নেত্রকোনা সদর থেকে ৩৩ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত এক পাহাড়ি জনপদ সুসং দুর্গাপুর। দুর্গাপুরের ঠিক উত্তর পাশে ভারতের মেঘালয়। পশ্চিমে ময়মনসিংহের ধোবাউড়া। আর পূর্বে নেত্রকোনার কলমাকান্দা। দুর্গাপুর উপজেলার কুল্লাগড়া ইউনিয়নের পাশ ঘেঁষে বেসালি গ্রাম। এ গ্রামের এক টিলার ওপর ইতিহাসের পিদিম হয়ে বেঁচে থাকা শতাব্দীকাল বয়সী প্রাণটি ইহধাম ত্যাগ করল ২৩ মার্চ। ব্রিটিশবিরোধী ও টংক আন্দোলনের অন্যতম নেতা কুমুদিনী হাজংয়ের স্মৃতির প্রতি আমাদের অতল শ্রদ্ধা।
উনিশ শতকের প্রথম দিকে টংক আন্দোলনের কথা। সুসং দুর্গাপুর অঞ্চলের জমিদারদের ছিল হাতির কারবার। সে সময় আদিবাসী হাজং প্রজারা ‘ঝুম’ প্রথায় চাষাবাদ করতেন। এ জন্য জমিদারকে নির্দিষ্ট কোনো খাজনা দিতেন না তাঁরা। তবে প্রতিদানে ‘হাতি খেদা’র সময়ে কিছুদিনের বিনা পারিশ্রমিকে হাতি তাড়ানোর কাজ করতে হতো। আর এই হাতি খেদাকে কেন্দ্র করেই এই অঞ্চলে প্রথম কৃষক বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। যার নাম ছিল ‘হাতি খেদা বিদ্রোহ’। সে সময় এই হাতি খেদার অবাধ্য প্রজাদের ওপর নির্মম নিপীড়ন চলত। কুমুদিনী হাজংয়ের বাবা অতিথ চন্দ্র ছিলেন হাতি খেদা বিদ্রোহের একজন কর্মী।
সময় গড়াতে থাকে। উনিশ শতকের মাঝামাঝিতে এসে ব্রিটিশ বণিকেরা এই এলাকাটিকে জমিদারদের থেকে নিজেদের দখলে নেওয়ার চেষ্টা করেন। জমিদারেরা প্রিভি কাউন্সিলে মামলা চালালে তাঁদের পক্ষেই রায় আসে। কিন্তু ১৮৬৯ সালের দিকে ‘গারো পাহাড় অ্যাক্ট’ প্রণীত হলে পাহাড় অঞ্চল ব্রিটিশ সরকারের অধিভুক্ত হয়ে যায়। তখন জমিদারেরা গারো, হাজংসহ আদিবাসী প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা আদায়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
১৮৯০ সালের খাজনা ধার্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে গিয়ে বহু হাজং নিহত হন। এরপর জমিদারেরা ফন্দি করেন, শুধু ফসলের ওপর খাজনা ধার্য হবে। তবে এই খাজনা ফসল উৎপাদনের পরিমাণের ওপর নির্ভর ছিল না। বরং জমি বিলির সময় থেকেই নির্দিষ্ট হারে খাজনা নির্ধারিত ছিল। অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি কিংবা যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগই হোক না কেন, নির্দিষ্ট হারে ধানের/ফসলের ওপর এই খাজনা দেওয়াকে বলা হতো টংক প্রথা।
টংক মানে হলো ‘কড়ারি খাজনা’। সে সময় সোয়া একর জমির জন্য বছরে সাত থেকে পনেরো মণ ধান দিতে হতো। ধানের দর হিসাবে প্রতি সোয়া একরে বাড়তি খাজনা দিতে হতো এগারো থেকে সতেরো টাকা। একদিকে টংক জমির ওপর কৃষকদের মালিকানা নেই। অন্যদিকে ছিল সামন্ততান্ত্রিক শোষণ।
জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত টংক আন্দোলনের মহান নেতা বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ আঁকড়ে ছিলেন। কমরেড মণি সিংহের নামে চালু করা জাদুঘরের উদ্বোধন হয়েছিল তাঁর হাত ধরেই। তাঁর মহান স্মৃতি যেন তাঁরই স্বপ্নের সমাজ বিনির্মাণে আমাদের সর্বদা প্রেরণা জোগায়, সেই প্রত্যাশাই রাখতে চাই বর্তমান প্রজন্মের মুক্তিকামী মানুষের কাছে।
যার দরুন কৃষকেরা ক্ষুব্ধ হতে থাকেন। তাঁদের মূল দাবি ছিল টংক প্রথার উচ্ছেদ এবং জোতস্বত্বের হিসাব অনুযায়ী খাজনা ধার্য করা। টংক আন্দোলনের অন্যান্য দাবি ছিল বকেয়া টংক মওকুফ, জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ, ধানি খাজনা নয় বরং চলতি হারে টাকায় খাজনা প্রদান, জমি থেকে কৃষককে উচ্ছেদ বন্ধ, সেলামি আদায় বন্ধ এবং সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা ইত্যাদি।
এসব দাবিতে পুরো পাহাড় অঞ্চলে টংক আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৪৬ সালের ৩১ জানুয়ারি ‘ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেলস’-এর একদল সৈন্য টংক আন্দোলনের নেতাদের ধরপাকড় করার উদ্দেশ্যে বহেরাতলী গ্রামে প্রবেশ করে ঘরবাড়িতে আগুন, হাজং নারীদের ধর্ষণসহ আদিবাসীদের ওপর ব্যাপক নির্যাতন চালায়।
তাঁদের মূল উদ্দেশ্য ছিল কুমুদিনীর স্বামী, টংক আন্দোলনের নেতা লংকেশ্বর এবং তাঁর ভাইদেরসহ অন্য আন্দোলনকারীদের ধরপাকড়। উল্লেখ্য, টংক আন্দোলনে কুমুদিনীর স্বামী এবং চার ভাই প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেন। সেদিন পুলিশ কুমুদিনীর বাড়িতে এসে জানতে চায় লংকেশ্বর কোথায় আছে। কুমুদিনী যখন তথ্য সরবরাহ করতে অপারগ হন, তখন পুলিশ তাঁকে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। তখন রাশিমণিসহ কৃষক সমিতির অন্য নেতা-কর্মীরা দুর্গাপুর থেকে জনসভা করে ফিরছিলেন। কুমুদিনীকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা স্ফুলিঙ্গের মতো দূরদূরান্তে ছড়িয়ে পড়ে।
এ খবর পেয়েই কৃষক সমিতির নেতা রাশিমণি হাজংয়ের নেতৃত্বে শতাধিক নারী-পুরুষ কুমুদিনী হাজংকে রক্ষা করতে বহেরাতলীর উদ্দেশে রওনা দেন এবং চারদিক থেকে পুলিশকে ঘিরে ফেলে। কুমুদিনীকে উদ্ধারের সংকল্পে রাশিমণি হাজং তাঁর হাতে থাকা দা দিয়ে সশস্ত্র পুলিশের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। তিন ঘণ্টা ধরে চলমান সংঘর্ষে রাশিমণি হাজং, সুরেন্দ্র হাজংসহ তিনজন আন্দোলনকারী এবং দুজন পুলিশ নিহত হন। শেষ পর্যন্ত পুলিশ কুমুদিনী হাজংকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
সেই যে শুরু, কুমুদিনী আর থামার ফুরসত পাননি। ইতিহাসের পাতায় কুমুদিনী হাজং আর টংক আন্দোলন যেন সমার্থক হয়ে যায়। বলা বাহুল্য, কমরেড মণি সিংহ ছিলেন এই টংক আন্দোলনের প্রধান দিশারি। সেই আন্দোলনের মুখে একপর্যায়ে টংক প্রথা বাতিল হয়। টংক আন্দোলনের পর একে একে ভাষা আন্দোলন, পাকিস্তানের জুলুম–বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই, স্বাধীনতার লড়াই এবং বাংলাদেশ পর্বের সুদীর্ঘকালের সাক্ষী হন কুমুদিনী হাজং। জমিদারদের বিরুদ্ধে, সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে, ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে টংক আন্দোলন ছিল এক যুগান্তকারী আন্দোলন।
কুমুদিনী হাজংয়ের প্রস্থানের মধ্য দিয়ে আমরা যেন ইতিহাসের এক মহাসারথিকে হারালাম। ৩০ লাখ মানুষের রক্তনদী পেরিয়ে স্বাধীনতা পাওয়া রাষ্ট্রে এমন এক কিংবদন্তি কখনো পাননি তাঁর উপযুক্ত সম্মাননা। রাষ্ট্রীয় সম্মান বলতে কেবল বাংলা একাডেমির সম্মানসূচক ফেলোশিপ ২০১৯–এর সমাজসেবা বিভাগে পাওয়া পুরস্কার। কিন্তু আজীবন মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত ছিলেন তিনি। ইতিহাসের পাতায় নিশ্চয়ই অমরত্ব পাবেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের এ মহান নেতা।
জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত টংক আন্দোলনের মহান নেতা বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ আঁকড়ে ছিলেন। কমরেড মণি সিংহের নামে চালু করা জাদুঘরের উদ্বোধন হয়েছিল তাঁর হাত ধরেই। তাঁর মহান স্মৃতি যেন তাঁরই স্বপ্নের সমাজ বিনির্মাণে আমাদের সর্বদা প্রেরণা জোগায়, সেই প্রত্যাশাই রাখতে চাই বর্তমান প্রজন্মের মুক্তিকামী মানুষের কাছে।
কমরেড কুমুদিনী হাজং, লাল সালাম
লাকী আক্তার
নির্বাহী সদস্য, বাংলাদেশ কৃষক সমিতি