আরও একটি পৌষ সংক্রান্তিমুখী। মাঘ সমাগত। শীত এখন ভরা যৌবনে। শীতের মধ্যে গরম পোশাক পরে পিঠাপুলির গুণকীর্তন করা সোজা। গরম লেপের তলে শুয়ে পি বি শেলির ‘ইফ উইন্টার কামস, ক্যান স্প্রিং বি ফার বিহাইন্ড’ থেকে শুরু করে সুকান্তের ‘হে সূর্য, শীতের সূর্য!’—এই রকমের কাব্য পড়তেও ভালো লাগে। কিন্তু শহর–গ্রামের আনাচকানাচে ও শহরের ফুটপাতের ওপর যেসব ছায়া-শরীর প্রতিটি নির্জন শীতরাতে কেবল পরস্পরের উত্তাপ নিয়ে জড়াজড়ি করে নিশিযাপন করে, তাদের কাছে শীত কাব্য হয়ে আসে না। আসে যম হয়ে। তাদের একাংশ ঠান্ডায় মারা যায়।
তাদের কোনো সঠিক শুমারি হয় না। অনুমান ও অনেকটা আন্দাজের ওপর নির্ভর করেই এই হতভাগ্যদের সংখ্যা ধার্য করা হয়।
দেশের সবচেয়ে উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ে এখন যে শীত অনুভূত হচ্ছে, তা নিয়ে কাব্য করা চলে না। সেখানকার শীত আগের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। সেখানে ৪ থেকে ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে তাপমাত্রা ওঠানামা করছে। উত্তরের হিমেল বাতাসের সঙ্গে নেমে আসছে হাড়কাঁপানো শীত। বিশেষ করে সন্ধ্যা থেকে সকাল নয়টা পর্যন্ত মাত্রাতিরিক্ত শীত অনুভূত হচ্ছে। জবুথবু হয়ে পড়েছে জনজীবন। বিশেষ কাজ ছাড়া ঘর থেকে বের হচ্ছে না অনেকে।
বিপাকে পড়েছে খেটে খাওয়া মানুষ। কর্মহীন হয়ে পড়েছে তারা। হাটবাজারে ক্রেতা–বিক্রেতার ভিড় কম। ক্রেতার অভাবে দোকানদার ও যাত্রীর অভাবে পরিবহনকর্মীরা রাস্তার পাশে আগুন জ্বেলে শীত তাড়াচ্ছেন। স্কুল–কলেজ ও সরকারি অফিসে উপস্থিতি কম। রোদ উঠলেও তার তেজ অত্যন্ত ম্লান। সন্ধ্যা হতেই সুনসান হচ্ছে শহর।
আবহাওয়া কর্মকর্তারা বলছেন, কুয়াশা থাকলে শীত কম থাকে। এবার কুয়াশা না থাকার কারণেই ঘনীভূত হয়েছে শীতের প্রকোপ। সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে শীতের তীব্রতা বাড়ে। শীতের কারণে পঞ্চগড় এবং এর আশপাশের জেলায় শিশু ও বয়স্করা নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। ডায়রিয়া, শ্বাসকষ্ট, সর্দি-কাশিসহ হৃদ্রোগের প্রকোপ সেখানে বেড়ে গেছে। প্রতিদিন হাসপাতালে শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে মানুষ ভর্তি হচ্ছে। বিশেষ করে শিশুরা আক্রান্ত হচ্ছে বেশি।
উত্তরবঙ্গের মানুষের একটি বিরাট অংশ তীব্র দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করে। গরম কাপড় কেনা বা জোগাড় করা সবার পক্ষে সম্ভব হয় না। যেখানে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা, সেখানে এসব মানুষ কত দিন এভাবে টিকে থাকতে পারবে, সেটি একটি বিরাট প্রশ্ন।
পঞ্চগড় পৌরসভার হিসাব অনুযায়ী, পৌর এলাকায় ২০ হাজারের বেশি অসহায় ছিন্নমূল ও দুস্থ মানুষ বসবাস করে। জেলা প্রশাসকের কার্যালয় বলছে, জেলার প্রায় দুই লাখ দুস্থ মানুষ আছে। তাদের শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচাতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত যে পরিমাণ কম্বল বিতরণ করা হয়েছে, তা খুবই অপ্রতুল। স্থানীয় লোকজনের বক্তব্য থেকে জানা যাচ্ছে, এই শীতের রাতে দুই–তিনটা লেপ না হলে শীত মানতে চায় না। সেখানে ত্রাণের পাতলা কম্বল এই তীব্র শীত ঠেকাবে কী করে?
শীতকবলিত এই জনপদে কতজন মানুষের শীত মোকাবিলা করার মতো পোশাক ও বাসস্থান আছে, সে সমীক্ষা আমাদের সামনে নেই। তথাপি সংবাদমাধ্যমের অসম্পূর্ণ ‘সমীক্ষায়’ যা প্রকাশ পাচ্ছে, তাতে শীতকবলিত হতদরিদ্র মানুষের প্রতি সরকারের, প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের অমানবিক ঔদাসীন্যের ছবি ভালোভাবেই প্রকাশ পাচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে, শীতের কামড় থেকে এই ভাগ্যাহত মানুষগুলোকে রক্ষা করার জন্য নৈশ আশ্রয়ের ব্যবস্থা
থাকা উচিত। কারণ, বহু মানুষ এমন ঘরবাড়িতে বসবাস করে, যা এই শীতের ছোবল থেকে তাদের রক্ষা করতে পারবে না।
স্থানাভাব বা তহবিলের সীমাবদ্ধতা এই মানুষগুলোকে রক্ষা করতে না পারার কারণ হতে পারে না। এর একমাত্র কারণ হতে পারে নিছকই সদিচ্ছার অভাব এবং ইচ্ছাকৃত ঔদাসীন্য। বহু মানুষ আছে, যাদের কোনো ঘরবাড়িই নেই।
বিশেষ করে শহরের উড়ালসাঁকোর নিচে, বিভিন্ন অলিগলিতে প্রচণ্ড শীতের মধ্যে বহু গৃহহীন মানুষ শুয়ে থাকে।
কী লাগে কয়েকটি শীতকালীন নৈশ আশ্রয় তৈরি করতে? মাথার ওপর টিন কিংবা টালির আচ্ছাদন, চারটি দেয়াল আর দু-একটি কপাট দেওয়া জানালা। হাজার হাজার কোটি টাকার তহবিল নিয়ে রাষ্ট্র এমন কয়েকটি অকিঞ্চিৎকর মূল্যের নৈশ আশ্রয় বানাতে পারে না?
যে অর্থে রাষ্ট্র প্রতিটি গ্রামকে শহরের সুবিধায় আনার প্রত্যয় ব্যক্ত করে, শহরের সব পার্ক-উদ্যানকে নানা রঙে রঞ্জিত করতে তৎপর থাকে, তার চেয়ে অনেক কম ব্যয়ে হতভাগ্য নিরাশ্রয়দের শীতের রাতে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দেওয়া যায়। তাতে শহরের সৌন্দর্যায়নের কাজে কোনো ব্যাঘাত হওয়ারও কথা না।
শুধু পঞ্চগড় বা উত্তরবঙ্গ নয়, খোদ রাজধানীতেও বহু মানুষ শীতে কাঁপতে থাকে। রাষ্ট্রের অমানবিক ঔদাসীন্যের কারণে খোলা আকাশকে চাঁদোয়া বানিয়ে শহুরে গরিব, ভবঘুরে, ভিখারি ও নিরাশ্রয় মানুষ পৌষের অকালবর্ষণ মাথায় করে রাত যাপন করছে। পঞ্চগড়ের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে শুরু করে রাজধানীর আশ্রয়হীনেরা অসংগঠিত। তারা ইউনিয়নবদ্ধ নয়। তাই তাদের আশ্রয়ের অধিকার নিয়ে কোনো দাবিমুখর হতে দেখা যায় না। ধনীরা তাদের প্রতি দয়াপরবশ হয়ে তাদের শীতের কাপড় অথবা নৈশ আশ্রয়স্থল বানিয়ে দিতে চায়। এই দয়া করার দৃষ্টিভঙ্গিই আমাদের তাদের অধিকার সম্পর্কে উদাসীন করে তোলে। আশ্রয়হীনের জন্য নিদেনপক্ষে শীতকালীন অস্থায়ী নৈশ আশ্রয়স্থলের কথাটি কখনো আমাদের মনে উদয় হয় না।
সবার কাছেই এখন স্পষ্ট হয়েছে, আমাদের ঋতুচক্রের গতি–প্রকৃতি আর আগের মতো নেই। আবহাওয়া ক্রমেই চরমভাবাপন্ন হয়ে উঠছে। গরমকালে তাপমাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে। শীতকালে তা নামছে অস্বাভাবিকভাবে। এই পরিবর্তিত আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে গেলে জনগণের জীবনযাপন ও আবাসনব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা দরকার।
উত্তরাঞ্চলে শীত তীব্রভাবে জেঁকে বসে সেটা আমরা জানি। কিন্তু সেই তীব্রতা ফিবছরই বেড়ে চলেছে। সেই তুলনায় সেখানকার মানুষের শীত মোকাবিলা করার মতো আবাসন নির্মাণ ও গরম কাপড় কেনার সক্ষমতা অর্জন করা সম্ভব হয়নি। এ ক্ষেত্রে সরকারকেই সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে।
সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর জে্যষ্ঠ সহসম্পাদক
sarfuddin2003@gmail.com