সক্রেটিস ছিলেন জ্ঞানী ব্যক্তি। সেটি গ্রিক সমাজে প্রতিষ্ঠিত তো ছিলই, বর্তমান বিশ্বেও।
আর আমি এবং আমার আশপাশের মানুষ নিজেদের জ্ঞানী ভাবি এবং নিজেদের সবজান্তা মনে করি।
তাহলে আপাতত মনে হচ্ছে, সক্রেটিস এবং আমার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।
কিন্তু এই যে মনে হচ্ছে পার্থক্য নেই, এটাই আসলে বড় পার্থক্য।
চলুন ব্যাখ্যা করি, আমি–আমরা জ্ঞানী নাকি সক্রেটিস।
সক্রেটিসকে ওরাকল একদিন এসে বললেন, আপনি হচ্ছেন এই সমাজের সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তি। ওরাকল হচ্ছেন গ্রিক পুরাণ অনুযায়ী দেবতাদের বার্তাবাহক।
ওরাকলের মুখে এ কথা শুনে সক্রেটিসের প্রথমে বিশ্বাস হচ্ছিল না। তাঁর কথার সত্যতা যাচাই করার জন্য তিনি গেলেন একজন লেখকের কাছে। গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি তো লেখালেখি করেন। যেসব বিষয়ে লেখেন, সেসব বিষয়ে আপনার কি পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান আছে?
তখন লেখক উত্তর দিলেন, আরে, জ্ঞান সে তো আমার দখলে, এসব বিষয়ে আমার চেয়ে কারও জ্ঞান বেশি নেই এথেন্সে।
তারপর সক্রেটিস গেলেন একজন কবির কাছে। তাঁকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ভাই, আপনি তো কবিতা লেখেন। কবিতার ছন্দ, মাত্রা,অক্ষর, ভাবার্থ—সব বিষয়ে কি জ্ঞান রাখেন? কবির উত্তর হলো, আমার চেয়ে কারও কি এ বিষয়ে ভালো জ্ঞান আছে?
এভাবে অনেক ব্যক্তির কাছে তিনি গেলেন। সবার একই কথা। তাঁরা জ্ঞানগরিমায় সমৃদ্ধ; তাঁরা সব বোঝেন এবং পারেন।
তখন সক্রেটিস মেনে নিলেন যে তিনি আসলে একজন জ্ঞানী ব্যক্তি। কারণ, সক্রেটিস অন্তত এটা জানেন, তাঁর জ্ঞান কম। কিন্তু অন্যরা এতটাই মূর্খ এবং নির্বোধ যে তাঁরা আসলে তেমন কিছুই জানেন না, এটা জানার মতোও তাঁদের জ্ঞান নেই। আর সক্রেটিস অন্তত এটা জানেন, তিনি কিছু জানেন না।
আর এই যে তিনি কিছু জানেন না, এটা জানার মতো তাঁর জ্ঞান আছে, তাই তিনি এই সমাজের একজন জ্ঞানী ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে মেনে নিলেন।
আর এথেন্স শহরে যাঁরা নিজেদের জ্ঞানীগুণী দাবি করেন, তাঁদের মধ্যে এই জ্ঞানটুকু নেই বা বিষয়টা উপলব্ধি করার মতো বোধশক্তি নেই যে তাঁরা তেমন কিছু জানেন না।
আর বর্তমানে আমাদের অবস্থা হয়ে গেছে গ্রিসের এথেন্স শহরের জ্ঞানীদের মতো। আমরা নিজেদের সবজান্তা মনে করি। যেমন আমি চিকিৎসাবিদ্যা পাস করে ভালোই নামডাক কামিয়েছি, তাহলে তো আমি একটা কবিতা বা উপন্যাসের বই প্রকাশ করতেই পারি।
আবার কেউ কেউ প্রকৌশলবিদ্যা পাস করার পর বড় মাপের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছি।
আবার আমি তো অভিনেতা আবার জনপ্রিয়ও, তাহলে তো সংসদ সদস্য হতেই পারি। সমস্যা কী তাতে।
আবার আমাদের সমাজে এমনও অনেক ফেসবুক সেলিব্রিটি আছেন, তাঁরা ভাবছেন, এখন তো আমার অনেক ফলোয়ার বা অনুসারী, তাহলে তো সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি, অর্থনীতি, চিকিৎসা, দর্শন, সাহিত্য—এসব বিষয়ে কথা বলতেই পারি, সব বিষয়ে মতামত তো প্রদান করাই যায়।
এই যে আমি বা আমাদের বর্তমান অবস্থা জ্ঞানী হওয়া নয়, জ্ঞানী সাজার অভিনয়—এটাই মূলত সক্রেটিস আর আমাদের মধ্যে পার্থক্য।
সক্রেটিস বিশ্বাস করতেন, তিনি কিছুই জানেন না। কিন্তু আমরা অল্প কিছু জেনে নিজেদের বুদ্ধিজীবী, জ্ঞানী মনে করি আর সমাজে জ্ঞান বিতরণ শুরু করে দিই। এটাই হচ্ছে আসল পার্থক্য।
আমাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা এতই কম পর্যায়ে যে আমরা জ্ঞানী নই, এটাও বোঝার মতো জ্ঞান নেই।
আসাদুজ্জামান বুলবুল
ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
bulbulhasan442@gmail.com