প্রতিক্রিয়া

দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হইতে দুই পা ফেলিয়া

‘ইমিগ্রেশন শেষ করে আবার লম্বা লাইন, যা জিইয়ে রাখা হয়েছে। ফাইনাল চেকিং শুরু করেনি। কারণ, করলে যাত্রীদের সুবিধা হয়ে যাবে। এয়ারপোর্টের বীর বাঙালিরা বুঝিয়ে দেবেন, অত্যাচার কত প্রকার ও কী কী। সব শেষ করে যখন প্লেনে ওঠার ডাকের অপেক্ষায় বসে আছি, তখন রাত সাড়ে আটটা। অর্থাৎ মোট তিন ঘণ্টার কসরত করে তবে তো মুক্তি। এই দীর্ঘস্থায়ী শাস্তি ঢাকা বিমানবন্দরে পোহাতে হয়। পৃথিবীর আর কোথাও এর দ্বিতীয় নজির আছে বলে আমার জানা নেই। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার কাজটি বিমানবন্দর থেকেই শুরু করতে হবে।’

২৩ মে প্রথম আলোয় প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী অর্থনীতির অধ্যাপক বিরূপাক্ষ পালের ‘বিমানবন্দরের কেচ্ছা ও বাঙালির চরিত্র’ শীর্ষক লেখার শেষ অনুচ্ছেদ এটি। বিরূপাক্ষ পালের ভ্রমণ–অভিজ্ঞতার কথা পড়ে আমার ক্ষুদ্র কিছু অভিজ্ঞতার কথা মনের মধ্যে উঁকি দিয়েছে। এবার সেই কথায় আসা যাক। করোনা মহামারির পর ২০২১ সালের অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে পবিত্র ওমরাহ পালনের জন্য মক্কা যাওয়ার সময়ের অভিজ্ঞতার কথা প্রথমে বলি। করোনা মহামারির কারণে দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকার পর নির্দিষ্ট কয়েকটি দেশের জন্য সবে ওমরাহর অনুমতি উন্মুক্ত করেছিল সৌদি আরব, তা–ও আবার এই উপমহাদেশের মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশিরাই সৌভাগ্যবান ছিল। তবে নিয়মকানুন ছিল অনেক কঠিন। বিমানযাত্রার জন্য কঠিন নিয়মকানুনের বেড়াজাল শেষ করে প্রায় ছয় ঘণ্টার কসরত শেষে মুক্তি মিলেছিল, আর নির্ধারিত সময়ের আগেই জেদ্দা থেকে মধ্যরাতে ঢাকায় নামার পর লাগেজ পেতেই অপেক্ষা করতে হয়েছে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা।

পরবর্তী সময়ে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিকের মালদ্বীপ ভ্রমণের কথায় আসি। তখন আবার ই-পাসপোর্ট আর ই-গেটের রমরমা ভাব। তত দিনে আমি ই-পাসপোর্টের যুগে ঢুকে গিয়েছিলাম, তাই মনে সাধ জেগেছিল ই-গেটের স্বপ্ন পূরণের। ই-গেট ব্যবহার করে ইমিগ্রেশন করতে গিয়ে কঠিন ফ্যাঁকড়ায় পড়ে গেলাম। অগত্যা এক পুলিশ সদস্যের চেষ্টায় ঐতিহাসিক ই-গেটের কঠিন কসরত ছেড়ে আবার লম্বা লাইনে দাঁড়ালাম। ততক্ষণে ই-গেটের সাধ মিঠে গেছে। হাফ ডিজিটাল আর লম্বা লাইনের অ্যানলগের কসরত শেষে ইমিগ্রেশন শেষ করতে সময় লেগে যায় প্রায় আধা ঘণ্টা। অথচ অবাক হয়ে গেলাম মালদ্বীপের মতো ছোট্ট একটা দেশের এয়ারপোর্টে আমার তিন সদস্যের পরিবারের একসঙ্গে ইমিগ্রেশন করতে সময় লেগেছে মাত্র দুই মিনিটেরও কম। রীতিমতো তাজ্জব হওয়ার ব্যাপার—এই ভেবে, যারা আমাদের নানা রকম স্বপ্ন দেখায় সেই ফেরিওয়ালাদের কথা ভেবে।

পুরোনো কথা বাদ দিয়ে এবার নাহয় তরতাজা অভিজ্ঞতার বর্ণনা করি। সপ্তাহ দুয়েক আগে কলকাতায় গিয়েছিলাম বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের বোয়িং ফ্লাইটে। উড়োজাহাজ ছাড়ার পর বিমান বাংলাদেশ এয়ার লাইনসের সৌজন্যে দেওয়া বার্গার শেষ করার আগেই পৌঁছে গেলাম কলকাতার বিমানবন্দরে, উড়োজাহাজ থেকে নামার মুহূর্তে জানিয়ে দেওয়া হলো কত নম্বর বেল্টে লাগেজ থাকবে। কিন্তু কলকাতা বিমানবন্দরে নামার পর জানতে পারলাম এম্বারগেশন ফরম উড়োজাহাজ থেকে নামার আগেই দেওয়ার কথা থাকলেও সেই সৌজন্য দেখাতে পারেনি বা ভুলে গেছে দেশের একমাত্র জাতীয় এয়ারলাইনস। অথচ প্রায় একই সময়ে যাঁরা অন্য এয়ারলাইনসে কলকাতায় নেমেছেন, তাঁরা কয়েক মিনিটের মধ্যেই ইমিগ্রেশন শেষ করে বের হয়ে গেছেন। কলকাতার স্থানীয় কর্মকর্তাদের সহায়তায় লাইনে দাঁড়িয়ে এম্বারগেশন ফরম জোগাড় করতে সময় লাগলেও ইমিগ্রেশন করতে দু–তিন মিনিটের বেশি সময় লাগেনি। এরপর একেবারে স্বল্প সময়ের মধ্যে বেল্ট থেকে লাগেজ নিয়ে এয়ারপোর্ট থেকে বের হতে কোনো দালালের খপ্পরেও পড়তে হয়নি বা কাউকে সালামির নামে উটকো উপদ্রবের মুখেও পড়তে হয়নি।

যানজট আর লোডশেডিং জন্য একসময়ের বিড়ম্বনার শহর কলকাতার বর্ণনা দিতেই হচ্ছে। যে কয় দিন সেখানে ছিলাম, প্রায় প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কলকাতা শহর ঘুরে বেড়িয়েছি কিন্তু কখনো ১০ থেকে ১৫ মিনিটের বেশিক্ষণ যানজটের কবলে পড়তে হয়নি। মজার ব্যাপার হলো সন্ধ্যার আগে রাস্তায় ট্রাফিক/সার্জেন্ট/পুলিশ খুব একটা চোখে পড়েনি এবং যানজট নিয়ন্ত্রণের জন্য কাউকে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দৈহিক কসরত করতেও দেখিনি—সবাই লাল-হলুদ-সবুজ বাতি মেনেই চলাচল করতে দেখেছি। অথচ আমাদের এখানে সড়কে হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে লাল-সবুজ বাতি নীরবেই জ্বলছে-নিভছে, কিন্তু সেই হিসাব কারও কাছে নেই। সেই সঙ্গে অসংখ্য পুলিশ সদস্য মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দিনরাত দৈহিক কসরত করেও সড়ক নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। আর কলকাতাবাসীর সেই অভিশপ্ত লোডশেডিং এখন অতীত। আর আমরা যখন মেট্রোরেল চালু করা নিয়ে মহা উৎসবের ঘোরের মধ্যে আছি, তারও প্রায় ৩৫ বছর আগে সেখানে মেট্রোরেল হয়ে গেছে।  

ঠিক সাত দিন পর দেশে ফেরার অভিজ্ঞতার কাহিনি আরও ভোগান্তির। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের বোয়িং ফ্লাইট যথাসময়ে ছেড়ে দেওয়ার পর কেবিন ক্রুদের দেওয়া না হটডগ না বার্গার—এমন কিছু একটা শেষ করার আগেই পৌঁছে গেলাম ঢাকা বিমানবন্দরে। এর পরের অপেক্ষার পালা যেন শেষই হচ্ছিল না। প্রথম ধাক্কায় বিশাল লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে ইমিগ্রেশন শেষ করা যাচ্ছিল না। এর মধ্যে এক পুলিশ কর্মকর্তা এসে জানালেন, যাঁদের ই-পাসপোর্ট আছে, তাঁরা ইমিগ্রেশন কাউন্টারে পৃথক লাইনে দাঁড়াবেন। কিন্তু বাদ সাধলেন যাঁরা আগে থেকেই লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন, শুরু হয় যাত্রীদের মধ্যে নতুন করে তর্কবিতর্ক, এ নিয়ে আরেক কাহিনি—ডিম আগে না মুরগি আগে।

যাহোক, সেই পুলিশ কর্মকর্তা এসে ই-পাসপোর্টধারী যাত্রীদের ই-গেট দিয়ে বের করে দিলেও আবারও ইমিগ্রেশন কাউন্টারে দাঁড়াতে হয়েছে তথ্যাদি লিপিবদ্ধ করার জন্য। তখন মনে প্রশ্ন জাগে, এটি কি ডিজিটাল, নাকি স্মার্ট বাংলাদেশ, না পাকিস্তান-ব্রিটিশ অ্যানালগ সিস্টেম।

এরপর শুরু হয় লাগেজ খুঁজে নেওয়ার যুদ্ধ। এদিক–সেদিক দৌড়াদৌড়ি করে কোন বেল্টে লাগেজ পাওয়া যাবে, তা জেনে নিয়ে ১ নম্বর বেল্টের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ঘণ্টাখানেক সেখানে দাঁড়িয়ে লাগেজের হদিস পাওয়া গেল না, বরং বেল্টে আসা লাগেজগুলো দেখে মনে হচ্ছিল, সেগুলো দুবাই-মাসকাটের প্রবাসী ভাইদের।

এ অবস্থায় কিছু দূরে দাঁড়ানো লাগেজ ট্যাগ সংগ্রহ করার দায়িত্ব পালনরত বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের এক কর্মকর্তার কাছে কলকাতার লাগেজ কোন বেল্টে জানতে চাইলে তাঁর সাফ জবাব—জানি না। তখন নিজ উদ্যোগে শুরু করি এদিক-সেদিক খোঁজাখুঁজি—এক বেল্ট থেকে আরেক বেল্ট। অবশেষে ২ নম্বর বেল্টে এক পাশে আমার লাগেজগুলো দেখি আমার দিকে তাকিয়ে আছে! কপাল ভালো, লাগেজ খোঁজার যুদ্ধ সেখানে সমাপ্তি ঘটেছিল, তা না হলে কলকাতা বেড়ানোর হয়রানি আর খেসারত কোথায় গিয়ে ঠেকত, আল্লাহই জানেন।

এবার আরেক যুদ্ধের পালা—বাড়ি ফেরা। শুরু হয় উবার খোঁজার পালা। ততক্ষণে আরও এক থেকে দেড় ঘণ্টা অতীত হয়ে গেছে। প্রায় আধা ঘণ্টা অপেক্ষার পর দীর্ঘ যানজটের সঙ্গে যুদ্ধ করে বাড়ি ফিরে যেতে দুই ঘণ্টা অতীত হয়ে গেল নিমেষেই! কিন্তু ছোটগল্পের মতো—শেষ হয়েও যেন শেষ হয় না! উবারে ওঠার সময় দেখলাম আমার গন্তব্যে পৌঁছাতে ভাড়া আসবে ১ হাজার ৩৫৫ টাকা। ট্রিপ শেষে ভাড়ার অঙ্কে কিছু কমবেশি হলেও কাহিনি এখানেই শেষ হয়ে যেত। বাড়িতে পৌঁছানোর পর গাড়ি থেকে নামার আগে উবারের চালক তাঁর মোবাইল অ্যাপ দেখিয়ে জানালেন, ভাড়ার পরিমাণ ১ হাজার ৮০৩ টাকা। উবার নিয়মিত ব্যবহার করি বিধায় নিয়মকানুন জানা আছে বলে ভাড়া নিয়ে চালকের সঙ্গে কোনো কথা না বলে লেনদেন শেষ করে গাড়ি থেকে নেমে পড়ি। যদিও শুনেছি বা দেখেছি, অনেকের সঙ্গে উবার চালকের তর্কবিতর্কের ঘটনা শেষ পর্যন্ত অনেক দূর গড়ায়।

এ ধরনের ঘটনায় তর্কবিতর্ক না করে আমি ট্রিপ শেষে উবার অ্যাপের সাপোর্ট মেনুর মাধ্যমে যথানিয়মে অভিযোগ জানিয়ে দিই এবং যতবারই অভিযোগ করেছি, প্রায় ততবারই ট্রিপ শুরুর আগের চেয়ে যে পরিমাণ টাকা বেশি দিয়েছি, তা আমার উবার অ্যাকাউন্টে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে, যা পরবর্তী ট্রিপেই ব্যবহার করা যায়। তাই এই সুযোগে উবারকে ধন্যবাদ না জানালে ভুল হবে।

‘বিমানবন্দরের কেচ্ছা ও বাঙালির চরিত্র’ শীর্ষক কলাম পড়ে নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে অনেক কথাই বলা হলো। আজ থেকে প্রায় ৪১ বছর আগে সে সময়ের (ছাত্র অবস্থায়) পেশার কাজে পাকিস্তানের করাচি সফরের মাধ্যমে বিদেশভ্রমণ শুরু করে সুদূর সৌদি আরব থেকে মালদ্বীপসহ প্রতিবেশী ভারতে কয়েকবার ভ্রমণ করে ব্রিটিশ-পাকিস্তান-অ্যানালগ-ডিজিটাল কাহিনি শেষে স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বলতে শুনছি। কিন্তু সব কথার শেষ কথা, কবির ভাষায় বলতে হচ্ছে—দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হইতে দুই পা ফেলিয়া।  

  • শহীদুল লতিফ সাবেক ব্যাংকার