ্য ও চমৎকার তথ্যসংবলিত লেখার শেষ কয়েকটি লাইন।

বিশ্বের ধনাঢ্য ব্যক্তিদের কাছে অন্যতম অবকাশযাপনের জায়গা মালদ্বীপ। সবকিছুই আমদানিনির্ভর মালদ্বীপ কোনো সস্তা পর্যটন গন্তব্য নয়। এর ঠিক এক সপ্তাহ আগে ‘প্রকৃতি ও সমুদ্রনির্ভর মালদ্বীপ যেভাবে আমাদের চেয়ে এগিয়ে’ শিরোনামে আরেকটি চমৎকার লেখায় যেসব তথ্য উন্মোচন করেছেন, তাতে সব পাঠকের মনেই মালদ্বীপ ভ্রমণের ইচ্ছা জাগবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

সত্যি কথা হলো একসময়  মালদ্বীপ ভ্রমণ ছিল মিলিয়নিয়ার বা কোটিপতিদের পছন্দের তালিকার শীর্ষ একটি নাম। সম্ভবত করোনা মহামারির কারণেই আমাদের দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর ভ্রমণপিপাসুদের জন্য মালদ্বীপ কিছুটা সহজলভ্য হয়ে উঠেছে।

করোনা মহামারি শেষে ২০২২ সালের আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ে পাঁচ দিনের মালদ্বীপ ভ্রমণকালে বুঝতে পেরেছি একটি দেশ পর্যটনশিল্পকে কীভাবে কাজে লাগিয়ে পরিকল্পনামাফিক বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারে। প্রথমেই বলে রাখি, প্রাকৃতিক নৈসর্গের সঙ্গে সমুদ্রের পানি এত স্বচ্ছ ও পরিষ্কার থাকতে পারে, তা মালদ্বীপ ভ্রমণের আগে জানা ছিল না। নৈসর্গিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি সব মিলিয়ে মালদ্বীপ গিয়ে যে কেউ বুঝতে পারবেন ভ্রমণের জন্য এর চেয়ে নিরাপদ ও প্রশান্তির জায়গা আশপাশে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া কঠিন।

যাহোক ফিরে আসি মূল প্রসঙ্গে। করোনাকালের বিষণ্নতা কাটিয়ে ওঠার লক্ষ্যেই আমাদের মালদ্বীপ ভ্রমণ। তাই দুই বছর আগে মালদ্বীপ ভ্রমণের অভিজ্ঞতার কিছু তথ্য তুলে ধরছি। পাঁচ দিন চার রাতের প্যাকেজ নিয়ে মালদ্বীপ ভ্রমণে গিয়ে জানতে পারি, করোনা মহামারি মালদ্বীপের জন্য ততটা ভয়ংকর রূপ ধারণ করেনি বটে। কিন্তু করোনার কারণে সারা বিশ্বের সঙ্গে মালদ্বীপের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় তাদের শত শত হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট-ভিলাসহ ভ্রমণবিষয়ক অসংখ্য প্রতিষ্ঠান চরম বিপর্যয়ের মুখে পতিত হয়।

২০২১ সালের শেষে তাদের সরকারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পর্যটনশিল্পের হারানো ব্যবসা কীভাবে দ্রুত ফিরিয়ে আনা যায়, সেই লক্ষ্যে নানা পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে আসে। সরকারিভাবে অনেক ছাড় দেওয়াসহ নানা রকম প্রণোদনা দিয়ে এগিয়ে আসার কারণে ক্রমেই ফিরে আসে তাদের সেই রমরমা পর্যটন ব্যবসা। এর সঙ্গে আমাদের দেশের পর্যটকদের জন্য মালদ্বীপ ভ্রমণ অনেকটা সহজ হয়ে ওঠে দেশের একটি বেসরকারি এয়ারলাইনসের উদ্যোগে সাশ্রয়ী মূল্যের প্যাকেজ নিয়ে এগিয়ে আসায়।

রিটার্ন টিকিট ক্রয় করলেই মালদ্বীপে তিন দিন দুই রাত বুফে ব্রেকফাস্টসহ হোটেলে থাকা ফ্রি। মাফুশি আইল্যান্ডের থ্রি স্টার বা ফোর স্টার হোটেলের জন্য প্যাকেজ মূল্য ছিল ৪৬ হাজার টাকা। এর সঙ্গে কেউ চাইলে প্যাকেজের সঙ্গে নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী বাড়তি হোটেল ভাড়া দিয়ে বেশি দিন থাকার সুযোগও ছিল। আমার জানামতে, এ ধরনের প্যাকেজ বর্তমানেও চালু আছে। তবে ডলারের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় তাদের এই প্যাকেজের মূল্যও অনেক বেড়ে গেছে।

সাধারণত অন্যান্য দেশে প্যাকেজ নিয়ে ভ্রমণে গেলে নানা রকম অভিযোগ শোনা গেলেও মালদ্বীপে এ রকম কোনো অভিযোগ শুনিনি বা দেখিনি। দালাল বা কারও খপ্পরেও পড়তে দেখিনি। অন অ্যারাইভাল ভিসার জন্য যাত্রার দু–এক দিন আগে অনলাইনে ইমুগা নামের ওয়েবসাইটে যাত্রীর তথ্য দিলে যে কিউআরকোড পাওয়া যায়, তা মোবাইলে বা প্রিন্ট কপি দেখালে কয়েক মিনিটের মধ্যেই মালে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন শেষ। বাইরে বের হলেই দেখা মিলবে হোটেল-মোটেলের প্রতিনিধিরা প্ল্যাকার্ড হাতে পর্যটকদের অভ্যর্থনা জানানোর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন।

স্বল্প সময়ের মধ্যে সবকিছু বুঝে নিয়ে বিমানবন্দরের লাগোয়া জেটি থেকে অত্যাধুনিক স্পিড বোর্ডে করে পর্যটকদের জন্য নির্ধারিত হোটেলে পৌঁছাতে সময় লাগে সর্বোচ্চ ৩০–৩৫ মিনিট। এমনকি লাগেজ নিয়ে চিন্তা করার প্রয়োজন পড়ে না। লাগেজ ও মালামাল পর্যটকেরা হোটেল পৌঁছানের আগেই সেখানে পৌঁছে যায় তাদের তত্ত্বাবধানেই। আমি সপরিবার যখন মালদ্বীপ ভ্রমণ করেছি, তখন ব্যাংক ও খোলাবাজারে ডলারের মূল্য ছিল যথাক্রমে ১০৪ ও ১১২ টাকা করে। মালদ্বীপের তাদের মুদ্রা রুফিয়ার চেয়ে ডলারেই লেনদেন বেশি। ভ্রমণ শেষে হাতে রুফিয়া থেকে গেলে বিমানবন্দরে আসার আগে খরচ করে নেওয়া বা বদল করে নেওয়াই শ্রেয়। কেননা বিমানবন্দরে কেনাকাটা করতে হলে রুফিয়ার চেয়ে ডলার বেশি চলে।

পর্যটনশিল্প-ব্যবসা থেকে কীভাবে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা যায়, তা কড়ায়–গন্ডায় কাজে লাগায় মালদ্বীপ। সেখানে রয়েছে নানা রকম ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিসহ অনেক প্রতিষ্ঠান, যাদের মাধ্যমে গভীর সমুদ্রে গিয়ে হাঙরের সঙ্গে সাঁতার, স্টিং-রে বা শাপলাপাতা মাছ ও ডলফিনের সঙ্গে খেলা, সমুদ্রের তলদেশে প্রবাল দেখা, প্যারাস্যাইলিং, স্কুবা ডাইভিংসহ আরও অনেক ইভেন্টের প্যাকেজ, যা শতভাগ নিরাপদ ও ঝুঁকিমুক্ত। ভাগ্য ভালো থাকলে এসব ইভেন্টে অংশ নেওয়ার জন্য যাত্রাপথে বিশাল তিমিরও দেখা মিলতে পারে। জনপ্রতি ৪০–৪৫ ডলার প্যাকেজ মূল্যের এসব ইভেন্টে গভীর সাগরে যাওয়া-আসা, লাঞ্চসহ প্রয়োজনীয় সবকিছুই অন্তর্ভুক্ত।

দিন-রাতে সমানভাবে ঘুরতে পারবেন চারদিকে। কোনো পুলিশ চোখে পড়বে না। কিন্তু কোনো রকম ঝুঁকি নেই। শতভাগ মুসলিম রাষ্ট্র হওয়ায় নামাজের জন্য আজান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দোকানপাটের কেনাবেচা বন্ধ হয়ে যায়।

পর্যটকদের কেউ ভিআইপি, প্রভাবশালী হোক না কেন, ক্ষমতার দাপট দেখানোর সুযোগ নেই। সবকিছু চলে আইন মেনে। এককথায় সবকিছুই যেন নীল জলরাশির মতো স্বচ্ছ। পর্যটকদের কেউ যদি হার্ড ড্রিংকস পান করতে আগ্রহী হন, সে জন্যও রয়েছে পৃথক নিয়মনীতি। আইল্যান্ডের কোনো হোটেল-মোটেলে বসে হার্ড ড্রিংকস পান করা যাবে না। সে জন্য নির্ধারিত সময় ও নিয়মকানুন মেনে যেতে হবে সাগরের মাঝখানে রাখা নির্দিষ্ট জাহাজে।

ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের অন্যতম ট্যুরিস্ট স্পট মালদ্বীপ কোনো সস্তা পর্যটন গন্তব্য নয় এটা ঠিক। তাই দুই বছর আগে ভ্রমণ করা মালদ্বীপের খরচের কিছু তথ্য এখানে তুলে ধরছি। থ্রিস্টার-ফোরস্টার হোটেলগুলোতে হাফ লিটার এক বোতল পানির দাম মানভেদে এক থেকে তিন-চার ডলার। আবার আশপাশে স্থানীয় লোকজনের দোকানে ১৫ রুফিয়া বা এক থেকে তিন ডলারে পাওয়া যায় পাঁচ লিটারের সাশ্রয়ী বোতল।

আমাদের ভ্রমণের সময় দেখেছি একটি ডাবের মূল্য পাঁচ–ছয় ডলার—এটা আমাদের জন্য রীতিমতো দুঃস্বপ্ন মনে হলেও ইউরোপীয়ান বা আমেরিকানদের কাছে ছিল হট ফেভারিট। তাই পানির বদলে ডাবের পানিতেই তাদের আকর্ষণ ছিল বেশি। বিমানবন্দর থেকে শুরু করে হোটেল-মোটেল–রেস্টুরেন্ট ও দোকানপাটে বাংলাদেশি ভাইদের অবাধ বিচরণ। রয়েছে প্রচুর বাংলাদেশি খাবারের দোকান ও রেস্টুরেন্ট—যেখানে সাশ্রয়ী মূল্যে ভালো খাবার পাওয়া যায়। তাই চলাফেরা কেনাকাটা কোনো কিছুতেই ঠগবাজের খপ্পরে পড়ার ভয় নেই কঠিন আইনকানুনের কারণে। মালদ্বীপ ও আমাদের সন্দীপের ভূমির পরিমাণ যথাক্রমে ২৯৮ ও ৭৬২ বর্গকিলোমিটার। প্রকৃতি ও সমুদ্রের নোনা পানিই মালদ্বীপের সম্পদ। তাদের মোট উৎপাদনের ২৮ শতাংশ ও বৈদেশিক মুদ্রা প্রাপ্তির ৬০ শতাংশ আসে পর্যটন খাত থেকে। পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ খাত মৎস্য সম্পদ।

অথচ এ সবই আমাদের  দেশেরও রয়েছে। তা হলে মালদ্বীপ উচ্চমধ্যম আয়, উচ্চ মানব উন্নয়ন সূচক ও কম আয়বৈষম্যের দেশে পরিণত হতে পারলে আমাদের বাংলাদেশের অক্ষমতা কোথায়—সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সেটাই ভেবে দেখা উচিত নয় কি?

নাসিমুল কবির ব্যাংক কর্মকর্তা