খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটক
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটক

প্রতিক্রিয়া

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কৈফিয়ত

কয়েক দিন ধরে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক কিছু খবর অনলাইন ও প্রিন্ট মিডিয়ায় ছাপা হচ্ছে। বিশেষ করে গত ২৩ অক্টোবর প্রথম আলোয় একটি সম্পাদকীয় ছাপা হয়। আর ২৮ অক্টোবর প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণে রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক ড. তুহিন ওয়াদুদের একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে। দাপ্তরিকভাবে এসব লেখার উত্তর না দিয়ে আমি ব্যক্তিগতভাবে কিছু লেখা বাঞ্ছনীয় বলে মনে করছি।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারজন শিক্ষককে ১ ও ২ জানুয়ারির ঘটনার বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে। উপাচার্যের ব্যক্তিগত ইচ্ছায় কাউকে ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য চিঠি দেওয়া হয়নি। ১ ও ২ জানুয়ারির ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গঠিত ডিনস কমিটির প্রতিবেদন সিন্ডিকেট কর্তৃক গৃহীত হয় এবং পরবর্তী আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য উপাচার্যকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। উপাচার্য সেই দায়িত্ব পালন করেছেন মাত্র।


অনলাইনে প্রকাশিত লেখাটিতে বলা হয়েছে, ‘তদন্ত ছাড়াই সংশ্লিষ্টতা প্রতীয়মান হওয়া অসৎ উদ্দেশ্যমূলক’। যেকোনো ঘটনার প্রাথমিক প্রমাণ যদি কর্তৃপক্ষের কাছে থাকে, তাহলে তার জন্য কারও কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া একটি স্বাভাবিক প্রশাসনিক প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার একটা পর্যায়ে তদন্ত কমিটি গঠিত হবে এবং তদন্তের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটে দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদেরা সদস্য হিসেবে আছেন। তা ছাড়া শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সমর্থনের অভিযোগ তুলে কাউকে চিঠি দেওয়া হয়নি। শিক্ষকদের লাঞ্ছনা, প্রশাসন ভবনে নারী-পুরুষকে আটকে রাখা, একাডেমিক ও প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে বিঘ্ন সৃষ্টি করার বিষয়ে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মতপ্রকাশের কোনো পথ অবরুদ্ধ করেননি; বরং ৩০ বছর ধরে চলে আসা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যকে সমুন্নত রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। ১৯৯০-এর অ্যাক্টের মাধ্যমে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হয়। অ্যাক্টে সুস্পষ্টভাবে ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক মতপ্রকাশ নিষিদ্ধ রয়েছে।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মতপ্রকাশের কোনো পথ অবরুদ্ধ করেননি; বরং ৩০ বছর ধরে চলে আসা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যকে সমুন্নত রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। ১৯৯০-এর অ্যাক্টের মাধ্যমে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হয়। অ্যাক্টে সুস্পষ্টভাবে ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক মতপ্রকাশ নিষিদ্ধ রয়েছে। খুলনার বিভিন্ন মতের রাজনীতিবিদসহ স্থানীয় জনসাধারণ এই ক্যাম্পাসকে রাজনীতিমুক্ত রেখেছেন। শিক্ষার্থীরাও কখনো এই ঐতিহ্যকে ভাঙতে উৎসাহী হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৪টি সাংস্কৃতিক সংগঠন রয়েছে। এসব সংগঠনের শিক্ষার্থী সদস্যরা একাডেমিক কার্যক্রমের পাশাপাশি সংগীত, আবৃত্তি, বিতর্ক, নাটক প্রভৃতি নিয়ে ব্যস্ত থাকে। পরীক্ষার সময় ছাড়া বিকেল থেকে রাত অবধি ক্যাম্পাস ওই সব শিক্ষার্থীর পদভারে মুখরিত থাকে। কিছুসংখ্যক শিক্ষার্থীর দাবির যৌক্তিকতা বিবেচনায় নিয়ে ২০১৯ সালের নভেম্বরেই অধিকাংশ দাবি পূরণ করা হয়। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ বছরের তুলনামূলক চিত্র দিয়ে স্পষ্ট করা হয় যে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে বেতন-ফি অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে অধিকাংশ ‌ক্ষেত্রেই বেশি নয়। আবাসিক সংকট সমাধানের মতো দাবি পর্যায়ক্রমে পূরণেরও আশ্বাস দেওয়া হয়। উল্লেখ্য, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সুবিধা-অসুবিধা দেখভালের জন্য ছাত্রবিষয়ক পরিচালকের দপ্তরে নিয়োজিত শিক্ষকেরা সর্বদা তৎপর থাকেন।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ তুলে বলা হয়েছে, তিনি একজন নারী প্রার্থীকে হাফপ্যান্ট পরা নিয়ে প্রশ্ন করেছেন। ওই নারী প্রার্থী নিজেই ফেসবুকে ‘হাফপ্যান্ট’ প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেছেন, তিনি ‘মানসিক ধর্ষণের’ শিকার হয়েছেন। কোনো প্রার্থীকে এ জাতীয় প্রশ্ন করা হয়নি।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করার পর একজন শিক্ষার্থীকে বাংলা ডিসিপ্লিনে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। সেই খণ্ডকালীন নারী শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যানটিন ও ক্লাবে নিয়মিত জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের সামনে ধূমপান করতেন। কর্তৃপক্ষের কাছে কয়েকজন জ্যেষ্ঠ শিক্ষক এ বিষয়ে মৌখিকভাবে অভিযোগ করেন। যত দূর মনে পড়ে, ওই খণ্ডকালীন শিক্ষক প্রার্থী হিসেবে নিয়োগ বোর্ডে উপস্থিত হলে তাঁকে শুধু এতটুকু জিজ্ঞাসা করা হয়, ‘বাঙালির আবহমান সংস্কৃতি, কৃষ্টি, ঐতিহ্য ও মূল্যবোধের সঙ্গে প্রকাশ্য ধূমপান খাপ খায় কি না এবং এ ক্ষেত্রে নারীর প্রকাশ্য ধূমপানই-বা সমাজে কতটুকু গ্রহণযোগ্য।’ এই জিজ্ঞাসা যথার্থ কি না, তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। তবে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে। কিন্তু কোনো উত্তর মেলেনি। এই জিজ্ঞাসাকে মানসিক ধর্ষণ বলে আখ্যায়িত করে উপাচার্যকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করা হয়েছে।
অধ্যাপক সুজিত সরকার সম্পর্কে বলা হয়েছে, এ বিষয়ে তাঁর মন্তব্যের কারণে তাঁকে বিশেষজ্ঞ প্যানেল থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে, যা আদৌ সত্য নয়। মেয়াদ শেষে ২০১৮ সালের ২২ ডিসেম্বর সিন্ডিকেটে এই নিয়োগ কমিটি পুনর্গঠিত হয়। আর তিনি প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ২০২০ সালের জানুয়ারিতে। আশা করি প্রতিক্রিয়ার কারণ পাঠক বিচার করবেন।

বিভিন্ন ভবনের নির্মাণ-দুর্নীতির বিষয়ে বলা হয়েছে, জীবনানন্দ দাশ ভবনে ৫ ইঞ্চির জায়গায় ৩ ইঞ্চি ছাদ দেওয়া হয়েছে। ওই ভবনের মোট ৭টি কক্ষের বিভিন্ন জায়গায় এই সমস্যা ধরা পড়ে। ছাদ ঢালাইয়ের সময় কোনো উপাচার্য দাঁড়িয়ে থাকেন কি না, তা জানা নেই। তবে এ ধরনের কাজ প্রশ্রয় দিয়ে উপাচার্য যদি ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হন, তাহলে অবশ্যই তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বর্তমান উপাচার্য কাউকে প্রশ্রয় কিংবা ছাড় দেননি। এ বিষয়ে দোষী ব্যক্তিরা শাস্তি পেয়েছেন। সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারের অর্থায়নে কুয়েটের বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ও ডিজাইন অনুযায়ী রিট্রোফিটিং (পুর্নবিন্যাস) করা হয়েছে। তবে ভবনটি যে অনিরাপদ, সে কথা কেউ বলেননি। উল্লেখ্য, এ বিষয়ে ঠিকাদারসহ শাস্তিপ্রাপ্ত প্রকৌশলীরা আরোপিত শাস্তির বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট পিটিশনও দায়ের করেছেন।
বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের টেন্ডারে অনিয়মের কথা উল্লেখ করে জি কে শামীমকে (জিকেএস) কাজ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। দুবার এই ভবনের টেন্ডার হয় এবং দুবারই সর্বনিম্ন দরদাতা হয় ডিসিএল( ঢালি কনস্ট্রাকশন লিমিটেড, ডিসিএল) । দ্বিতীয়বারে জিকেএস কে সঙ্গে নিয়ে ডিসিএল টেন্ডারে অংশ নেয় এবং সর্বনিম্ন দরদাতা হয়। এখানে কর্তৃপক্ষের কিছু করণীয় ছিল না। জিকেএস বা জি কে শামীমকে তখন দেশের মানুষ চিনত কি না, জানি না। কারণ কার্যাদেশ হয় ২০১৮ সালের প্রথমার্ধে।

উপাচার্যের ১৪ জন আত্মীয়কে নিয়োগের কথা বলা হয়েছে। উল্লিখিত সংখ্যার চেয়ে অনেক কমসংখ্যক তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী যাঁদের বাড়ি উপাচার্যের নিজের এলাকায়, তাঁরা যথাযথ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে চাকরি পেয়েছেন। স্বাধীন বাংলাদেশের যেকোনো এলাকার যেকোনো মানুষের যেকোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরির আবেদন করার অধিকার রয়েছে। উপাচার্যের নিজের এলাকার কোনো মানুষ বা উপাচার্যের কোনো আত্মীয় আবেদন করতে পারবেন না বা চাকরি পাবেন না, এমন কোনো নিয়ম নিশ্চয়ই নেই। উল্লেখ্য, উপাচার্য ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগ বোর্ডের সদস্য নন। তবে দুঃখজনক যে উপাচার্যের নিজ জেলার কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পেলেই একটি মহল তাঁকে উপাচার্যের আত্মীয় বলে চিহ্নিত করতে উৎসাহ বোধ করে। চাকরিপ্রাপ্তদের একজনের চুরির দায়ে ধরা পড়ার বিষয়ে অসম্পূর্ণ মন্তব্য করা হয়েছে। কর্তৃপক্ষ তাঁকে চাকরিচ্যুত করে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। শেষে বলব, একজন লেখকের বা গবেষকের যেকোনো প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে কিছু লেখা বা মতপ্রকাশ অধিকতর অনুসন্ধানের অপেক্ষা রাখে। জনমনে যাতে বিভ্রান্তি সৃষ্টি না হয়, সে জন্য এটা দরকার।


মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামান খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য।