ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার নিয়ে জগাখিচুরি কাণ্ড

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার নিয়ে অনেক ঘটনাই সম্প্রতি চোখে পড়ল—গ্রন্থাগারে নিয়মিত শিক্ষার্থীদের নিয়ে কমিটি গঠন, সেই কমিটির কার্যকলাপ নিয়ে সমালোচনা, শৌচাগারে লাইনে দাঁড়ানো নিয়ে মারামারি করে একজন আরেকজনের নাক ফাটিয়ে দেওয়া, একজন গ্রন্থাগারে এসে কতজনের জন্য জায়গা রাখতে পারবে, গ্রন্থাগারে ঢুকে কত মিনিটের অধিক বাইরে থাকলে সিট বেদখল হবে, বইপত্রবিহীন শপিং ব্যাগ দিয়ে ভোরবেলা গ্রন্থাগারে লাইনে সিরিয়াল দেওয়া যাবে কি না ইত্যাদি বিষয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলাম ২০১৫ সালে। অর্থাৎ এখন থেকে ৮ বছর আগে। তখন দেখেছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে ঢোকার জন্য লাইনে দাঁড়াতে হয়। লাইনের দৈর্ঘ্য এখন আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে।

মল চত্বরে কী দিয়ে কী করা হচ্ছে, তা শিক্ষার্থীদের বোধগম্য নয়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বিনষ্ট করে কিছু কংক্রিটের স্থাপনা করা হচ্ছে। কর্মচারীদের জন্য বহুতল ভবন উঠল। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল উদ্দেশ্য পড়াশোনা, তার জন্য এখন অবধি গ্রন্থাগার সংস্কার এবং সম্প্রসারণের জন্য হাত দেওয়া হলো না।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার উপযুক্ত ও মানসম্মত পরিবেশ নিশ্চিত করতে মাস্টারপ্ল্যান নেওয়া হয়েছে।

সবকিছু পরিকল্পনায় রাখলে হয় না, কিছু বিষয়ে জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিতে হয়; প্রয়োজনে ঋণ করে হলেও। আমার কাছে দেশের লাখো কোটি টাকার বাকি আর দশটা প্রকল্পের চেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্ব আমাদের জাতীয় জীবনে অনেক বেশি। সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হলো কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার। বলা যায় পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণকেন্দ্র। সেই গ্রন্থাগারের এই অমানবিক অবস্থা দেখে কারও ভালো লাগার কথা নয়।

প্রথম আলো, ডেইলি স্টারসহ দেশের অন্যান্য জাতীয় দৈনিকে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে প্রবেশের জন্য লম্বা লাইন এবং হুড়োহুড়ির ছবি দেখতে আপনাদের কেমন লাগে? অনেকের হয়তো শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ এবং এর জন্য ভোরবেলা গিয়ে লাইনে দাঁড়ানোর মতো ত্যাগের কথা ভেবে ভালো লাগতে পারে। কিন্তু এটা আসলে আমাদের জাতির জন্য একটা লজ্জার বিষয়ও বটে।

এত কোটি টাকা দিয়ে চারপাশের এত কিছু বাস্তবায়িত হচ্ছে আর দেশের সর্ববৃহৎ এবং সবচেয়ে বেশি পাঠকসমৃদ্ধ গ্রন্থাগার সংস্কারে হাত দিতে পারলাম না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান গ্রন্থাগারের বারান্দায় অনেকে পাটি কিংবা ছোট টুলের ওপরও অনেকে পড়াশোনা করেন। একটা নির্দিষ্ট জায়গায় যতজনের বসে পড়ার কথা এবং স্বাস্থ্যসম্মত তার চেয়ে বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থী বলতে গেলে গাদাগাদি করে বসে পড়াশোনা করেন।

২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসের শেষ দিক দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার ও বিজ্ঞান গ্রন্থাগারে রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি আইডেন্টিফিকেশন (আরএফআইডি) গেট বা ই-গেট স্থাপন করবে বলে জানিয়েছে (কালের কণ্ঠ, ১১ ডিসেম্বর-২০২৩)। এই গেট স্থাপনের মাধ্যমে ছাত্রত্ব শেষ—এমন শিক্ষার্থী ও বহিরাগত শিক্ষার্থীরা এখানে পড়াশোনার জন্য ঢুকতে পারবেন না।

এ পদক্ষেপকে গ্রন্থাগারের যে রোগ, তার প্রাথমিক চিকিৎসার সঙ্গে তুলনা করা যায়। প্রাথমিক চিকিৎসার পর রোগীকে দ্রুত পরিপূর্ণ চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। তেমনি শিক্ষার্থীদের পড়ার জায়গার সংকট দূর করার জন্য দীর্ঘমেয়াদি এবং স্থায়ী সমাধানের বিষয়েও পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি প্রয়োজন। অন্যথায় প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে এ সমস্যার প্রকৃত সমাধান হবে না।

গ্রন্থাগার পড়ার জায়গায়। সুতরাং এখানে পড়াশোনা করার অধিকার যে কেউ রাখেন। পড়াশোনা এবং জ্ঞানচর্চা যত প্রসার ঘটবে, তা ততই দেশের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে। যত মানুষ গ্রন্থাগারের সংস্পর্শে আসবেন, তাঁরা এখান থেকে সমৃদ্ধ হবেন। এ জন্য অনেক মানুষ ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারে অন্যদের প্রবেশাধিকার দেন, পড়ার জন্য বই দেন।

একটা গ্রন্থাগারের প্রকৃতিই হচ্ছে এটা উন্মুক্ত; এর কর্ম প্রসারণশীল এবং মানুষকে পড়াশোনায় উদ্বুদ্ধ করা। যদি কোথাও বহিরাগত নিয়ন্ত্রণের দরকার হয়, তাহলে সেটা কেবল নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা রক্ষার জন্যই করা যেতে পারে। সুতরাং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার ও বিজ্ঞান গ্রন্থাগারে কেবল ই-গেট স্থাপন কোনো স্থায়ী এবং যুগোপযোগী সমাধান নয়; এর জন্য গ্রন্থাগার সম্প্রসারণ করার উদ্যোগ নিতে হবে।

হলগুলোয় যে রিডিং রুম আছে, তাতে সবার পড়ার জায়গার সংকুলান হয় না। নিজেদের রুমেও পড়াশোনার পরিবেশ নেই। এরূপ পরিস্থিতিতে মেধাবী শিক্ষার্থীরা কোথায় যাবেন? যে ছেলে গণরুমে রাত কাটান, তাঁকে তো ঘুমের জন্যই সংগ্রাম করতে হয়। ঘুম থেকে উঠে যদি আবার তাঁকে পড়ার জন্য একটা সিট পেতে যুদ্ধ করতে হয়, তাহলে এই শিক্ষার্থীর সামনে কর্তৃপক্ষের মুখ দেখানোই উচিত নয়।

একটি সমৃদ্ধ বইয়ের চেয়ে এক প্লেট কাচ্চির গুরুত্ব আমাদের কাছে অনেক বেশি, গ্রন্থাগারের চেয়ে একটা আড্ডাখানা স্থাপন অগ্রাধিকার পাচ্ছে, কলমের চেয়ে ডান্ডার চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রথম আলোর বিভিন্ন সময়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশের অনেক লাইব্রেরি পাঠকের অভাবে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। রাজধানীর নিউমার্কেটে ১৯৬৩ সালে প্রতিষ্ঠিত একসময়ের নামকরা ‘জিনাত বুক’ ২০২৩ সালে এসে বই বিক্রির অভাবে বন্ধ হয়ে যায় (সূত্র: প্রথম আলো, ১৭ এপ্রিল, ২০২৩)।

দেশে শিক্ষার হার বেড়েছে, আনাচকানাচে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, তারপরও কীভাবে একটা দোকান বন্ধ হয়ে যায় বিক্রির অভাবে? পাঠকের সংখ্যা না কমলে এ রকম হওয়ার কথা নয়। রাইজিং বিডির ২০১৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারির একটা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ‘ঢাকার ৯৩টি ওয়ার্ডে ৬৮টিতে কোনো পাঠাগার নেই। একটি ওয়ার্ডে দুটিসহ ২২টি ওয়ার্ডে যে ২৩টি পাঠাগার রয়েছে, তার অধিকাংশই বন্ধ থাকে। এসব পাঠাগারে ন্যূনতম পাঠের পরিবেশ নেই।’

ঢাকা শহরের সবচেয়ে পুরোনো গ্রন্থাগারের একটি ‘রামমোহন রায় লাইব্রেরি’। এর মূল ভবন বর্তমানে পরিত্যক্ত (দ্য ডেইলি স্টার, ১৪ নভেম্বর ২০২১)। এ গ্রন্থাগারও যেন পাঠকের দেখা পায় না আগের মতো। বইগুলোর অবস্থাও জরাজীর্ণ।

শুনলাম, বেইলি রোডের বিখ্যাত বইয়ের দোকান ‘সাগর পাবলিশার্স’ও নাকি বন্ধ হওয়ার পথে। অথচ একসময় জায়গাটি ছিল বুদ্ধিজীবীদের আড্ডাখানা। শিক্ষার হার বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তো বই পড়ার হারও বৃদ্ধি পাওয়ার কথা। কিন্তু তা হচ্ছে না। উল্টো নামীদামি লাইব্রেরিগুলো আস্তে আস্তে বন্ধ হওয়ার পথে। এর অর্থ হচ্ছে আমাদের দেশে সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি পেলেও প্রকৃত শিক্ষার প্রসার হচ্ছে না।

অভিযোগ শোনা যায় যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে শিক্ষার্থীরা চাকরির পড়াশোনা করেন। শিক্ষিত বেকারের হার যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতে চাকরির পড়াশোনার প্রতি শিক্ষার্থীদের ঝোঁক বেশি থাকবে—এটাই স্বাভাবিক। গ্রন্থাগারে গিয়ে সবাই পড়াশোনা করছেন—এটাই বিবেচ্য। সাহিত্য পড়ছেন, গবেষণা করছেন, নাকি সাধারণ জ্ঞান পড়ছেন, সেটা ভিন্ন আলাপ। সাহিত্য, ইতিহাস, রাজনীতি পড়ার জন্য শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে, গবেষণার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। অন্যথায় শুধু উপদেশ আর সমালোচনা করে কাউকে এই পথে আনা যাবে না।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘লাইব্রেরি’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘লাইব্রেরির মধ্যে আমরা সহস্র পথের চৌমাথার উপরে দাঁড়াইয়া আছি। কোনো পথ অনন্ত সমুদ্রে গিয়াছে, কোনো পথ অনন্ত শিখরে উঠিয়াছে, কোনো পথ মানব-হৃদয়ের অতলস্পর্শে নামিয়াছে। যে যে-দিকে ধাবমান হও, কোথাও বাধা পাইবে না।’

বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে বলতে হয়, বিশ্বকবি কি জানতেন, আমরা গ্রন্থাগারে ঢুকতেই বাঁধার সম্মুখীন হব, গ্রন্থাগারে প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত করা হবে, রাতদুপুরে গিয়ে গ্রন্থাগারে সামনে সিরিয়াল দিতে হবে, সকালবেলা ধাক্কাধাক্কি করে গ্রন্থাগারে ঢুকে একটা সিটের জন্য কাড়াকাড়ি করতে হবে, সিট থেকে দাঁড়ালেই আরেকজন সিট দখল করে ফেলবেন—এই ভয় নিয়ে থাকতে হবে, গ্রন্থাগারে জায়গা না পেয়ে দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে শিক্ষার্থীরা ফিরে যাবেন কিংবা পাঠকের অভাবেই অনেক লাইব্রেরি বন্ধ হয়ে যাবে।

তালহা মুহাম্মদ
সহকারী জজ, বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস