‘চাচা, ঘুষের টাকার বাড়িটা দান করে আমাদের ধর্মের পথে ডাকুন’

সুশীল সমাজ নামে একটা শব্দের সঙ্গে শিক্ষিত শহরের মানুষেরা খুবই পরিচিত। নানা জায়গায় সুশীল সমাজের সংজ্ঞা বিভিন্নভাবে দেওয়া হয়েছে।

সুশীল সমাজের ব্যক্তিরা সমাজের অধঃপতনে চুপচাপ বসে থাকার কথা নয়। তাঁরা হবেন নির্ভীক, তাঁদের কোনো পিছুটান থাকবে না। তাঁদের থাকবে না কোনো কিছু হারানোর ভয়। কিন্তু দেখেশুনে আমার মনে হচ্ছে উপদেশ দেওয়ার মতোও এবং শোনার মতো মানুষ দিন দিন কমে যাচ্ছে। ছোটকালে দেখেছি ইশপের উপদেশগুলো শিশু–কিশোরদের হৃদয়ে ঢুকিয়ে দেওয়া হতো। তারা তাদের শিক্ষকদের কথা শুনত। বিভিন্ন লেখকের উপদেশের বই পড়ত। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা উক্তি আমাকে নাড়া দেয়, ‘আগুনকে যে ভয় পায়, সে আগুনকে ব্যবহার করতে পারে না।’

আমরা আমাদের নৈতিক সাহস হারিয়ে ফেলেছি। অন্যায়কে অন্যায় বলার সাহস আমাদের সমাজে কয়জনের মধ্যে আর বাকি আছে। আগুনের ভয়ে আমরা অতি বেশি নিজেকে খোলসের মধ্যে ঢুকিয়ে ফেলেছি। শুনেছি, কাক মলত্যাগের সময় নাকি চোখ বন্ধ করে আর ভাবে, আমার এই কাজ কেউ দেখছে না। কারণ, আমি তো দেখছি না। একটা কাকেরও লজ্জা–শরম আছে।

আমাদের এখন আর এসব লজ্জা–শরমের ব্যাপার আর নেই। প্রতিযোগিতা করে অনেকেই ঘুষ খেয়ে পাহাড় পরিমাণ অবৈধ সম্পদের মালিক হচ্ছে। চোখ বন্ধ করে বা গোপনে এখন আর কেউ অপকর্ম করে না।

দুর্নীতিমুক্ত শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার মূলমন্ত্রে আমরা সবাই বদ্ধপরিকর। বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনের স্বপ্ন আর সংগ্রাম ছিল দুর্নীতিমুক্ত, শোষণমুক্ত সোনার বাংলা গড়ার। আমরা তাঁর স্বপ্নের বাংলার অবস্থা কী করেছি দেখুন। আজ আমরা বেনজীর আহমেদ বা মতিউর রহমানদের মতো দুর্নীতিবাজদের নিয়ে সবাই কথা বলছি। দেশের সব ধরনের সংবাদমাধ্যমের প্রতিদিনের আলোচনার বিষয় এখন তাঁরা।

আপনি যদি সৎ–সজ্জন হয়ে থাকেন, তবে আপনার দৃষ্টির বাইরে নিশ্চয় এটা নেই যে পরিচিত বা প্রতিবেশীদের অনেকেই খুব অল্প সময়ে অগাধ সম্পদের মালিক হয়ে গেছেন। তাঁদের অবৈধ সম্পদের হিসাব নিশ্চয় বেনজীর–মতিউরদের মতো কর্মকর্তাদের নজরদারির বাইরে থাকে না।

এসব সরকারি কর্মকর্তার দায়িত্ব থাকে তাঁদের হিসাবহির্ভূত এ সম্পদের হিসাব নেওয়া। এবং তা অবৈধ প্রমাণিত হলে আইনের আওতায় আনা। কিন্তু তারা নিজেরাই দুর্নীতির ধারক–বাহক। শর্ষের মধ্যেই ভূত। রক্ষকই যদি ভক্ষক হয়, তাহলে সব সিস্টেমই ব্যর্থ।

জমি কেনা নাকি কালোটাকা সাদা করার খুব সহজ রাস্তা। কারণ, বাজারদরের চেয়ে অনেক কমে জমি রেজিস্ট্রি করা হয়। এতে ঘুষের মাধ্যমে অর্জিত নগদ টাকা বৈধতা পায়। একজন সাধারণ মানুষকে ব্যাংকের মাধ্যমে নগদ ৫০ হাজার টাকা বা এর বেশি কাউকে পাঠাতে জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি জমা দিতে হয়। তাহলে বেনজীর-মতিউর সাহেবরা কীভাবে এত এত টাকার লেনদেন করলেন?

আমি অর্থনীতিবিদ নই। সাধারণ মানুষ হিসেবে আমার মনে হয়েছে গলদের মূল হলো নগদ টাকা লেনদেন। নগদ লেনদেনের টাকার উৎস থাকে গোপন। সুতরাং দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোরেরা এটাকেই ব্যবহার করেন।

আমার মনে হয় হঠাৎ আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়া ব্যক্তিদের বাসায় হানা দিলে বস্তার পর বস্তা নগদ টাকা পাওয়া যাবে। ঢাকা শহরে এখন ফ্ল্যাটগুলোর দাম গগনচুম্বী। আমি হলফ করে বলতে পারি, কোনো সৎ কর্মকর্তা তিনি যত বেতনই পান না কেন, ঢাকার অভিজাত এলাকায় কোনো অবস্থাতেই বেতনের টাকা দিয়ে ফ্ল্যাটের মালিক হতে পারবেন না।

শুনি, অনেক কর্মকর্তার শুধু ঢাকাতেই নয়; বিদেশে বেগমপাড়া নামক স্থানে একাধিক বাসস্থান আছে। বেগমপাড়া নাকি একটা প্রতীকী নাম। এ নামে কোনো পাড়া নেই। অবৈধভাবে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত দেশের টাকা বাইরে পাচার করে দ্বিতীয় আবাসস্থল কিনে থাকেন বেগমসহ বাচ্চা-কাচ্চাদের সঙ্গে শেষজীবনে ধরাছোঁয়ার বাইরে বেহেশতি সুখ উপভোগ করবেন এই বেগমপাড়ায়।

আমরা সৃষ্টিকর্তাকে মানি আর না মানি, এটা তো চরম সত্য যে জীবনকাল অতি সীমিত। মৃত্যু তো জীবনে অনিবার্য। আমাদের পাড়ায় ছোটকালে দেখেছি দুইটা ছাদ পেটানো বাড়ি। বলার অপেক্ষা রাখে না দুজনই ঘুষখোর সরকারি কর্মকর্তা। একজন শেষ বয়সে অতি ধর্মভীরু হয়ে পড়লেন। মানুষকে ধর্মের পথে ডাকার জন্য সকাল–সন্ধ্যা পাড়ার বিভিন্ন বাসায় যেতে শুরু করলেন। পাড়ার কয়েক যুবক একদিন তাঁর পথরোধ করল। বলল, ‘চাচা, ঘুষের টাকায় তৈরি বাড়িটা বিক্রি করে দান করে দিয়ে আমাদের ধর্মের পথে ডাকুন।’ তিনি কি সেদিন লজ্জা পেয়েছিলেন?

মোদ্দাকথা কয় দিনের এই দুনিয়া? ইতিহাস দেখুন। প্রথম জীবনে ফেরাউন আর তার বন্ধু হামান কবরস্থানের রক্ষকের দায়িত্বে থেকে দুর্নীতি করে অবৈধ সম্পদের মালিক হয়ে পরবর্তী সময়ে মিসরের রাজ্য শাসন করে। এই মহাশক্তিধর ব্যক্তির শেষ পরিণতি কী হয়েছিল, সেটা সবাই জানে। সুতরাং এই কয়টা দিনের জন্য কেন চুরি করা! আর শেষ বয়সে তো খানাখাদ্যও হবে সীমিত। ওষুধের ওপর থাকতে হবে বেঁচে।

ঘুষখোর–দুর্নীতিবাজেরা সম্পদ নিজে ভোগ খুব কমই করতে পারে। এর থেকে সৎ জীবন যাপন করে মাথা উঁচু করে বাঁচার মধ্যেই সার্থকতা। সৎভাবে উপার্জন করুন। অনেক সৎ মানুষ অবসরের অল্প কয়টা টাকা নিয়ে গ্রামে চলে গেছেন। টাটকা শাকসবজি, পুকুরের মাছ আর ঘরে পালা মুরগির ডিম–মাংস খেয়ে দিব্যি বেঁচে আছেন। তাঁরা ভালো আছেন। কী দরকার মানুষের ঘৃণা ও অভিশাপ নিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নেওয়া।

  • ড. মো. আশরাফুল হক ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির অধ্যাপক।