২০১৬ সালের একই দিনে হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গিদের নৃশংস হামলায় প্রাণ হারান লতিফুর রহমানের নাতি ফারাজ আইয়াজ হোসেন। তাঁর স্মরণে এই লেখা।
গাজীপুর সদর উপজেলার সুকন্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আয়োজন করা হয় ডায়াবেটিস মেডিকেল ক্যাম্প। সেখানে বিনা মূল্যে সেবা নেন দুই শতাধিক মানুষ। এই ক্যাম্পে রোগীদের সেবা দেন বারডেম হাসপাতালের এন্ডোক্রাইন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ফিরোজ আমিনের নেতৃত্বে একদল বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।
‘মানবতার জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা’—এই স্লোগান সামনে রেখে ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশন আয়োজন করে এই মেডিকেল ক্যাম্পের। গত বছরের আগস্ট থেকে চলতি বছরের মে পর্যন্ত এমন একাধিক মেডিকেল ক্যাম্পের আয়োজন করা হয়। এর মধ্যে গাজীপুরের ক্যাম্পটি ছিল গত নভেম্বরে। এসব ক্যাম্প থেকে সেবা পেয়েছেন প্রায় ছয় হাজার ব্যক্তি।
দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের নিয়ে ক্যাম্পের পাশাপাশি বছরজুড়ে নানা মানবিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশন। বিনা মূল্যে চক্ষুশিবির ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের নিয়ে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হচ্ছে। পক্ষাঘাতগ্রস্ত ব্যক্তিদের থেরাপির মতো নিয়মিত কার্যক্রম চালু রয়েছে। হাসপাতালে অক্সিজেন সরবরাহ বাড়ানো ও মানবিক সহায়তা কার্যক্রমও চালানো হয়েছে ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে।
২০১৬ সালের ১ জুলাই হোলি আর্টিজান বেকারির জঙ্গি হামলায় স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল দেশের মানুষ। দুই বন্ধুকে ছেড়ে আসতে অস্বীকৃতি জানানোয় জঙ্গিদের হাতে নৃশংসভাবে নিহত হন ফারাজ আইয়াজ হোসেন। সাহসী এই তরুণের নামে ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশন গড়েছে তাঁর পরিবার।
এ ফাউন্ডেশন আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে ২০১৭ সালের ৩ ডিসেম্বর। ফারাজ আইয়াজ হোসেন বন্ধুত্ব, সাহস ও মানবিকতার যে নিদর্শন দেখিয়েছিলেন, সেই অনুভূতি ধারণ ও লালন করে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে তাঁর নামে গড়া ফাউন্ডেশন।
ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন প্রত্যন্ত এলাকায় মেডিকেল ক্যাম্পের আয়োজন করা হয়। এসব মেডিকেল ক্যাম্পে নারী-পুরুষের সমস্যা শুনে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা তাঁদের ব্যবস্থাপত্র দেন। বিনা মূল্যে প্রয়োজনীয় ওষুধও সরবরাহ করা হয়। মেডিকেল ক্যাম্পগুলোয় দেশের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা অংশ নেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন স্বাধীনতা পদক পাওয়া চিকিৎসক ল্যাবএইড হাসপাতালের অর্থোপেডিক সার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক এম আমজাদ হোসেন, অধ্যাপক খাদেমুল ইসলাম, সহযোগী অধ্যাপক মাজহারুল ইসলামের মতো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।
চলতি বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের সখীপুরে এমন একটি মেডিকেল ক্যাম্পের আয়োজন করা হয়। সেখানে অধ্যাপক এম এ সামাদ ও ১০ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অংশ নেন। সেদিন ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশন প্রায় এক হাজার জনকে বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা দিতে সক্ষম হয়।
অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা নেই, এমন হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোর মধ্যে কিছু নির্ধারিত প্রতিষ্ঠানে অক্সিজেন কনসেনট্রেটর সরবরাহ করেছে ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশন। মানবিক দিক বিবেচনায় অ্যানোরেক্টাল ক্যানসারে আক্রান্ত চিকিৎসক এ টি এম রেজিনুর রহমান তুনককে এক লাখ টাকা অর্থসহায়তা করা হয় ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে।
পক্ষাঘাতগ্রস্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসনকেন্দ্র সেন্টার ফর দ্য রিহ্যাবিলিটেশন অব দ্য প্যারালাইজডের (সিআরপি) সঙ্গে বছরব্যাপী বিভিন্ন কার্যক্রমে যুক্ত থাকে ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশন। গত বছর বিশ্ব ফিজিওথেরাপি দিবসের অনুষ্ঠান আয়োজনে ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে সিআরপিকে সহায়তা করা হয়। সাভারের সিআরপিতে চালু আছে ফারাজ হোসেন সেন্টার। এই কেন্দ্র বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের থেরাপি ও বিনোদনকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
শারীরিক ও মানসিকভাবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশে ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে ‘সাহস নিয়ে স্বপ্ন আঁকি’ শিরোনামে নিয়মিত চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হচ্ছে।
প্রত্যন্ত এলাকার মানুষের কাছে চক্ষুসেবা পৌঁছে দিতে ডিস্ট্রেসড চিলড্রেন অ্যান্ড ইনফ্যান্টস ইন্টারন্যাশনালের (ডিসিআই) সঙ্গে মিলে নিয়মিত চক্ষুশিবিরের আয়োজন করে আসছে ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশন। চক্ষুশিবিরে বিনা মূল্যে চক্ষু পরীক্ষা এবং চশমার ব্যবস্থা করা হচ্ছে, প্রয়োজনে চোখের অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থাও করা হয়।
সাহসিকতা, বন্ধুত্ব আর মানবতার প্রতি ফারাজের মূল্যবোধ সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশন কাজ করছে বলে জানান ফাউন্ডেশনের সেক্রেটারি জেনারেল বিনয় দাস। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, যেখানেই বঞ্চিত ও অসহায় মানুষ, সেখানেই কাজ করছে ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশন। জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও লিঙ্গের কথা বিবেচনায় না নিয়ে মানুষের কল্যাণে কাজ করছে ফাউন্ডেশনটি।