মতামত

ফিরে দেখা ২০২২: পোড়া দাগ ও ক্ষত পেছনে রেখে চট্টগ্রাম

চলে যাচ্ছে ২০২২। কিন্তু রেখে যাচ্ছে পোড়া দাগ। অকস্মাৎ এক দুর্বিপাকে চিরতরে নিভে গেল অর্ধশতাধিক মানুষের জীবন। নেমে এল কতগুলো মানুষের জীবনে ভয়ানক ট্রমা। জীবনভর হাহাকার নিয়ে বেঁচে থাকবেন অনেক আত্মীয়স্বজন। বছরের বিদায়লগ্নে চোখে শুধু ভেসে ওঠে হাসপাতালের করুণ দৃশ্য—রক্তের জন্য ছোটাছুটি, আহত মানুষের আর্তনাদ, স্বজনের বিলাপ। গত ৪ জুন চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের একটি কনটেইনার ডিপোয় ধোঁয়ার কুণ্ডলীতে অকস্মাৎ প্রচণ্ড শক্তিধর বিস্ফোরণ ঘটে কীভাবে এলাকাটা একটা নরকে পরিণত হলো, তার কারণ শেষ পর্যন্ত জানা যায়নি। কেন যে ৫১ জন মানুষ প্রাণ হারালেন, দুই শতাধিক মানুষ আহত হলেন, কারও কারও চিরদিনের জন্য অঙ্গহানি হলো—এমন একটা রহস্যের ভেতর হাহাকারের স্মৃতি নিয়ে বছরটা চলে গেল। রহস্যের কূলকিনারা না হলেও সীতাকুণ্ড দুর্ঘটনার কিছু পরোক্ষ কারণ উদ্‌ঘাটন করেছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের তদন্ত কমিটি।

কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, নিরাপত্তাব্যবস্থা পর্যাপ্ত ছিল না সেই ডিপোতে। ছিল না অগ্নিনিরাপত্তার জন্য ফায়ার হাইড্রেন্ট। তাদের প্রশিক্ষিত জনবলের অভাবও ছিল। প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ওই ডিপোতে বিপজ্জনক কেমিক্যাল কনটেইনার, পোশাকসহ অন্যান্য রপ্তানিপণ্যের কনটেইনার একসঙ্গে থাকত। নিয়ম মেনে বিপজ্জনক পণ্য আলাদা রাখা হলে এত মানুষের অকালে প্রাণ যেত না, আহতও কম হতো। বন্দরের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে কেমিক্যালভর্তি কনটেইনারগুলো পৃথকভাবে সংরক্ষণের সুপারিশ করা হয়েছে। তাতে বলা হয়, কেমিক্যাল রাখার সক্ষমতাসম্পন্ন ডিপো ছাড়া অন্য কোথাও কেমিক্যাল রাখা যাবে না। সুপারিশে ডিপোকে ধূমপানমুক্ত রাখতে এবং সেখানে ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপনের কথা বলা হয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে অনেক দিকনির্দেশনা। সম্প্রতি দুর্ঘটনাকবলিত ডিপোটি কাজকর্ম শুরু করেছে। ফায়ার সার্ভিস, কাস্টমস এবং বন্দরের নানা সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য তারা কাজ করছে বলে জানা গেছে। আমাদের প্রত্যাশা, এ ধরনের সব প্রতিষ্ঠান দুর্ঘটনার ঝুঁকিমুক্ত থাকতে প্রয়োজনীয় সব শর্ত মেনেই ব্যবসা চালাবে, যাতে ভবিষ্যতে এ রকম ভয়াবহ নরকযন্ত্রণার মুখোমুখি আমাদের হতে না হয়।

সীতাকুণ্ডের কনটেইনার ডিপোর দুর্ঘটনার পর ২৯ জুলাই ঘটল আরেক প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা। এদিন চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলায় ঢাকা থেকে চট্টগ্রামমুখী একটি ট্রেনের ধাক্কায় মাইক্রোবাসের ১১ আরোহী নিহত হয়েছেন। চট্টগ্রামের হাটহাজারীর আমানবাজার এলাকা থেকে তাঁরা সবাই গিয়েছিলেন খৈয়াছড়া ঝরনায় বেড়াতে। বাড়ি ফেরার পথে তাঁরা চলে গেলেন না ফেরার দেশে। লেবেল ক্রসিংয়ের বাঁশ ঠেলে মাইক্রোবাসটি রেললাইনে উঠে গেলে এ দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনার পর সেদিন প্রথম আলোর খবরে বলা হয় ‘বড়তাকিয়া রেলস্টেশনের এক কিলোমিটার উত্তরে যেখানে দুর্ঘটনা ঘটেছে, সেখানে কোনো লাইনম্যান ছিলেন না। সড়কের ওপর লেভেল ক্রসিংয়ে ছিল না সিগন্যাল। এ কারণে কোনো ধরনের বাধা ছাড়াই রেললাইনের ওপর উঠে যায় মাইক্রোবাসটি।’ একজন মানুষের দায়িত্বে অবহেলা এ রকম একটা ট্র্যাজিক ঘটনার জন্ম দিয়েছে। মহামারি, প্রাকৃতিক দুর্যোগের মৃত্যুতে মনকে প্রবোধ দেওয়া যায়, কিন্তু এ রকম অপঘাতে মৃত্যু কিছুতেই সহ্য করা যায় না। ভ্রমণের আনন্দের কী ভয়াবহ পরিণতি নেমে এসেছে ১১টি পরিবারে!

প্রতিদিন শত শত দুর্ঘটনায় মৃত্যুর খবর প্রকাশিত হয়। নতুন দুর্ঘটনার খবরে আগের দুর্ঘটনার কথা মানুষ ভুলে যায়। এই সব মৃত্যুকে আমরা অবচেতনে স্বাভাবিক বলে ধরে নিয়েছি। কিন্তু যাঁরা এসব দুর্ঘটনার শিকার, তাঁদের পরিবারের দিকে যদি একবার ফিরে তাকাই, তাহলে বোঝা যাবে একটি দুর্ঘটনা কীভাবে একটি পরিবারকে নিঃশেষ করে দেয়। এ রকম বহু পরিবারের দীর্ঘশ্বাসের মধ্যে শেষ হয়ে যাচ্ছে আরেকটি বছর। নতুন বছরে আরও অনেক ট্র্যাজেডি তৈরি হবে, তবু আমরা সচেতন হব না?

এ রকম হতাশা আর মর্মান্তিক ঘটনার পাশাপাশি এ বছর আরেকটি ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে, যার স্মৃতি আমাদের হীন করে দেয়, মনটাকে কলুষিত করে। ১৭ জুলাই রাতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেন এলাকায় পাঁচ তরুণ এক ছাত্রীকে বেঁধে বিবস্ত্র করে মুঠোফোনে ভিডিও ধারণ করেছে। একটি সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে এ রকম ঘটনা যখন ঘটে, তখন অভিভাবক, শিক্ষার্থীসহ সব শ্রেণির মানুষের ভেতর একধরনের গ্লানি চলে আসে। উদ্বেগ বাড়ে নিজের সন্তান–সন্ততিদের নিয়ে। সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন সবাই। একধরনের অসহায়ত্ব মানুষকে কাবু করে। তবে আশার কথা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা এই ঘটনার প্রতিবাদে মুখর ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীরা যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এ ঘটনায় জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে।

২০২২ সালে করোনার দাপট কমেছে। তারপরও মৃত্যু ছিল পঞ্চাশের কাছাকাছি। বছরের শেষ দিকে শুরু হয়েছে এই ঘাতক ভাইরাসবিরোধী টিকার চতুর্থ ডোজ। প্রথম দিকে চতুর্থ ডোজে সাড়া না মিললেও নতুন বছরের শুরুতে মানুষের আগ্রহ বাড়বে বলে অনেকের ধারণা। কিন্তু করোনাকে ছাপিয়ে পুরোটা বছর চোখ রাঙিয়েছে ডেঙ্গু। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন বরাবরের মতো মশকনিধনের সাফল্যে শূন্যে অবস্থান করেছে। ফলে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত এই ডেঙ্গুতে প্রাণ হারিয়েছেন ৩৭ জন। এই নিয়তির জন্যও সিটি করপোরেশানের গাফিলতি দায়ী।

বছরের শেষে বিশ্বকাপ ফুটবলের হইহল্লার ভেতর ভারতীয় ক্রিকেট দল চট্টগ্রামে এসে একটি আন্তর্জাতিক এক দিনের ম্যাচ এবং একটি টেস্ট ম্যাচ খেলে গেছে। চট্টগ্রামের নিস্তরঙ্গ ক্রীড়াঙ্গন এবং ক্রীড়ামোদি মানুষের জন্য কয়েকটি দিন অন্য রকম আনন্দে কেটেছে। অবশ্য দুটো ম্যাচেই বাংলাদেশের শোচনীয় হার মানুষের এই আনন্দকে কিছুটা ম্লান করেছে।

২০২২ সালের এত হতাশার খবরের মধ্যে আশা জাগানিয়া খবরও ছিল চট্টগ্রামবাসীর জন্য। ২৬ নভেম্বর চট্টগ্রামের প্রধান নদী কর্ণফুলীর তলদেশে নির্মীয়মাণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের একটি টিউব উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চীনের সাংহাই শহরের আদলে চট্টগ্রামকে ওয়ান সিটি টু টাউন মডেলে গড়ে তুলতে এই টানেল নির্মাণ করছে সরকার। টানেলের পতেঙ্গা প্রান্তে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দিয়েছেন। নতুন বছরের শুরুতে পুরো টানেল উদ্বোধন করা হবে।

তবে ২০২২ সালে চট্টগ্রামের মানুষের সবচেয়ে বড় অর্জন ছিল সিআরবি এলাকা নিয়ে। ‘চট্টগ্রামের ফুসফুস’ বলে খ্যাত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা এই স্থানে হাসপাতাল তৈরির জন্য একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু বহু প্রাচীন বৃক্ষশোভিত, ৭১–এর স্মৃতিবিজড়িত এই স্থানে প্রতিবছর বৈশাখী মেলা হয় বাংলা নববর্ষে। প্রতিদিন সবুজের টানে হাজারো মানুষ আসে একটি বিনোদনের প্রত্যাশায়। ভোরে প্রাতর্ভ্রমণের জন্য আসেন শত শত মানুষ। একধরনের পর্যটনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে রেলয়ের কেন্দ্রীয় দপ্তরসংলগ্ন এই জায়গা। হাসপাতাল হলে এই ঐতিহ্য হুমকির মুখে পড়বে। আর তাই এখানে হাসপাতাল নির্মাণের সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছিলেন চট্টগ্রামের রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সংস্কৃতিকর্মীরা। করোনার কঠিন সময়কে উপেক্ষা করে মানুষ এই দাবি নিয়ে মাঠে নামে। শেষ পর্যন্ত এটি আন্দোলনে রূপ নেয়। মানুষের প্রাণের দাবিকে উপেক্ষা করেনি সরকার। ২০২২ সালে সরকার স্পষ্টভাবে ঘোষণা দেয়, সিআরবি এলাকায় কোনো হাসপাতাল হবে না। চট্টগ্রামের মানুষের ঐক্য এই জয় এনে দিয়েছে তাঁদের। বহু বছর মনে রাখার মতো একটা জয়।

  • ওমর কায়সার প্রথম আলোর চট্টগ্রাম কার্যালয়ের বার্তা সম্পাদক।