তাজউদ্দীন আহমদ ও সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন
তাজউদ্দীন আহমদ ও সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন

স্মরণ

মাকে লেখা মেয়ের জন্মদিনের চিঠি

আমার ১২তম জন্মদিনের একটি উপহার ছিল সুকান্তসমগ্র। পরাধীন ভারতের এক মুক্তিপিয়াসী এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে অন্তহীন বিদ্রোহী সুকান্তর কবিতাগুলো আমার মনে এতখানিই আলোড়ন তোলে যে সেই জন্মোৎসবের রাতেই আমি কবিকে অভিনন্দন জানিয়ে এক চিঠি লিখে ফেলি। কবির ঠিকানা খুঁজতে গিয়ে জানতে পারি যে এই প্রতিভাধর কবি মাত্র ২১ বছর বয়সে যক্ষ্মাব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পরলোকগমন করেছেন। অনন্তলোকের কোনো অধিবাসীর কাছে লেখা আমার সেই প্রথম চিঠিটি আর পোস্ট করা হয়নি। তবু কেন যেন সে সময় মনে হয়েছিল সুকান্ত আমার চিঠিখানি পড়েছেন।

আমার আম্মা, সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন অমর্ত্যলোকবাসী হয়েছেন (২০ ডিসেম্বর ২০১৩) ১০ বছর হলো। ২৪ ডিসেম্বর, তাঁর ৮১তম জন্মদিনের চার দিন আগে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। তাঁর জন্মদিনের জন্য নিয়ে আসা উপহারমালা আর তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হয় না। সুদূর প্রবাসেও আসে না তাঁর আর কোনো চিঠি। তাঁর কাছে লেখা আমার অগণিত চিঠি হৃদয়ের মুক্ত পাতায় কেবলই জমা হতে থাকে, প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ। আমার বিশ্বাস, সেই মুক্তিপাগল কবির মতোই তিনিও আমার চিঠিগুলো ঠিক ঠিকই পড়েছেন। অনন্তর ডাকঘরে প্রেরিত, তাঁর জন্মদিনের জন্য লেখা, আজকের এই চিঠিটিও।

প্রিয় আম্মা
শুভ জন্মদিন।
পৌষ মাসের পিঠার উৎসব এবং নরম শীতের আমেজ ভরা দিনটিতে আপনি পৃথিবীতে এলেন। আপনার নানির হাতে বানানো সবুজ উলের জামাটির মধ্য দিয়ে আপনার হংসধবল কোমল মুখখানি ফুটে রইল আলোকিত পদ্মর মতো। সেই জামাটি আমি ফ্রেমে বাঁধিয়ে রেখেছি। যতবারই ওই পুতুলের মাপের জামাটির দিকে তাকাই, ততবারই মনে হয় সৃষ্টির একি লীলাখেলা। ‘আমার আম্মা কি এতটুকু বাচ্চা ছিল!’ ঠিক যেমন আমার শিশুকালের ছবিগুলো দুহাতে ধরে আপনি স্নেহ বিস্ময়ের আবেগতাড়িত কণ্ঠে বলতেন ‘রিপি কেমন করে বড় হয়ে গেল।’ আমার ধারণা, বসন্ত ঋতু যখন গ্রীষ্ম পেরিয়ে হেমন্তর দুয়ারে পৌঁছে, তখন মায়েরা আবারও হয়ে যায় শিশু আর মেয়েরা মা। সে কারণেই বোধ হয় আমার প্রথম প্রকাশিত বই (হৃদয়ে রঙধনু) যা আপনাকে উৎসর্গ করি, তাতে রয়েছে আনন্দ গ্রহের অধিবাসী সেই মেয়ের গল্প, যে তার জন্মের আগেই খুঁজছে এক আদর্শ মাকে, যিনি সন্তানকে দেবেন জ্ঞানের শক্তি ও শান্তির ঠিকানা।

নানা-নানি আপনার ভালো নাম রেখেছিল জোহরা। আরবিতে যার অর্থ ‘ফুটন্ত ফুল’ বা ‘জগতের ফুল’। ডাকনামেও ফুলের সুবাস। আমার ফুলের টব দুটি যখন সাদা লিলি ফুলে ভরে গেল, তখন আমার সেকি আনন্দ! আমার প্রতিবেশী অ্যানি জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি লিলি ফুল এত পছন্দ করো’! আমি বললাম, লিলি আমার মায়ের ডাকনাম আর সাদা তাঁর সবচেয়ে প্রিয় রং। আমার বাবার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়েছিল সাদা বেলি ফুলের গয়না পরে এবং বেলি ফুলের মালাবদল করে। আমার মা সোনার গয়না চাননি, চেয়েছিলেন শুভ্রতার প্রতীক সাদা বেলি ও তার সৌরভ। অ্যানি বিমুগ্ধ চিত্তে সে কথা শুনে বলল ‘কী রোমান্টিক! কী অনন্য তোমার মা।’

আম্মা আসলেই কি মহা ভাগ্যই না আমাদের ভাইবোনদের, এমন অনন্য মা ও বাবার সন্তান হতে পেরে। আমার ধারণা, অনন্য তাঁরাই, যাঁদের বিশাল দৃষ্টি এড়িয়ে যায় না অতি ক্ষুদ্র ও নগণ্যর ব্যথা, মহৎ আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে নির্দ্বিধায় যাঁরা করেন আত্মত্যাগ এবং আত্মোন্নয়নের সুকঠিন সংগ্রাম অব্যাহত রাখেন আজীবন। এমন মানুষেরাই হতে পারেন ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের আলোকিত পথনির্দেশক।

জাতির এক মহা দুর্যোগকালে আব্বু, তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সফল নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আর নেতৃত্বের চরম সংকটকালে, (স্বাধীনতার বিরুদ্ধ শক্তির হাতে বঙ্গবন্ধু এবং আব্বুসহ চার জাতীয় নেতার নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর) আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের দায়িত্ব যখন আপনার কাছে ন্যস্ত হয়, তখন আপনি অসামান্য ত্যাগ, নিষ্ঠা, সাহস ও সততার সঙ্গে সেই দায়িত্ব পালন করেন। আপনি ছিলেন দুর্দিনের কান্ডারি এক অসাধারণ নারী। আপনি যে দৃষ্টি দিয়ে জীবনকে দেখতেন, তা আমাদের জীবনসংগ্রামের মহত্তম সাথি হতে পারে; জীবনের ক্ষুদ্র পরিধিকে করতে পারে বৃহত্তর ও অর্থবহ।

আমার জন্মদিনে আপনার লেখা এই চিঠিটি সেই বৃহৎ জীবনবোধেরই এক সুগভীর প্রতিফলন।

‘প্রিয় মা রিপি,
আমার ভালোবাসা দোয়া প্রাণভরে তোমাকে জানালাম। তোমার জন্মদিন এসে গেল ২৯শে ফেব্রুয়ারি ’৯২। আল্লাহ সর্বদিকে তোমার মহাকল্যাণ করুক, মঙ্গল করুক। এই কিছুমাত্র ক্ষণস্থায়ী জগতের কত লীলাখেলা দেখলাম, বুঝলাম, শুনলাম। মনের গভীরে উপলব্ধিবোধের তাগিদ অনুভব করছি। সেই সংগ্রামে একাকার হয়ে যাবার আকাঙ্ক্ষায় লালায়িত আমি। সে আর এক মহা জগৎ। এই জগতে বসবাস করেও তীক্ষ্ণ চেতনায় সেই জগতে অনুপ্রবেশ করা যায়। লক্ষ্য সেদিকেই, সে পথেই এগিয়ে নেবে।...তোমার আম্মা।’

অন্যত্র আরেকটি চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘আত্মাকে প্রতিটি মহান কাজে নিয়োজিত রাখার সংগ্রামই প্রকৃত মানবজীবনের সংগ্রাম।’

নিঃস্বার্থ সেবা যে সেই মহৎ কাজেরই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, তার অগণিত উদাহরণ তো আপনি প্রতিনিয়তই নিজ কাজের মধ্যেই রেখে গেছেন। জাতি–ধর্ম-শ্রেণি-বর্ণর ঊর্ধ্বে মানুষকে আপনি কেমন অনায়াসেই আপন করে নিতেন। আপনার হাতের অতুলনীয় রান্নার স্বাদ এবং আপনার মমতা ভরা নিজ হাতে পরিবেশনের স্মৃতি সাধারণ ও অসাধারণ সবার মনকেই ছুঁয়ে যেত। আমাদের পুরো বাড়িটিই ছিল গরিব-দুঃখী ও আর্তের ভরসাস্থল।

ছোটবেলায় আমি ছিলাম দুরন্ত চঞ্চল। আমাকে শান্ত করার একটি উপায় ছিল, গল্প বলা। আর গল্পের ফাঁকে ফাঁকে আমাকে খাইয়ে দিতে পারলে তো কথাই নেই। সিংহ রাজা ও ময়না পাখির গল্প হতে, দেশ-বিদেশের কাহিনি, ইতিহাস কিছুই বাদ পড়ত না আপনার মনোমুগ্ধকর কথার ছন্দে। স্বদেশভাবনা ও বিশ্বের সঙ্গে সেতুবন্ধন আমার হয়েছিল ওই গল্পগুলোর মধ্যেই।

ফুল, পাখি, প্রকৃতি ও প্রেমকে একই নিবিড়তায় ধারণ করে আমাদের জন্য আপনি রেখে গেলেন নিজেকেই।

  • শারমিন আহমদ লেখক ও গবেষক, বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের কন্যা।