‘আমার মেয়ের আত্মহত্যার জন্য পরিবারকে দায়ী করবেন না’

সড়কে পড়ে থাকা মেয়ের লাশের পাশে আর্তনাদ করছিলেন বাবা স্বপন ধর। ময়মনসিংহ নগরের স্বদেশী বাজার এলাকায়। ১৩ মার্চ, ২০২২
ছবি: প্রথম আলো

গত ২৯ মার্চ প্রথম আলো পত্রিকায় ‘আত্মহত্যার “মহামারি” ঠেকাতে কতটা প্রস্তুত আমরা’ শিরোনামে একটি মতামত প্রকাশ করা হয়। সেখানে উল্লেখ করা একটি বিষয়ের প্রকৃত ঘটনা সবার জানা উচিত বলে আমি মনে করি।

প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সম্পাদক মনোজ দে ওই মতামতে লিখেছেন, ‘ময়মনসিংহের কিশোরী আত্মহত্যার আগে তার ফেসবুকে ইংরেজি  ও বাংলায় বড় একটি পোস্ট শেয়ার করে। তাতে সে তার পরিবার, বিশেষ করে মা ও ভাইকে আত্মহত্যা করার জন্য অভিযুক্ত করেছে। লিখেছে, তার মরার ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু বাধ্য হয়েছে। পরিবারের অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ সহ্য করতে পারেনি সে।’

আমি ময়মনসিংহের সেই কিশোরীর বাবা। আমার মেয়ে নিতান্ত আবেগতাড়িত হয়ে এসব কথা লিখেছে। সে মূলত বয়ঃসন্ধিকালের বিষণ্নতায় ভুগছিল। করোনার বন্দিদশায় সে আরও বিষণ্ন হয়ে পড়ে। সে তার লেখায় আত্মহত্যার বহুবার চেষ্টার কথাও লিখেছিল যা পরিবার সামান্যতম ধারণা করতে পারেনি। সম্প্রতি সে নিজেই জানায়, তার কোনো পড়া মনে থাকে না, প্রচণ্ড মাথাব্যথা করে, খেতে ইচ্ছা করে না, ভালো লাগে না। সাথে সাথে সেই দিনই আমরা চিকিৎসকের শরণাপন্ন হই।

প্রথমে জানুয়ারি মাসে নিউরো চিকিৎসক গৌতম সাহাকে দেখাই, যার প্রেসক্রিপশন এখনও আমাদের কাছে রয়েছে। ডা. গৌতম সাহা পাশাপাশি একজন মনোচিকিৎসক দেখানোর জন্যও বলেন। এর পরপরই আমি ও আমার স্ত্রী মনোচিকিৎসক বিধান চন্দ্র রায় পোদ্দারের বাসায় গিয়ে পরামর্শ নেই। তিনি মেয়েকে মোবাইল ফোন ও কম্পিউটার থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেন। এরপরও মাথাব্যথা না কমায় ডা. গৌতমের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খাওয়া শুরু করে। এরই মাঝে গত ১১ মার্চ আমার এবং আমার ছেলের জন্মদিনে কেক এনে কেক কেটে জন্মদিন পালন করে। সেদিন সে সেলফি ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্টও দেয়, যা এখনও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমটিতে রয়েছে।

এ পরিবার মেয়ে বলে তাকে কখনোই ছেলের থেকে কম আদর করত না। ঘটনার একদিন আগে বাইরে যাওয়ার সময় যে পোশাক পরতে চেয়েছিল তা দৃষ্টিকটু ছিল। আমার স্ত্রী ও ছেলে শুধু এইটুকুই সাবধান করছিল। এর জন্য যে সে আত্মহত্যা করে ফেলবে সেটি কল্পনাতীত। মূলত আমার মেয়ে ভেতরে-ভেতরে বিষণ্নতার রোগী হয়ে পড়েছিল যা সে আমাদের কখনো বুঝতে দেয়নি।

বর্তমানে একজন হতভাগ্য বাবা হিসেবে আমি মৃতপ্রায়, বেদনায় জর্জরিত। আমার ছেলের সামনে ভর্তি পরীক্ষা। সে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। অথচ বড় ভাই হয়ে বোনের আবদার মেটাবার জন্য তাঁর চেষ্টার কমতি ছিল না। আমার স্ত্রী, যিনি সবচেয়ে বেশি যত্নবান ছিলেন মেয়ের ব্যাপারে, তিনিও নিথর। কোনো সান্ত্বনাই আমাদের কাছে অবশিষ্ট নেই। তাই এ অবস্থায় আমার মেয়ের আত্মহত্যার বিষয়টি নিয়ে আমাদের পরিবারকে চিতার আগুনে দগ্ধ করা থেকে বিরত থাকার জন্য সবিনয় অনুরোধ জানাচ্ছি।

স্বপন ধর

ময়মনসিংহ