জাফরুল্লাহ চৌধুরী: বিশ্বাস ও চর্চায় এমন মানুষ বিরল

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী (১৯৪১–২০২৩)
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী (১৯৪১–২০২৩)

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বেশ কয়েক বছর ধরেই অসুস্থ। কিডনি-জটিলতায় ভুগছিলেন। তার ওপর কোভিড ও নিউমোনিয়ার ছোবল। চিকিৎসাসেবার সার্বক্ষণিক তদারকির সুবিধার্থে তিনি বাসায় না থেকে তাঁর নিজের গড়া হাসপাতালেই থাকতেন। ডায়ালাইসিস করাতেন সপ্তাহে তিন দিন।

সেখান থেকেই তিনি জুমে টক শো করতেন, আবার নানা সামাজিক কর্মসূচিতে অংশ নিতেন। কয়েক দিন আগে হঠাৎ করেই শরীর খারাপ হয়ে পড়ে। শেষ দিকে ছিলেন লাইফ সাপোর্টে। মঙ্গলবার রাত সাড়ে আটটার দিকে তাঁর বাসায় ফোন দিয়ে সর্বশেষ অবস্থা জানতে চেয়েছিলাম। আমাকে বলা হলো, তাঁর অবস্থা স্থিতিশীল। একটু নড়াচড়া করেছেন। তবে জ্ঞান ফেরেনি। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই টেলিভিশন স্ক্রলে জানা গেল, তিনি আর নেই। স্বজন ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাঁদিয়ে চলে গেছেন অনন্তধামে। এক বর্ণাঢ্য জীবনের ইতি হলো।

দেশে তো অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধা আছেন। তিনি ছিলেন অনন্য। বাড়ি, গাড়ি, তেলের পাম্প, ব্যাংকের লাইসেন্স, আর ভাতার পেছনে দৌড়াননি। সব সময় ছিলেন সৃজনশীল। তাঁর কীর্তিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনকল্যাণমুখী ছিল গরিবের হাসপাতাল হিসেবে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা এবং ওষুধনীতি তৈরিতে অনুঘটকের ভূমিকা নেওয়া। এ দেশের পাঁচ দশকের ইতিহাসে এই দুটোকে রীতিমতো বিপ্লব বলা যেতে পারে।

তৃতীয় দুনিয়ার অনেক দেশে, বিশেষ করে মেক্সিকোর গ্রামে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে বোস্টন ইউনিভার্সিটি স্কুল অব পাবলিক হেলথের সহযোগী অধ্যাপক ডেভিড বি ওয়ার্নার স্প্যানিশ ভাষায় লিখেছিলেন ডনডে হে ডক্টর। ১৯৭০ সালে এটি প্রকাশিত হয়। পরে দুই সহলেখক ক্যারল থুমান আর জেন ম্যাক্সওয়েলকে সঙ্গে নিয়ে তিনি এর ইংরেজি করলেন হয়্যার দেয়ার ইজ নো ডক্টর: আ ভিলেজ হেলথকেয়ার হ্যান্ডবুক

এই চিন্তা আর অভিজ্ঞতা থেকেই সদ্য যুদ্ধফেরত জাফরুল্লাহ চৌধুরী ঢাকার বাইরে ধামরাইয়ের গ্রামে প্রতিষ্ঠা করলেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। গ্রামের বেকার তরুণ আর হাতুড়ে ডাক্তারদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করলেন একঝাঁক প্যারামেডিক। তাঁরা গ্রামে গ্রামে গিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা দেবেন। গুরুতর রোগ থাকলে রেফার করবেন কাছাকাছি হাসপাতালে। এই মডেলটি নিয়ে ব্র্যাকও কাজ করেছে। ব্র্যাকের প্যারামেডিকরা প্রশিক্ষণ নিয়েছিল গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে।

জাফরুল্লাহ ভাইয়ের চলে যাওয়ায় আমি ইতিহাসের একটি অতিগুরুত্বপূর্ণ সূত্র হারালাম, যাঁর মধ্যে তথ্য লুকানোর বা ইতিহাস বিকৃত করার ধান্দা ছিল না। সম্পদ ও প্রতিপত্তির প্রতি কোনো মোহ ছিল না। এমন বিরল মানুষ তিনি।

জাফরুল্লাহ চৌধুরীর পরবর্তী ‘জিহাদ’ ছিল বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে। প্রায় সব ওষুধই তখন আমদানি হতো। এখানে অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি হতো না বললেই চলে। তখন তাঁর স্লোগান ছিল, ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’। অধ্যাপক ডা. নূরুল ইসলামসহ আরও কয়েকজনকে নিয়ে তিনি জাতীয় ওষুধনীতি তৈরির আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। বিদেশি কোম্পানিগুলো তখন গ্রাইপ ওয়াটার, ওয়াটার ব্যারিজ কম্পাউন্ড এবং নানা ধরনের কফ সিরাপ ও টনিকের ব্যবসা করে মানুষের পকেট কাটছে। এসবের অনেকগুলো ছিল অপ্রয়োজনীয় ও ক্ষতিকর। রাষ্ট্রপতি এরশাদকে দিয়ে তিনি এটা জাতীয়ভাবে অনুমোদন করালেন।

ওষুধ নামে বাজারে চালু অপ্রয়োজনীয়, এমনকি ক্ষতিকর অনেক কিছু নিষিদ্ধ হলো। বিদেশি কোম্পানিগুলো খেপে গেল। তাদের সুবিধাভোগী অনেক চিকিৎসকও বিরোধিতা করলেন। বড় কোনো রাজনৈতিক দল তাঁকে সমর্থন দেয়নি। কিন্তু তাতে তিনি দমে যাননি। এভাবেই দেশি ওষুধশিল্প পেল শক্ত ভিত।

তারপর এ দেশে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন হলো। ওই সময় কেউ কেউ ‘স্বৈরাচার এরশাদের বন্ধু’ জাফরুল্লাহর গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র-ঢাকা নগর হাসপাতালের সামনে মিছিল করে ইটপাটকেল ছুড়েছিল। জাফরুল্লাহ এনজিওদের ফেডারেশন অ্যাডাবের সভাপতি ছিলেন। সেখানে তিনি ব্রাত্য হলেন। এ সবই ইতিহাস।

জাফরুল্লাহ চৌধুরী একসময় ছাত্র ইউনিয়নের অ্যাকটিভিস্ট ছিলেন। ছিলেন মাওলানা ভাসানীর ভক্ত। একই সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের প্রতি ছিল অপরিসীম শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতাবোধ। তাঁর এই চর্চা ও উপলব্ধি ছিল এ দেশের দলদাস রাজনীতিকদের বোধের বাইরে। ফলে রাজনীতির যে আওয়ামী-বিএনপি মেরুকরণ হয়েছে, তাতে করে তিনি কারও কাছে তেমন গ্রহণযোগ্য হননি। আওয়ামী বলয়ে তিনি ‘বিএনপির দালাল’ হিসেবে তকমা পেয়েছেন। বিএনপির অনেকেই তাঁকে ‘আমাদের লোক নয়, গায়ে পড়ে উপদেশ দেয়’ বলে ট্রল করেছে।

তিনি বিএনপির শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি খালেদা জিয়ার উদ্দেশে একটি খোলা চিঠি দেন। সেখানে তাঁর নানান পরামর্শ ছিল। তিনি খালেদা জিয়াকে জামায়াতের সঙ্গ ছাড়তে বলেছিলেন। ওই বছর ১৫ আগস্ট ঘটা করে জন্মদিন পালন না করার জন্য তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। আরও কিছু পরামর্শ দিয়েছিলেন, যেগুলো সর্বজনীন।

যেকোনো দলই এটা গ্রহণ করতে পারে। জনগণের সনদ শিরোনামে তিনি সামরিক বাহিনীর সদস্যদের যে দামে রেশন দেওয়া হয়, সে দলে গরিব মানুষকে রেশন-সুবিধা দেওয়া, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে তৃণমূল পর্যায়ে প্রয়োজনীয়সংখ্যক চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া, পাঠ্যবইয়ে বীর নারীদের কাহিনি অন্তর্ভুক্ত করা, নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করা, প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের উদ্যোগ নেওয়া, অনেকগুলো প্রদেশ করা ইত্যাদি।

আমি তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি ১৯৭৯ সাল থেকে। তিনি বিশ্বাস ও চর্চায় ছিলেন সাম্যবাদী, নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় সোচ্চার। ধামরাইয়ে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের হাসপাতাল যখন তৈরি হচ্ছে, তখন আমি একবার দেখতে গিয়েছিলাম। সঙ্গে ছিলেন সাবেক মন্ত্রী মফিজ চৌধুরী আর আহমদ ছফা। গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যাল সবে যাত্রা শুরু করেছে। জেনারেল ম্যানেজার কাশেম চৌধুরী ব্রিফিং দিলেন। মার্কেটিং ম্যানেজার ফরহাদ মজহার আমাদের ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আধুনিক ল্যাবরেটরি দেখালেন।

সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য! গ্রামের মেয়েরা সকালে শাড়ি পরে আসে। পোশাক বদলে নীল রঙের শার্ট-পায়জামা বা ইউনিফর্ম পরে। তারপর কাজে লেগে যায়। হাসপাতালের যাবতীয় আসবাব: লোহার খাট, টেবিল, চেয়ার, আলমারি এসব তৈরি করে। দুপুরে গণস্বাস্থ্যের ক্যানটিনে খায়। সেখানে কেন্দ্রের সমন্বয়ক (জাফরুল্লাহ) থেকে শুরু করে নিম্নতম কর্মচারীটিও একই দামে একই খাবার খায় একই টেবিলে বসে। বিকেলে কাজ শেষে মেয়েরা কাজের পোশাক বদলে শাড়ি পরে ফিরে যায় যার যার বাড়িতে। প্যারামেডিক মেয়েরা সাইকেল চালিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘোরে। আমার জানামতে, এই হাসপাতালেই প্রথম নিয়োগ পেয়েছিলেন একজন পেশাদার নারী গাড়িচালক।

আমি বেশ কয়েকবার তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করার সময় একটা বিষয়ে নিশ্চিত হতে চেয়েছি। মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি এম এ জি ওসমানী ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানিদের অস্ত্রসমর্পণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন না। এ নিয়ে আছে অনেক ধোঁয়াশা। ডিসেম্বরের ওই দিনগুলোতে তিনি ছিলেন তাঁর সঙ্গী। এ বিষয়টি জানার জন্য আমি তাঁর কাছে যাই।

ওই দিনগুলোতে কী ঘটেছে, কেন ওসমানী সেখানে হাজির হতে পারেননি—এসব নিয়ে তিনি কথা বলেন। তাঁর এই কথাগুলো আমি সম্প্রতি প্রকাশিত ১৯৭১: ভারতের বাংলাদেশ যুদ্ধ বইয়ে উল্লেখ করেছি। তিনিই ছিলেন ওই সময়ের একমাত্র জীবিত সাক্ষী।

জাফরুল্লাহ ভাইয়ের চলে যাওয়ায় আমি ইতিহাসের একটি অতিগুরুত্বপূর্ণ সূত্র হারালাম, যাঁর মধ্যে তথ্য লুকানোর বা ইতিহাস বিকৃত করার ধান্দা ছিল না। সম্পদ ও প্রতিপত্তির প্রতি কোনো মোহ ছিল না। এমন বিরল মানুষ তিনি।

  • মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক