ভূমিকম্প: বাংলাদেশের জন্য অশনিসংকেত

গত ৬ ফেব্রুয়ারি তুরস্ক ও সিরিয়ার সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলো কেঁপে ওঠে স্মরণকালের ভয়াবহ ভূমিকম্পে।  রিখটার স্কেলে যার মাত্রা ছিল ৭.৮। বিধ্বংসী এ ভূমিকম্পের ১২ ঘণ্টা অতিক্রান্ত হতে না হতেই একই অঞ্চলে ৭.৬ মাত্রার আরেকটি ভূমিকম্প আঘাত হানে। এই ভূমিকম্পে দুটি দেশের কয়েক হাজার ভবন ধসে পড়েছিল। নিহতের সংখ্যা ৪০ হাজারের বেশি। অনেকে এখনো নিখোঁজ। এ ছাড়া ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছেন লাখ লাখ মানুষ। আর প্রলয়ংকারী এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিভীষিকাময় আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছে পুরো বিশ্ববাসীর মনে। ভূমিকম্পপ্রবণ দেশগুলো নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন।

সাধারণত ভূ-অভ্যন্তরে যখন একটি শিলা অপর একটি শিলার উপর উঠে আসে তখন ভূমি কম্পিত হয়, যেটি ভূমিকম্প নামে পরিচিত। সারা বিশ্বে বছরে গড়ে প্রায় ছয় হাজারের অধিক ভূমিকম্প সংঘটিত হয়। এগুলোর বেশির ভাগই মৃদু ধরনের , যেকারণে তা খুব বেশি টের পাওয়া যায় না।

ভূমিকম্পের স্থায়িত্ব সাধারণত কয়েক সেকেন্ড হয়ে থাকে। কিন্তু এই কয়েক সেকেন্ডের স্থায়ীত্ব প্রচণ্ড তাণ্ডবলীলা চালিয়ে লন্ডভন্ড করে দিতে পারে সবকিছু । ভূমিকম্পের মাত্রার উপর ক্ষয়-ক্ষতি ও প্রাণহানির পরিমাণ নির্ভর করে। ভূমিকম্পের মাত্রা ৫ থেকে ৫.৯৯ হলে মাঝারি, ৬ থেকে ৬.৯৯ হলে তীব্র, ৭ থেকে ৭.৯৯ হলে ভয়াবহ এবং ৮ এর উপরে হলে অত্যন্ত ভয়াবহ হয়ে থাকে।

সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন দেশের ভূমিকম্পের ভয়াবহতা এবং বাংলাদেশের ভূমিকম্পের অধিক ঝুঁকি প্রবণতা এখন সকল নাগরিকের চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত ১৫ বছরে ছোট-বড় ভূমিকম্পে ১৪২ বার কেঁপে উঠেছে বাংলাদেশ। ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক ভূমিকম্প নিয়ে গবেষণা করেন এবং তাদের গবেষণাটি নেচার জিওসায়েন্স সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত এ প্রতিবেদন হতে জানা যায় যে, বাংলাদেশ ও ভারতের পূর্বাঞ্চল এবং মিয়ানমারের কিছু অংশে প্রচণ্ড শক্তিশালী একটি ভূমিকম্প হতে পারে। রিখটার স্কেলে যার মাত্রা হতে পারে ৮.২ হতে ৯। প্রায় ২৪ হাজার বর্গকিলোমিটার জুড়ে এ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাটি বিস্তৃত। এতে প্রায় ১৪ কোটি মানুষের জীবন বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়াও  ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে গ্লোবাল আর্থকোয়েক মডেল এ প্রকাশিত একটি গবেষণার প্রতিবেদন হতে জানা যায় যে, বাংলাদেশের উত্তরে ভুটান সীমান্তে ২৫ কিলোমিটার লম্বা একটি ফাটলরেখা রয়েছে। এ ফাটলরেখাতে যেকোনো সময় ৮ থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে।

অন্যদিকে, ২০০৯ সালে সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি ( সিডিএমপি ) ও জাইকার যৌথ জরিপে জানা গেছে,  ঢাকায় সাত বা তার বেশি মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হলে  ৭২ হাজার ভবন ভেঙে পড়বে এবং ১ লাখ ৩৫ হাজার ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তৈরি হবে সাত কোটি টন কংক্রিটের স্তূপ।

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স এর তথ্যমতে, ঢাকা শহরের ৭৬ শতাংশ রাস্তা সরু হওয়ায় ভূমিকম্প হলে উদ্ধার কার্যক্রম চালানো জটিল আকার ধারণ করবে। বাংলাদেশে জনবসতি একটি বড় সমস্যা। বিপুলসংখ্যক জনগণের বাসস্থানের চাহিদার জন্য হাজার হাজার বহুতল ভবন গড়ে উঠেছে, যেগুলোর অনেক কোনো ধরনের বিল্ডিং কোড না মেনেই নির্মাণ করা হয়েছে। উল্লেখ্য যে, ভূমিকম্পে ৯০ শতাংশ প্রাণহানির ঘটনা ঘটে ভবন ধসের কারণে। সেই সঙ্গে গ্যাস ও  বিদ্যুৎ লাইনে বিস্ফোরণ ঘটে এক ভয়ানক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।

ঢাকা শহরে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে বিল্ডিং কোড মানা হচ্ছে কিনা তা নজরদারি করার দায়িত্ব রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা রাজউকের। তবে অভিযোগ রয়েছে বেশির ভাগ সময় এ দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করা হয় না।  কোনো ভবন তৈরি হওয়ার পরে এবং  ব্যবহার শুরুর আগে একটি অকুপেন্স সার্টিফিকেট নিতে হয়, যেখানে ভবনটি নির্মাণে সব ধরনের নিয়ম মানা হয়েছে কিনা, তা খতিয়ে দেখা হয়। তবে বাস্তবে এ সার্টিফিকেট নেবার হার খুব কম।

এ ছাড়া, দেশের ভূমিকম্প সহনশীলতা নজরদারি বিষয়ক যেসব সংস্থা রয়েছে তাদের সক্ষমতাও অপর্যাপ্ত । তাই এসব সংস্থার সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করাও অত্যাবশ্যক। পাশাপাশি বেসরকারি ফার্মগুলো দ্বারা ভবনগুলোর সহনশীলতা পরীক্ষা করে সার্টিফিকেট দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। ২০১৫ সালে নেপালে উচ্চমাত্রার ভূমিকম্পের প্রভাবে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছিল। সেসময় প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কাউন্সিলের বৈঠকে চীনের সহায়তায় ন্যাশনাল ইমারজেন্সি অপারেশন সেন্টার প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল । কিন্তু নানান জটিলতায় এটির কাজ এখনো শেষ হয়নি। এই সেন্টার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে সরকারের পাশাপাশি অন্যান্য বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে দুর্যোগের আগে ও পরে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হবে। তাছাড়া বিভিন্ন দেশ হতে উদ্ধার সহায়তা পাওয়ার জন্যও এই ইমারজেন্সি অপারেশনস সেন্টার গঠন করা দরকার ।

বলা বাহুল্য, ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় অবস্থান এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে ভূমিকম্পের প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধির সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। তাই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট ভূমিকম্প ও অন্যান্য প্রাকৃতিক  দুর্যোগ মোকাবিলায় আমাদের সচেতন হতে হবে। এ জন্য পরিকল্পিত নগরায়ণ, বনায়নের পরিমাণ বৃদ্ধি, পরিকল্পিত শিল্পায়ন, পাহাড় কাটার উপর নিষেধাজ্ঞা ও নদীর নাব্যতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ভূমিকম্পের মাত্রা ও ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় সবাইকে এক সাথে কাজ করা জরুরি।  বিভাগীয় পর্যায় হতে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন,বিভিন্ন ধরনের প্রজেক্ট ও এনজিওর মাধ্যমে ভূমিকম্পে উদ্ধারকারীদের দক্ষ করে তোলা, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কর্তৃক জনগণের জন্য ভূমিকম্পে করণীয়মূলক প্রশিক্ষণ ও মহড়ার আয়োজন করতে হবে। সেই সঙ্গে তাদের উদ্ধার কাজকে দ্রুত করার জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবস্থা করার মাধ্যমে ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি রোধ ও সচেতনতা বৃদ্ধিতে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারলে এ দুর্যোগকে অনেকাংশেই মোকাবিলা করা সম্ভবপর হবে।

গ্যাস ও বিদ্যুৎ লাইনের জন্য অটো শাট ডাউন সিস্টেম স্থাপন করে ভূমিকম্পের সময় অগ্নিদুর্ঘটনা প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। ভূমিকম্পে ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ হ্রাস করার জন্য আমাদের ভূমিকম্প সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান এবং সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে, যার মাধ্যমে আমরা আমাদের কোটি কোটি টাকার সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি ও মৃত্যুর মিছিল হ্রাস করতে পারি।

মো. নাইমুর রহমান

শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
ইমেইল: mdnrshawon@gmail.com