দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের অর্জন ও গুরুত্বপূর্ণ দলিল
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের অর্জন ও গুরুত্বপূর্ণ দলিল

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের অর্জন ও গুরুত্বপূর্ণ দলিল

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বেশ কয়েকজন বাংলাদেশিকে নিয়ে আমরা গর্ব করি। কিন্তু দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা-সম্পর্কিত যে জ্ঞানের চর্চা করা হয়, তার অধিকাংশই হয় ইংরেজিতে। এ বিষয়ে বাংলায় বই বা পত্রপত্রিকা চোখে পড়ে না বললেই চলে।

বাংলাদেশ একটি দুর্যোগপ্রবণ দেশ। অর্থাৎ দুর্যোগ থেকে পালিয়ে বাঁচার কোনো পথই নেই এ দেশের মানুষের। বরং তাঁদের যেমন দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হবে, পাশাপাশি দুর্যোগের সঙ্গে খাপ খাইয়ে বসবাস করাও শিখতে হবে। সেই উদ্দেশ্য তখনই সফল হবে, যখন এ–সম্পর্কিত জ্ঞানের উৎপাদন ও বাস্তবায়ন হবে ভাষা বাংলায়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে হবে বাংলায়, জ্ঞানের উৎপাদন, প্রয়োগ ও মূল্যায়নও বাংলাতেই হবে—যেখানে বাংলাদেশ এখনো বলতে গেলে শুরুই করেনি। গবেষক গওহার নঈম ওয়ারা সংকলিত ও সম্পাদিত বই স্বাধীনতার ৫০ বছর: দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের অর্জন বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার দীর্ঘ ইতিহাস, এর অর্জন ও চ্যালেঞ্জগুলোকে বাংলা ভাষায় অনন্য দক্ষতায় তুলে ধরেছেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির পরিপ্রেক্ষিতে এই বইটি প্রথমা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়। দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশের সরকার ও বিভিন্ন সংস্থার বিভিন্ন দুর্যোগ ও সেগুলো ব্যবস্থাপনার নানা প্রচেষ্টার প্রতিফলন বইটিতে স্থান পেয়েছে। দুর্যোগ মোকাবিলায় এ দেশের সাহসী মানুষের ৫০ বছরের অভিযাত্রা সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ধারণা তৈরি করা হয়েছে এর মাধ্যমে।

বাংলাদেশ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য সারা পৃথিবীতে পরিচিত। তবে দেশটি স্বাধীনতার পর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় উল্লেখযোগ্য উন্নতি করেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, নদীভাঙন ও সাম্প্রতিক কালে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা করতে গওহার নঈম ওয়ারা ও তাঁর সহকর্মীদের বিশ্লেষণগুলো প্রাসঙ্গিক ও সমসাময়িক। শুধু দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা–সম্পর্কিত অর্জন নয়, বরং দেশের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে শুরু করে স্থানীয় পর্যায়ের অভিজ্ঞতাগুলোও তুলে ধরা হয়েছে এ বইয়ে। এর ২৪টি অধ্যায়কে মোটামুটি পাঁচটি আঙ্গিকে দেখতে পারি আমরা।

নীতিমালা ও প্রশাসনিক কাঠামো: স্বাধীনতার পর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নিয়ে বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বিশেষ করে ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় অনেক সংস্কার আনা হয়। বইটিতে এই প্রশাসনিক কাঠামোর বিবর্তন এবং বিভিন্ন নীতিমালার বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়েছে। পরিশিষ্টে দুই দশকে প্রণীত আইন ও নীতির একটি তালিকা ও সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে জানতে আগ্রহী যে কেউ একটি সম্যক ধারণা পাবেন।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্যগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরলেও এই অভিযাত্রার চ্যালেঞ্জ ও সমস্যাগুলোর দিকেও আলোকপাত করেছে বইটি। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দুর্যোগের সময় প্রাপ্ত সুবিধার অপ্রতুলতা এবং তাঁদের সচেতনতা ও দক্ষতার দুর্বলতার চিত্রগুলোও তুলে ধরা হয়েছে।

স্থানীয় পর্যায়ের উদ্যোগ: দেশি-বিদেশি গবেষক বা পরামর্শকদের বিভিন্ন তত্ত্ব ও কৌশলের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের উদ্ভাবিত অভিযোজন পদ্ধতির সমন্বয় না ঘটাতে পারলে কোনো উদ্যোগই টেকসই হয় না। স্থানীয় জনগণ ও এনজিওগুলোর ভূমিকা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ। গওহার নঈম ওয়ারা তুলে ধরেছেন কীভাবে স্থানীয় জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং তাঁদের ঐতিহ্যবাহী জ্ঞান দুর্যোগের সময়ে টিকে থাকা ও পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় সহায়ক হয়েছে।

প্রযুক্তির ব্যবহার ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন: একমাত্র শিক্ষা ও গবেষণাই জীবন বদলায়। আবার একমাত্র প্রযুক্তিই শিক্ষা ও গবেষণাকে সাহায্য করে। প্রযুক্তিগত অগ্রগতি ও অবকাঠামো উন্নয়ন বাংলাদেশকে দুর্যোগ মোকাবিলায় সাফল্য এনে দিয়েছে। এ বইয়ে মুঠোফোন প্রযুক্তির ব্যবহার, আগাম সতর্কীকরণ ব্যবস্থা ও সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণের মতো বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও শিক্ষা: আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের পারস্পরিক সহযোগিতা এবং অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা থেকে শেখার বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে এতে। বিশেষ করে কীভাবে জাতিসংঘসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার সহযোগিতায় বাংলাদেশ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার একটি শক্তিশালী কাঠামো গড়ে তুলেছে, তা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। তা ছাড়া দুর্যোগবিষয়ক বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পরিকল্পনা, কর্মকাঠামো, আদেশ, আইন ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা অর্জনের জন্য বইটি খুবই উপকারী।

সক্ষমতা বৃদ্ধি: বাংলাদেশের জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা–সম্পর্কিত গবেষণা ও প্রকল্প বাস্তবায়নে জন্য যে সহায়তা পাওয়া যায়, স্থানীয় পর্যায়ে দক্ষতা না থাকার জন্য তার একটা বড় অংশ ব্যবহার করা যায় না। গওহার নঈম ওয়ারার লেখনী সহজবোধ্য ও তথ্যনির্ভর। বইটি বাংলাদেশি নীতিনির্ধারক, গবেষক ও উন্নয়নকর্মীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করে। বইয়ের ভাষা এতটাই সহজ ও প্রাঞ্জল যে যেকোনো পাঠক, যিনি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বা জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে আগ্রহী অথবা শিক্ষার্থী—সবার জন্য শিক্ষণীয় ও উপভোগ্য হতে পারে।

পর্যবেক্ষণ

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্যগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরলেও এই অভিযাত্রার চ্যালেঞ্জ ও সমস্যাগুলোর দিকেও আলোকপাত করেছে বইটি। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, জনসংখ্যার ঘনত্ব, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, সর্বোপরি রাষ্ট্রের নানান প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে এখানে। একই সঙ্গে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দুর্যোগের সময় প্রাপ্ত সুবিধার অপ্রতুলতা এবং তাঁদের সচেতনতা ও দক্ষতার দুর্বলতার চিত্রগুলোও তুলে ধরা হয়েছে।

তবে বইটি নিয়ে আমার একটি পর্যবেক্ষণ রয়েছে। প্রথমত, স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সরকারের সমন্বয় ও ক্ষুদ্র উদ্যোগগুলো নিয়ে আরও বিশদ আলোচনা করা যেতে পারত। কিছু ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দুর্বলতা এবং দুর্নীতি নিয়ে আরও খোলামেলা বিশ্লেষণ করা যেত, যা বইটিকে আরও সমৃদ্ধ করত।

দ্বিতীয়ত, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় জাতীয় পর্যায়ের পাশাপাশি স্থানীয় পর্যায়ে সক্ষমতা বৃদ্ধি আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ। স্থানীয় পর্যায়ে দুর্যোগসমূহ, জীবন–জীবিকায় তার প্রভাবসম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ, প্রয়োগ ও মূল্যায়নে স্থানীয় মানুষ ও প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বৃদ্ধি বইটিতে তেমন গুরুত্বসহকারে স্থান পায়নি, যেটি বইটির মূল উদ্দেশ্যকে আরও শক্তিশালী করতে পারত।

তৃতীয়ত, বিষয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রসঙ্গ সংযোজিত হলে ভালো হতো। বাংলাদেশের দুর্যোগগুলোর মধ্যে দাবদাহ একটি বড় দুর্যোগ। সেখানে শৈত্যপ্রবাহের পাশাপাশি দাবদাহ নিয়ে আলোচনা প্রাসঙ্গিক ছিল। জনগণের শারীরিক স্বাস্থ্য নিয়ে একটি পুরো অধ্যায় আছে, কিন্তু সেখানে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে তেমন কিছু চোখে পড়েনি। দুর্যোগের সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যের সম্পর্ক এখন বৈজ্ঞানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত সত্য। বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্য মোকাবিলার পরিকাঠামো খুবই দুর্বল। মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি আলোকপাত বইটির পূর্ণতা পেতে সাহায্য করত।

তা ছাড়া অধ্যায়গুলো আরও সুবিন্যস্ত হতে পারত বলে মনে হয়। দুর্যোগগুলো এক সারিতে আলোচনা করে তার প্রভাবগুলোকে পরে স্থান দেওয়া যেত। যেমন নতুন দুর্যোগ বজ্রপাত ও বন্যা পরিস্থিতি অধ্যায় দুটির মাঝখানে হুমকির মুখে জনগণের স্বাস্থ্য অধ্যায়টি রয়েছে।

বইটি প্রকাশের পূর্বে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নিয়ে যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করেন, তাঁদের মন্তব্য নিলে দুর্বলতা যথাসম্ভব কমানো যেত। আশা করি পরবর্তী সংস্করণে এসব দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারবে।

বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার গতিপথ বুঝতে স্বাধীনতার ৫০ বছর: দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের অর্জন বইটি নতুন প্রজন্মের গবেষকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে কাজ করবে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার খাতে বাংলাদেশের অর্জনগুলো এই বইয়ের মাধ্যমে পাঠকদের কাছে নতুনভাবে উন্মোচিত হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে গওহার নঈম ওয়ারা বাংলাদেশের অর্জনগুলোর প্রতি যেমন শ্রদ্ধা জানিয়েছেন, তেমনি ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় দেশের জন্য নির্দেশনা প্রদানে চেষ্টা করেছেন। বিশেষ করে যাঁরা এই খাতে কাজ করছেন, তাঁদের জন্য এটি একটি সমৃদ্ধ ও প্রাসঙ্গিক রেফারেন্স হিসেবে বিবেচিত হোক, এটাই কাম্য।

স্বাধীনতার ৫০ বছর: দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের অর্জন

সম্পাদক ও সংকলক: গওহার নঈম ওয়ারা

প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন

প্রথম প্রকাশ: অক্টোবর ২০২৩

গোলাম রব্বানী স্বাস্থ্য ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক গবেষক, পরিবেশকর্মী ও প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা। যুক্তরাজ্যের ডিপার্টমেন্ট অব হেলথ সায়েন্স, ইউনিভার্সিটি অব ইয়র্কে কর্মরত।

ই–মেইল: rabbani.jessore@yahoo.com