সবকিছু ভেঙে পড়ছে। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি, সম্পর্ক, বন্ধন, বন্ধুত্ব, সংসার, সভ্যতা থেকে শুরু করে সবকিছু। চাকরির বাজারে কান পাতুন, সেখানেও ভাঙনের শব্দ শোনা যাচ্ছে। তো সবকিছু ভেঙেচুরে কি বিলীন হয়ে যাচ্ছে? না, বরং ভেঙেচুরে নতুন অবয়ব নিয়ে দাঁড়াচ্ছে। প্রযুক্তির প্রাচুর্য আর বিজ্ঞানের অনন্য উৎকর্ষ আমাদের এমন এক সময়ের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, সেখানে প্রচলিত-পুরোনো সব ধ্যানধারণা বাতিলের খাতায় চলে যাচ্ছে। নতুন নতুন উদ্ভাবন যেন গলা বাড়িয়ে বলছে, ‘এসেছে নতুন শিশু, ছেড়ে দিতে হবে স্থান।’
একটু ভালো করে লক্ষ করলে দেখা যাবে, চাকরির বাজারেও এসেছে এক ‘নতুন শিশু’। তার নাম ‘রোবট’ এবং ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’। এই নবতর শিশুদের দুরন্তপনায় চাকরির নিয়োগ-প্রক্রিয়ায় চলছে এক প্রগাঢ় বিপ্লব। সেই বিপ্লবের সঙ্গী যদি আপনি না হতে পারেন, হে নতুন যুগের চাকরিপ্রত্যাশী যুবক, তবে আপনার পরাজয় অনিবার্য। তাই আসুন, সময় থাকতেই রোবট এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স তথা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে স্বাগত জানাই।
সারা বিশ্বে শুরু হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জয়জয়কার। বিশেষ করে, চাকরির নিয়োগ-প্রক্রিয়ায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ একটি আবশ্যিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী ম্যাগাজিন ফরচুন-এ প্রকাশিত বিশ্বের শীর্ষ ৫০০ প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মী নিয়োগ-প্রক্রিয়ায় অটোমেশন পদ্ধতির ব্যবহার শুরু করেছে বলে সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল। ওই প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, চাকরিপ্রত্যাশীদের সিভি থেকে বিভিন্ন শব্দ বিশ্লেষণের মাধ্যমে সবচেয়ে উপযুক্ত প্রার্থী খুঁজে বের করছে রোবট! রোবট ছাড়াও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং মেশিন লার্নিং টুল ব্যবহারের মাধ্যমে কর্মী নিয়োগের পদ্ধতি বিশ্বের বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে। যেমন সোশ্যাল মিডিয়ার অ্যাকাউন্ট বিশ্লেষণের মাধ্যমে ব্যক্তির চরিত্র ও বুদ্ধিমত্তা নির্ধারণপূর্বক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপক নিয়োগ দেয় ডিপসেন্স নামের একটি প্রতিষ্ঠান। সানফ্রান্সিসকো ও ভারতভিত্তিক এ প্রতিষ্ঠানটি জানাচ্ছে, তারা ব্যক্তির ফেসবুক, টুইটার, লিংকডইন ইত্যাদি সোশ্যাল মিডিয়ার অ্যাকাউন্ট বিশ্লেষণের কাজে ডেটা সায়েন্স ব্যবহার করে থাকে। সোশ্যাল মিডিয়ায় আপনি কী ধরনের ছবি পোস্ট করছেন, কী লিখছেন, কী ধরনের খবর শেয়ার করছেন, আপনার প্রোফাইলের ছবিটা কেমন ইত্যাদি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে বিশ্লেষণ করে আপনার আচরণগত দক্ষতা নির্ণয় করা সম্ভব।
এ ছাড়া এখন ব্যক্তির কণ্ঠস্বর, কথা বলার ভঙ্গি, শব্দচয়ন এবং কথা বলার সময় চেহারার পরিবর্তন বিশ্লেষণ করেও চাকরি দেওয়া হচ্ছে! নিয়োগ-প্রক্রিয়ায় এ নতুন পদ্ধতি ব্যবহার করে রীতিমতো ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে হায়ার ভিউ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। ব্যাপারটা সরেজমিনে দেখতে ও বুঝতে হায়ার ভিউয়ের কার্যালয় পরিদর্শনে গিয়েছিলেন জনপ্রিয় টেলিভিশন অনুষ্ঠান মুভিং আপস্ট্রিম অ্যাবাভ-এর প্রতিনিধি জেসন বেল্লিনি। যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ জর্ডানে অবস্থিত কার্যালয়টি পরিদর্শনের পর জেসন বেল্লিনি ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল-এ লিখেছেন, প্রতিষ্ঠানটি ইউনিলিভার, হিলটনসহ বিশ্বের অর্ধশতাধিক কোম্পানির জন্য ডিজিটাল ইন্টারভিউয়ের মাধ্যমে কর্মী বাছাই করে দিয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে তারাও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে। তবে তাদের প্রয়োগটা ভিন্ন। অনলাইনে সাক্ষাৎকার গ্রহণের সময় সাক্ষাৎকারদাতার কণ্ঠ, উচ্চারণ, শব্দচয়ন, বাচনভঙ্গি, মুখভঙ্গি ইত্যাদি বিশ্লেষণ করে সেই ব্যক্তির আইকিউ, মেধা, দক্ষতা ও যোগ্যতা শনাক্ত করে থাকে হায়ার ভিউ। হায়ার ভিউয়ের প্রধান মনোবিজ্ঞানী নাথান মনড্রাগন বলছেন, তাঁরা এ কাজে এমন একটি সফটওয়্যার ব্যবহার করে থাকেন, যার মাধ্যমে ব্যক্তির হাসি, মুখভঙ্গি, চোখের পলক ফেলানো ইত্যাদি বিশ্লেষণ করা যায়। এর মাধ্যমে ওই ব্যক্তির আবেগ, অনুভূতি ও ব্যক্তিত্ব নির্ধারণ করা যায়। সাক্ষাৎকারদাতা কথা বলার সময় স্বতঃস্ফূর্তভাবে কথা বলছেন নাকি ভয় নিয়ে কথা বলছেন, সঠিক তথ্য দিচ্ছেন নাকি ভুল তথ্য দিচ্ছেন, সত্য বলছেন নাকি মিথ্যা বলছেন—এই সবকিছু তাঁর মুখভঙ্গি, কণ্ঠস্বর ও শারীরিক ভাষা দেখে শনাক্ত করে ফেলে ওই সফটওয়্যার। সফটওয়্যারটির নাম ফেস অ্যানালাইজার।
সুতরাং, চাচা-মামার বদৌলতে চাকরি পাওয়ার দিন সমাহিত। আপনি কতটা পরিশ্রমী, কতটা ত্যাগী, কতটা নিবেদিতপ্রাণ, কতটা ভদ্র, কতটা দলগত কাজে পারদর্শী—এসব ব্যাপারে সুপারিশ করার জন্য এখন আর চাচা-মামার প্রয়োজন নেই। এখন রোবটই এসব কাজে সবচেয়ে পারদর্শী। রোবট এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগের মাধ্যমে বের করে আনছে আপনার ভেতরের সব খবরাখবর। আপনি ঠিক কোন কাজের উপযুক্ত, তা নির্ধারণ করে দিচ্ছে ডেটা সায়েন্স, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, মেশিন লার্নিং টুল ইত্যাদি।
আপনি আপনার ফেসবুক, টুইটার, লিংকডইন, ইনস্টাগ্রাম ইত্যাদিতে কী পোস্ট করছেন, কী শেয়ার করছেন, কোন কোন সাইট ভিজিট করছেন, কী ধরনের গ্রুপে বা পেজে সময় কাটাচ্ছেন, কোন কোন হোটেল সার্চ করছেন, কী ধরনের ই-কমার্স সাইট ভিজিট করছেন—এই সবকিছুর অনলাইন ফুটপ্রিন্ট ভার্চ্যুয়াল জগতে থেকে যাচ্ছে। ফলে আপনার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, পছন্দ, অপছন্দ সবকিছুই অনলাইন থেকে বের করা সম্ভব। আমরা অনেকেই ভেবে থাকি যে আমাদের সোশ্যাল মিডিয়ার অ্যাকাউন্টে প্রাইভেসি দেওয়া আছে, সুতরাং আমি কোথায় কী দেখছি, কী ছবি ডাউনলোড করছি, কোন পোস্টে লাইক দিচ্ছি, কোন পোস্টে কমেন্ট করছি—এসব বোধ হয় কেউ দেখছে না। এ ধারণা সঠিক নয়। কারণ, আপনার সব ডেটাই উন্মুক্ত, এখানে প্রাইভেট ডেটা বলে কিছু নেই। আপনি লক্ষ করে দেখবেন যে যখনই আপনি কোনো অ্যাপ ইনস্টল করেন অথবা কম্পিউটারে কোনো সাইটে নিবন্ধন করেন, তখন শুরুতেই বলা হয় যে তাদের টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশন অনুযায়ী তারা আপনার ডেটা ব্যবহার করবে। আপনার ডেটার ওপর আপনার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। সোশ্যাল মিডিয়া প্রতিষ্ঠানগুলো আপনার ডেটা যাচ্ছেতাইভাবে ব্যবহার করতে পারে এবং তারা তা করছেও। গত মার্চে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের তথ্য একটি রাজনৈতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের কাছে চলে যাওয়ার কথা স্বীকার করে এর জন্য ক্ষমা চেয়েছেন ফেসবুকের সহ–প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ। এর আগে অভিযোগ ওঠে, কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা নামের একটি প্রতিষ্ঠান ফেসবুক অ্যাপের মাধ্যমে ব্যবহারকারীদের তথ্য সংগ্রহ করে তাদের রাজনৈতিক গ্রাহকের জন্য এসব তথ্য ব্যবহার করেছে। কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার সেই রাজনৈতিক গ্রাহক আর কেউ নন, স্বয়ং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প! গত মার্কিন নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষে প্রচারণার জন্য কনটেন্ট তৈরিতে ওই সব তথ্য ব্যবহার করেছিল কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা।
অতএব, বলা নিষ্প্রয়োজন যে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমাদের সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা এখন সময়ের দাবি।
ড. মো. সবুর খান ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান