‘সফল বার্ধক্য’ অর্জনের পথ কী?

সফল বার্ধক্য কেবল দীর্ঘজীবন লাভ নয়, বরং এ সময়ে উচ্চ মানসম্পন্ন সার্বিক জীবনযাপনও সফল বার্ধক্যকে সূচিত করে
ফাইল ছবি

সৃষ্টির অমোঘ নিয়মেই বয়স অনুযায়ী জীবনে মানুষকে পাঁচটি স্তর অতিক্রম করতে হয়। স্তরগুলো হলো—শৈশব, কৈশোর, যৌবন, প্রৌঢ়ত্ব ও বার্ধক্য। পাঁচটি স্তরের মধ্যে বহুমুখী সমস্যায় জর্জরিত স্তরটির নাম বার্ধক্য। জীবন দীর্ঘায়ু হলে জীবনের এ স্তর অবশ্যম্ভাবী। একবিংশ শতাব্দীতে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ব্যাপক উন্নতি, সচেতনতা, পুষ্টি ও স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে মৃত্যুহার যেমন হ্রাস পেয়েছে, তেমনি মানুষের গড় আয়ু বাড়ায় বিশ্বে বয়স্কদের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

সেই সঙ্গে কয়েক দশক ধরে মানুষের কাঙ্ক্ষিত ‘সফল বার্ধক্য’ শব্দটিও জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। সফল বার্ধক্য সম্পর্কে ১৯৮৭ সালে বিজ্ঞানী জন ওয়ালিস রো ও রবার্ট কান প্রথম বহুমাত্রিক ধারণা দেন, যা একজন ব্যক্তির শারীরিক, জ্ঞানীয় ও সামাজিক সুস্থতা তথা অর্থপূর্ণ উপায়ে জীবনের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করার সক্ষমতাকে বর্ণনা করে।

একজন বয়স্ক ব্যক্তির সুস্থ, সক্রিয় ও পরিপূর্ণ জীবন যাপন করার ক্ষমতা এবং উদ্ভূত যেকোনো ধরনের পরিবর্তন ও চ্যালেঞ্জগুলোর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষমতাকে সফল বার্ধক্য বোঝায়। সফল বার্ধক্যের সংজ্ঞা পরিবর্তিত পরিস্থিতির বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটের ওপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হয়। তবে সফল বার্ধক্য মূলত সুন্দর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য বজায় রাখা, ইতিবাচক মনোভাব থাকা, অর্থপূর্ণ কাজে জড়িত থাকা, চারদিকে সহায়ক সম্পর্ক থাকা এবং অর্থবোধক উদ্দেশ্য থাকা এবং অধিকারে স্বায়ত্তশাসন থাকাকে বোঝায়।

সফল বার্ধক্য কেবল দীর্ঘজীবন লাভ নয়, বরং এ সময়ে উচ্চ মানসম্পন্ন সার্বিক জীবনযাপনও সফল বার্ধক্যকে সূচিত করে। এটি শারীরিক ও জ্ঞানীয় হ্রাসের মুখে একজন বয়স্ক ব্যক্তির সম্ভাবনা সর্বোচ্চ থাকে, সেই সঙ্গে জীবনে সন্তুষ্টি ও পরিপূর্ণতা খুঁজে পাওয়াও জড়িত থাকে। পদার্থবিদ স্টিফেন হকিং ‘লু গেহরিগ’জনিত মোটর নিউরন রোগে হুইলচেয়ারে আবদ্ধ ছিলেন। কিন্তু তাঁর সামাজিক ও মানসিক স্বাস্থ্য প্রভাবিত হয়নি বিন্দুমাত্র বিধায় তাঁর সন্তুষ্টি ও পরিপূর্ণতা ছিল আকাশছোঁয়া, তাই এ বার্ধক্যও অবশ্যই সফল বার্ধক্য।

উন্নত দেশ, যেমন জাপান, আইসল্যান্ড, সুইডেন, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া সফল বার্ধক্য অর্জনকারী দেশ। এ দেশগুলো বিশ্বের সর্বোচ্চ গড় আয়ুসম্পন্ন দেশ। এটা সম্ভব হয়েছে সুষম খাদ্য, নিয়মিত কায়িক পরিশ্রম, শক্তিশালী সামাজিক সংযোগসহ স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের সংস্কৃতির জন্য। এ ছাড়া এসব দেশ আবাসনসহ অন্যান্য পরিষেবার মাধ্যমে শক্তিশালী সামাজিক কল্যাণ সুনিশ্চিত করেছে।

তবে এদের সফল বার্ধক্য অর্জনের মূল কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে—১. উন্নত স্বাস্থ্য: সফল বার্ধক্যে বয়স্কদের ভালো শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে পরিচালিত করে, যা দীর্ঘস্থায়ী রোগ ও জ্ঞানীয় পতনের ঝুঁকি হ্রাস করে। ২. উন্নত জীবনমান: সক্রিয় ও কাজে জড়িত থাকার মাধ্যমে বয়স্করা উন্নত মানের জীবন বজায় রাখতে পারেন এবং তাঁদের আগ্রহ ও শখগুলো পূরণ করতে পারেন। ৩.স্বল্পমূল্যে স্বাস্থ্যসেবা: বয়স্কদের চিকিৎসাসেবায় স্বাস্থ্যবিমা চালু থাকায় সামগ্রিকভাবে ব্যক্তি ও সমাজের জন্য তা স্বস্তিদায়ক। ৪. শক্তিশালী কমিউনিটি: বয়স্করা স্বেচ্ছাসেবকের কাজ, পরামর্শদানসহ অন্য কার্যাবলির মাধ্যমে কমিউনিটিতে বড় অবদান রাখতে পারেন। এর মাধ্যমে সামাজিক সংযোগ শক্তিশালীকরণ এবং আন্তপ্রজন্মীয় বন্ধন তৈরির মাধ্যমে সফল বার্ধক্য অর্জন সম্ভব হচ্ছে।

এ কথা ঠিক, সফল বার্ধক্যের জন্য জীবনের প্রথম দিক থেকে স্বাস্থ্যকর অভ্যাস শুরু করা অপরিহার্য। এতে পরবর্তী জীবন গঠন সহজ করে, মস্তিষ্কের বিকাশ ও দীর্ঘস্থায়ী রোগ প্রতিরোধে ভূমিকা রাখার মাধ্যমে পরবর্তী জীবনে ‘সফল বার্ধক্য’ অর্জনে ভূমিকা রাখে। সর্বোপরি বাংলাদেশে বহুক্ষেত্রগত পদ্ধতির একান্ত প্রয়োজন, যা বয়স্কদের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা এবং সমাজে তাঁদের সুস্থতা ও পরবর্তী জীবনে শারীরিক, সামাজিক, মানসিক ও জ্ঞানীয় সুস্থতার অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করে সফল বার্ধক্য অর্জনে সহায়তা করতে পারে।

এবার আসি বাংলাদেশ প্রসঙ্গে, বাংলাদেশ বিভিন্ন সামাজিক সূচকে উন্নতি করলেও বাংলাদেশের অনেক বয়স্ক মানুষ সফল বার্ধক্য অর্জনে নানাবিধ চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। দারিদ্র্য, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা বিমুখতা এবং এ বয়সে কর্মসংস্থানের সুযোগ কম থাকা—বাংলাদেশে সফল বার্ধক্যের মূল বাধা। অধিকন্তু বয়স্ক মহিলাদের ক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্য একটি প্রধান সমস্যা। প্রায়ই তাঁরা পরিবার ও সমাজ থেকে অবহেলা ও বৈষম্যের সম্মুখীন হন। পরিবারে বয়স্ক মহিলাদের কাছ থেকে তাঁর স্বামী ও নাতি–নাতনিদের যত্ন, স্কুলে আনা-নেওয়ার কাজের প্রত্যাশা থাকে, যা প্রকারান্তরে সফল বার্ধক্য অর্জনে তাঁদের সামাজিক ক্রিয়াকলাপে জড়িত হওয়ার বা ব্যক্তিগত লক্ষ্যগুলোকে পূরণ করার ক্ষমতাকে সীমিত করে। এসব সফল বার্ধক্যের অন্তরায়।

এই চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও বাংলাদেশে সফল বার্ধক্য অর্জনে প্রচেষ্টা চলছে। সরকার বয়স্ক ব্যক্তিদের স্বাস্থ্যসেবা ও সামাজিক সহায়তার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। সর্বশেষ বয়স্কসহ প্রায় এক কোটি লোককে কার্ডের আওতায় আনা, বয়স্ক ভাতার পরিমাণ ও আওতা বৃদ্ধি করা এবং এ বছর থেকে সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু হচ্ছে, যার মূল লক্ষ্য বয়স্ক ভাতাপ্রাপ্ত বয়স্কদের জীবনমান উন্নত করার মাধ্যমে সফল বার্ধক্যের দিকে ধাবিত হওয়া। এ প্রচেষ্টা সত্ত্বেও সীমিত সম্পদ, অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা ও বার্ধক্যের প্রতি সামাজিক কাঠামো ও মনোভাব পরিবর্তন বাংলাদেশে সফল বার্ধক্য অর্জনে প্রধান চ্যালেঞ্জ।

বাংলাদেশে সামগ্রিকভাবে বহুক্ষেত্রগত পদ্ধতির প্রয়োজন। এ পদ্ধতিগুলোর মধ্যে বয়স্কদের স্বাস্থ্য ও কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য স্বাস্থ্য, সামাজিক পরিষেবা, শিক্ষা ও কমিউনিটি সংস্থাগুলোর মধ্যে বিভিন্ন খাতের পারস্পরিক সহযোগিতা জড়িত। এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য দিকগুলো হচ্ছে;

১. স্বাস্থ্যসেবায় প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা: বাংলাদেশে বয়স্কদের বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে তাঁদের স্বাস্থ্যসেবার মান সীমিত। বয়স্কদের মোবাইল ক্লিনিক ও আউটরিচ প্রোগ্রামের মাধ্যমে বহুক্ষেত্রীয় পদ্ধতির মধ্যে স্বাস্থ্য খাত ও কমিউনিটি সংস্থাগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতাপূর্ণ যোগাযোগ স্থাপন করা যেতে পারে। উপরন্তু স্বাস্থ্য খাত ও সামাজিক পরিষেবাগুলোর মধ্যে অংশীদারত্বও একান্ত প্রয়োজন, যাতে বয়স্কবান্ধব পরিবহন ও পারিবারিক যত্নের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

২. কমিউনিটির সম্পৃক্ততা: সামাজিক সুযোগ, স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী পাওয়ার সহজলভ্যতা ও ব্যবহার নিশ্চিত এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতাকে মোকাবিলা করার মাধ্যমে সফল বার্ধক্য প্রচারে কমিউনিটি বা সামাজিক সংগঠনগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এ ছাড়া কমিউনিটি সংস্থা ও শিক্ষা খাতের মধ্যে অংশীদারত্ব বয়স্কদের আজীবন শিক্ষা ও দক্ষতা বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে।

৩. অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন: বাংলাদেশে সফল বার্ধক্যের ক্ষেত্রে দারিদ্র্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বাধা। তাই সরকারি–বেসরকারি ও সামাজিক পরিষেবাগুলোর মধ্যে সহযোগিতার মাধ্যমে বয়স্কদের জন্য তাঁদের উপযুক্ত চাকরির প্রশিক্ষণসহ আয়-উৎপাদনের সুযোগের মাধ্যমে বয়স্কদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন সম্ভব।

৪. জনসচেতনতা: বাংলাদেশে স্বাস্থ্যকর বার্ধক্য অনুশীলন সম্পর্কে সচেতনতার অভাব আছে। স্বাস্থ্য খাত, মিডিয়া ও কমিউনিটি সংস্থাগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে এ সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়াতে এবং আচরণগত পরিবর্তনকে উৎসাহিত করা যেতে পারে।

এ কথা ঠিক, সফল বার্ধক্যের জন্য জীবনের প্রথম দিক থেকে স্বাস্থ্যকর অভ্যাস শুরু করা অপরিহার্য। এতে পরবর্তী জীবন গঠন সহজ করে, মস্তিষ্কের বিকাশ ও দীর্ঘস্থায়ী রোগ প্রতিরোধে ভূমিকা রাখার মাধ্যমে পরবর্তী জীবনে ‘সফল বার্ধক্য’ অর্জনে ভূমিকা রাখে। সর্বোপরি বাংলাদেশে বহুক্ষেত্রগত পদ্ধতির একান্ত প্রয়োজন, যা বয়স্কদের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা এবং সমাজে তাঁদের সুস্থতা ও পরবর্তী জীবনে শারীরিক, সামাজিক, মানসিক ও জ্ঞানীয় সুস্থতার অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করে সফল বার্ধক্য অর্জনে সহায়তা করতে পারে।

ড. দিলীপ কুমার সাহা প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক বাংলাদেশ পুলিশ, সিআইডি এবং
যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জেরেন্টোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন