কক্সবাজারের পথে ট্রেন
কক্সবাজারের পথে ট্রেন

কক্সবাজারের ট্রেন: ২৫০টি টিকিট কীভাবে ২ মিনিটেই শেষ!

পর্যটনকেন্দ্র কক্সবাজার। এর আগে–পিছে অনেক বিশেষণ লাগানো যায়। গুগলের ভান্ডারে থাকা তথ্যের প্রথম পাঁচ লাইন এখানে হুবহু তুলে ধরছি, যা দেখলে কিছুটা আতঁকেও উঠতে হয়।

‘কক্সবাজার দক্ষিণ-পূর্ব বাংলাদেশের একটি শহর, মাছ ধরার বন্দর, দেশের একটি জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র ও জেলা সদর। এটি বেশির ভাগই তার দীর্ঘ প্রাকৃতিক বালুকাময় সৈকতের জন্য বিখ্যাত এবং এটি বিশ্বের বৃহত্তম শরণার্থীশিবিরের জন্য কুখ্যাত।’

অনেক বছর আগে যখন কক্সবাজারে গিয়েছিলাম, তখন সেখানে হোটেল–মোটেল, বহুতল ভবন ছিল না। কিন্তু পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে আলাদা আকর্ষণ ছিল। পরবর্তীতে ব্যাপক পরিবেশ ধ্বংসের কারণে অনেকে এখন আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। এরপরেও লম্বা ছুটিতে বিকল্প সমুদ্রসৈকত না থাকায় অনেকে কক্সবাজারে যান। কুয়াকাটাকে পর্যটনকেন্দ্র ঘোষণা করা হলেও সেখানে পর্যটকদের থাকা ও ভ্রমণের সুযোগ কম।

এখন প্রতিদিন ইউটিউবে কক্সবাজার নিয়ে অনেক ভিডিও আপলোড হতে দেখা যাচ্ছে। সম্প্রতি রাজধানীর সঙ্গে সরাসরি ট্রেন যোগাযোগ স্থাপিত হওয়ায় পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে কক্সবাজারের আর্কষণ আরও বেড়েছে সন্দেহ নেই। ইউটিউবে অনেক ভিডিওতে দেখা যায় কক্সবাজারের ট্রেন ভ্রমণ ও সদ্য নির্মিত রেলস্টেশনের আইকনিক দৃশ্যের বর্ণনা। কক্সবাজার ভ্রমণের জন্য অনলাইনে টিকিট করার নিয়মকানুন, হোটেলসংক্রান্ত রিভিউ ও ট্রেনের খাবারের গল্প নিয়ে ইউটিউবে ভিডিওতে সয়লাব। কক্সবাজারে নতুন কোনো দৃষ্টিনন্দন বা আর্কষণীয় স্পট তৈরি হয়েছে কি না, তার কোনো তথ্যই এসব ভিডিওতে নেই।

অনলাইনে ট্রেনের টিকিট করাটা প্রায় অসাধ্য। টিকিট নিয়ে চলছে কালোবাজারি। একটি পত্রিকা শিরোনাম করেছে, ‘সিন্ডিকেটে জিম্মি রেলের টিকিট, নাটের গুরু বুকিং সহকারীরা।’ অথচ প্রায় সময় এমনটি প্রচার হতে দেখা যায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে কালোবাজারি ও ট্রেনের টিকিট সিন্ডিকেটের লোকজন ধরা পড়ছেন।

আমরা পরিবারের সদস্যেরা ভাবলাম, শীতের শেষ সময়ে কক্সবাজারকে ফিরে দেখা মন্দ নয়। তাই অনলাইনে টিকিট করার কাজে নেমে পড়ি ৮–১০ দিন আগে থেকেই। আমাদের ইচ্ছা ছিল কক্সবাজার এক্সপ্রেসে ২১ তারিখ রাতে ঢাকা থেকে রওনা দিয়ে ২৪ তারিখ দুপুরে কক্সবাজার ছেড়ে আসা। টিকিট করতে গিয়ে যেন কোনো ভুলত্রুটি না হয়, সে জন্য কয়েক দিন আগে থেকেই ট্রায়াল দিয়েছিলাম অনলাইন টিকিট করা নিয়ে। কিন্তু বিধিবাম, শুরুতেই এমন হোঁচট খেতে হবে, তা ভাবতে পারিনি।

রেলওয়ের নিয়ম অনুযায়ী, ২১ তারিখের টিকিট করা যাবে ১০ দিন আগে, অর্থাৎ ১১ তারিখ। কোনোভাবেই যেন টিকিট হাতছাড়া না হয়, সে জন্য ভোরে ঘুম থেকে উঠে আটটা বাজার এক ঘণ্টা আগেই বসে পড়ি অনলাইনে টিকিট করার কাজে। নিজের এনআইডি দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করা রেলওয়ের ভেরিফায়েড অ্যাপসের মাধ্যমে টিকিট করতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতার সাক্ষী হলাম, তা রীতিমতো ভয়ংকর।

ইউটিউবার ভাইদের পরামর্শ মেনে টিকিট বিক্রি শুরু হওয়ার ৪০ মিনিট আগেই প্রস্তুত হয়ে থাকি টিকিটের জন্য। টিকিট বিক্রি শুরু হওয়ার আগে দেখা গেল, আমার কাঙ্ক্ষিত শ্রেণির টিকিট রয়েছে ২৫০টি। ঠিক সকাল আটটায় বিক্রি শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সবই শেষ। মাত্র দুই মিনিটের কম সময়ে সব টিকিট হাওয়া হয়ে গেছে। তার পরও আশায় বুক বেঁধে আধা ঘণ্টার নিরলস প্রচেষ্টা। যা হওয়ার তাই হলো। অগ্যতা কক্সবাজার যাওয়ার চিন্তা বাদ দিলাম।

কক্সবাজার ভ্রমণের জন্য রেলের অনলাইন টিকিট নিয়ে যে অরাজকতা চলছে, তা থামানো দরকার। এ অবস্থা চলতে থাকলে বিদেশিরা দূরে থাক, দেশীয় পর্যটকও হতাশায় মুখ ফিরিয়ে নেবেন।কয়েক দিন আগে চোখে পড়ল একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের খবর, যে কারণে বাংলাদেশি পর্যটক যাচ্ছে প্রতিবেশী দেশে। সিলেট, পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও সুন্দরবনের মতো অনেক আর্কষণীয় জায়গা থাকার পরও বাংলাদেশ খুব বেশি পর্যটক টানতে পারছে না। বরং এই অঞ্চলে ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভুটান, মালদ্বীপ, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া ঘুরতেই পছন্দ করেন বেশির ভাগ পর্যটক। খরচের কথা বাদ দিলেও আমাদের দেশের পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে যাওয়া-আসার জন্য যে কঠিন লড়াই করতে হয়, তা আশপাশের দেশে নেই।

পর্যটনশিল্প নিয়ে সরকারি পর্যটন কর্তৃপক্ষের অবস্থা কী, তা বোঝা যায় প্রথম আলো পত্রিকার ১৫ ফেব্রুয়ারির একটি খবর থেকেই। ‘জরাজীর্ণ সিলেট পর্যটন মোটেলে আগ্রহ নেই অতিথিদের’ শীর্ষক খবরে জানা যায়, চায়ের দেশে বেড়াতে আসা পর্যটক-দর্শনার্থীদের জন্য তিন দশক আগে সিলেটের বিমানবন্দর এলাকায় গড়ে তোলা হয় পর্যটন মোটেল। প্রায় ৪১ একর জমির ওপর বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন নির্মিত মোটেলের সঙ্গেই রয়েছে রেস্তোরাঁ ও উদ্যান। একসময়ের পর্যটকের ঢলনামা মোটেলটি এখন অতিথিসংকটে ভুগছে জরাজীর্ণ অবকাঠামোর কারণে। আমাদের কাঙ্ক্ষিত কক্সবাজার ভ্রমণের জন্য শত চেষ্টা করে অনলাইনে টিকিট না পেয়ে হতাশ হয়েছি বটে। কিন্তু দেশের পর্যটন খাত নিয়ে ভাবার অনেকে থাকলেও আসলে কেউ যে ভাবছে না, সেটি ভাবতে গেলে হতাশা আরও বেড়ে যায়।

  • নাসিমুল কবির অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা