২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টবিরোধী তীব্র আন্দোলনের মুখে পড়ে একটানা ৩৪ বছর ক্ষমতায় থাকা বামফ্রন্ট সরকার বিদায় নিয়েছিল রাজ্যপাট থেকে। ক্ষমতায় এসেছিলেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেদিন এ রাজ্যের দিকে দিকে ধ্বনিত হয়েছিল মমতার জয়গান। শুধু কি তা-ই, তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীর মুখে মুখে ভেসে উঠেছিল ৩৪ নয়, এবার ৫০ বছর আবার শাসন করবে মমতা। আর তখনই খোদ তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতা ও বিধায়ক ঘোষণা দিয়েছিলেন, বামফ্রন্টের সঙ্গে আর কোনো সম্পর্ক নয়। তাদের মুখও দেখবেন না। কথা বলবেন না। তাদের সঙ্গ একসঙ্গে কোনো রেস্তোরাঁয়ও চা খাবেন না। তাদের সঙ্গে নিজেদের পরিজন বা কেউ বিবাহবন্ধনেও আবদ্ধ হবেন না।
কিন্তু দীর্ঘ ১১ বছরেও মমতার দলের নেতারা পারেননি সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে। ক্ষমতায় আসার মাত্র ১১ বছর কাটতে না কাটতেই মমতার দল জড়িয়ে গেল দুর্নীতিতে। যে মমতাকে দল বলত সততার প্রতীক, নিঃস্বার্থ নেত্রী, আপসহীন নেত্রী; সেই মমতার গায়ে আঁচড় লেগেছে দুর্নীতির। মমতা হয়তো বুঝতে পারেননি, তাঁর দলের মধ্যে রয়েছে দুর্নীতির বিরাট বাসা। মমতাকে সামনে রেখে দলের একশ্রেণির নেতা, মন্ত্রী, বিধায়কেরা শুরু করেছেন ঘুষের বেসাত। ভাবা যায়, যে ঘটনা কোনোদিন ঘটেনি এ রাজ্যে, সে ঘটনা ঘটতে শুরু করে। আর এর প্রধান হলেন রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ও দলের কেন্দ্রীয় মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়।
ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই এবং এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট বা ইডি ইতিমধ্যে তৃণমূলের নেতাদের কাছ থেকে উদ্ধার করেছে নগদ কোটি কোটি টাকা। আর সেই টাকা দেখে রাজ্যবাসী হতবাক! একজন ‘সততার প্রতীক’র দলের নেতারা এমন হলেন কী করে? তাঁরা তো বামফ্রন্টকে তাড়িয়ে ঘোষণা দিয়েছিলেন—পশ্চিমবঙ্গ হবে এক সুখী, সুন্দর রাজ্য। দুর্নীতিমুক্ত রাজ্য। মানুষ দুর্নীতিকে উপড়ে ফেলে সততার প্রতীক মমতাকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। এবার সেই মমতার হাতেই গড়ে উঠবে এ রাজ্য। মানুষও সেই সুখী, সুন্দর ও দুর্নীতিমুক্ত রাজ্য গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন দেখবে।
কিন্তু কী ঘটে গেল মমতার তৃণমূলে? স্কুলশিক্ষক নিয়োগে দুই হাত ভরে ঘুষ খেলেন তৃণমূলের মন্ত্রী থেকে ছোট-বড় নেতারা। শিক্ষকতা পেশায় নিয়োগে ১৫ থেকে ২০ লাখ ঘুষ। ভাবা যায়! এ জন্য সারা রাজ্যে গোপনে তৈরি হয় ঘুষ নিয়ে চাকরি দেওয়ার টিম। শীর্ষে থাকেন সেদিনকার খোদ শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। আর সঙ্গে স্কুল সার্ভিস কমিশন বা এসএসসির শীর্ষ নেতা থেকে শিক্ষা বিভাগের উপদেষ্টা এবং বেশ কজন কর্মকর্তা। তাঁরাই শুরু করেন নিয়োগে ঘুষ-বাণিজ্য। অভিযোগ উঠলে কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে সিবিআই এবং ইডি নেমে পড়ে মাঠে। ধরাও পড়েন সরকারি কর্মকর্তাসহ তৃণমূলের বেশ কিছু নেতা, মন্ত্রী, বিধায়ক ও কর্মকর্তা। এখন তাঁরা কারাগারে। জামিন পাননি।
অপরাধ কি কম ছিল? ইন্টারভিউ না দিয়ে চাকরি, নিয়োগ পরীক্ষায় সাদা খাতা জমা নিয়ে চাকরি, শূন্য নম্বর পাওয়া প্রার্থীকে চাকরি, নম্বর বাড়িয়ে চাকরি—সবই হয়েছে এ মমতা সরকারের আমলে। চাকরি বিক্রি হয়েছে অর্থের বিনিময়ে, চাকরি লুট হয়েছে অর্থের বিনিময়ে, চাকরি চুরি হয়েছে অযোগ্য প্রার্থীদের চাকরি দেওয়ার জন্য। তাই চাকরি নিয়ে লুট, যোগ্য প্রার্থীদের বঞ্চিত করার প্রতিবাদে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন চলছে কলকাতার ধর্মতলায়। মামলাও চলছে কলকাতা হাইকোর্টে এ নিয়োগ দুর্নীতির বিরুদ্ধে।
তাই তো এত দিন পর হুঁশ ফিরেছে মুখ্যমন্ত্রী মমতার। তিনি বলেছেন, চাকরি হারানোদের চাকরির ব্যাপারে কি একটু বিবেচনা করা যায় না? এ ভোল পাল্টে যাওয়ার ঘটনায় রাজ্যে বিরোধী শিবিরে মমতার সততা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
তাই তো দেখা যাচ্ছে, এক যুগ পার হতে না হতেই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কংগ্রেস সরকার জড়িয়ে পড়েছে নানা দুর্নীতিতে। শিক্ষক নিয়োগসহ কয়লা উত্তোলন শিল্প, বালুখাদান শিল্পে দুর্নীতিসহ নানা দুর্নীতিতে। আর এ দুর্নীতির জালে প্রথম সিবিআইয়ের হাতে ধরা পড়েছেন রাজ্যের তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ও শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়। ধরা পড়েছেন স্কুল সার্ভিস কমিশনের (এসএসসি) বড় নেতাসহ শিক্ষাক্ষেত্রের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা। সব মিলিয়ে অন্তত ১০ জন। তাঁরা এখন কারাগারে। যদিও এখন এ রাজ্যে শিক্ষাক্ষেত্রের দুর্নীতিই শীর্ষে।
আর এ ঘটনায় এখন প্রচণ্ড অস্বস্তি দেখা দিয়েছে শাসক দলের মধ্যে। যেভাবে এ দুর্নীতি নিয়ে রাজ্যে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ছে, মমতা সরকারের ইস্তফার দাবি উঠেছে, দাবি উঠেছে দুর্নীতিবাজদের যথাযথ শাস্তির, তাতে চরম বিপদে রয়েছেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার।
তাই তো গত মঙ্গলবার কলকাতার আলিপুর আদালত চত্বরে ঋষি অরবিন্দের জন্মসার্ধশতবর্ষ উপলক্ষে তাঁর আবক্ষ মূর্তির উন্মোচন করতে গিয়ে মমতা কার্যত স্বীকার করে নেন নিয়োগ দুর্নীতির অভিযোগকে। পাল্টা প্রশ্ন তোলেন, ‘কেন আজ রাজনৈতিক স্বার্থের শিকার হচ্ছে যুবসমাজ? রোজ রোজ কেন চাকরি বাতিল করা হচ্ছে?’ এরপরেই তিনি বলেন, দুর্নীতির অভিযোগে চাকরি হারানোদের সংশোধনের সুযোগ দেওয়া হোক। প্রয়োজনে আবার বসানো হোক নিয়োগ পরীক্ষায়। না হলে তো তাদের পরিবার বিপদে পড়ে যাবে। রুটিরুজির প্রশ্ন উঠবে?’
মমতা বলেন, ‘আমি জীবনে জেনেশুনে কোনো অন্যায় করিনি। আমি এ রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পর একটিও সিপিএম ক্যাডারের চাকরি খাইনি। তা হলে তোমরা কেন খাচ্ছ? চাকরি দেওয়ার ক্ষমতা নেই চাকরি কাড়ার ক্ষমতা আছে?’
সিপিএম আমলের চাকরি নিয়ে এক ব্যক্তির কলকাতা হাইকোর্টে দায়ের করা একটি মামলার রায় নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন মমতা, ‘সেদিনকার বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায় রায় সংশোধনের কথা বলেছিলেন। যদি ওই রায়ে ভুল থাকে সংশোধন করে নাও, কিন্তু বিচারপতি চাকরি খাওয়ার কথা বলেননি। এখন তো রোজ কথায় কথায় চাকরি যাচ্ছে। কখনো ৩ হাজার, আবার কখনো ৪ হাজার।’
মমতা আরও বলেছেন, ‘যদি কেউ নিচুতলায় অন্যায় করে থাকেন, তাঁদের সংশোধনের সুযোগ দেওয়া উচিত। আমি সব সময় অন্যায়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিই। আমি অন্যায়ের বিরুদ্ধে। তাই বলছি, যাঁরা অন্যায় করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে স্ট্রং অ্যাকশন নিন। শাস্তি দিন। আমার সে ব্যাপারে তাঁদের প্রতি কোনো দয়া থাকবে না, কিন্তু ছেলে-মেয়েরা যাতে চাকরি ফিরে পায়, তার ব্যবস্থা করুন। দরকার হলে তাদের আবার পরীক্ষা নিন। আদালত যদি কোনো নির্দেশ দেন, তবে আমরা তার ব্যবস্থা নেব। সিদ্ধান্ত এখন আপনাদের।’
নিয়োগ দুর্নীতি মামলার জেরে এখন পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে নিয়োগকৃত ৪ হাজার ৭৮৪ জনের চাকরি খারিজ করে দিয়েছেন কলকাতা হাইকোর্ট। সবশেষ ১০ মার্চ স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ পাওয়া ৮৪২ কর্মীর চাকরি খারিজ করে দিয়েছেন কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়।
মমতার এ মন্তব্যের পর বিরোধিদের তরফ থেকে দাবি উঠেছে, এবার তো চাকরি খারিজ হওয়া প্রার্থীরা ঘুষের টাকা ফেরত পাওয়ার দাবিতে আন্দোলনও শুরু করতে পারেন। তাই কি মমতা আগাম আভাস পেয়ে ভয় পেয়ে চাকরি ফেরত দেওয়ার দাবি তুলেছেন? মমতার ভয়, ঘুষের টাকার ফেরত দেওয়ার দাবিতে আবার বিরোধীরা তীব্র আন্দোলন গড়ে না তোলে কলকাতাসহ এ রাজ্যে।
অমর সাহা প্রথম আলোর কলকাতা প্রতিনিধি