শহীদ নফিজ উদ্দীন ও বেলাল হোসেনকে যেন আমরা না ভুলি

শহীদ নফিজ উদ্দীন ও শহীদ বেলাল হোসেন
শহীদ নফিজ উদ্দীন ও শহীদ বেলাল হোসেন

১.

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে ঠাকুরগাঁও জেলার রানীশংকৈল উপজেলার প্রথম শহীদ নফিজ উদ্দীন আহমেদ সরকার। নফিজ উদ্দীন আহমেদ সরকার ছিলেন একাধারে শিক্ষক, নাট্যকর্মী, সাংস্কৃতিক ও শিল্পসচেতন শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি। ১৯৩৫ সালের ১০ আগস্ট তৎকালীন ভারতের অবিভক্ত বাংলার দিনাজপুর জেলার রানীশংকৈল থানার সহোদর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন নফিজ উদ্দীন আহমেদ সরকার। পিতা জমির উদ্দীন সরকার, মাতা মিলোসরী। ছয় ভাই ও এক বোনের মধ্যে নফিজ ছিলেন দ্বিতীয়। নফিজ উদ্দীনের পিতা ছিলেন পেশায় তহসিলদার। বাল্যকাল থেকেই নফিজ উদ্দীন আহমেদ সরকার তাঁর পরিবারের কাছে পান শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ।

নফিজ উদ্দীন গ্রামের মাদ্রাসায়ই প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ শেষ করে কামার পাড়া পি আর ইনস্টিটিউশনে ভর্তি হন। ১৯৫২ সালের উত্তাল ভাষা আন্দোলনের সময় এই বিদ্যাপীঠ থেকেই তিনি মাধ্যমিক পাস করেন। ১৯৫৫ সালে তিনি এসএন কলেজ দিনাজপুর থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। উচ্চমাধ্যমিক পাস করে এ সময়ই তিনি রানীশংকৈল হাইস্কুল অর্থাৎ বিএন ইনস্টিটিউশনে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। এ সময় সরকারি চাকরিতে কাজ করার সুযোগ থাকলেও বিদ্যালয়ের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক তাঁর শ্বশুর জনাব ইব্রাহিম আহমদের অনুরোধে তিনি শিক্ষকতাকেই পেশা হিসেবে বেছে নেন। এরপর ১৯৫৬ সালে তিনি রানীশংকৈল পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। সে সময় বিদ্যালয়ের অবস্থা খুব নাজুক ছিল। শিক্ষকদের বেতন ও দৈনন্দিন ব্যয় নির্বাহ ছিল অত্যন্ত দুরূহ।

বিদ্যালয়ের তেমন কোনো তহবিল বা আয় ছিল না। একপর্যায়ে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি স্কুল বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা দেয়। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই ছিল অত্র অঞ্চলের ছাত্রছাত্রীদের মাধ্যমিক শিক্ষার অন্যতম ভরসা। এ সময় নফিজ উদ্দীনসহ অন্য শিক্ষকেরা ছুটলেন গ্রামে গ্রামে, পাড়ায় পাড়ায়। উদ্দেশ্য—ছাত্রদের বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে আনা ও বিদ্যালয়ে পরিচালনার জন্য তহবিল তৈরি করা। এই দুরবস্থায় বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের পদ খালি হলে তা গ্রহণ করতে কেউ রাজি হননি। এই কঠিন সময়ে নফিজ উদ্দীন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। উচ্চমাধ্যমিক পাস করার ১০ বছর পর ১৯৬৫ সালে নফিজ উদ্দীন ডিগ্রি পাস করেন এসএন কলেজ দিনাজপুর থেকে। ১৯৬৬ সালে দিনাজপুরের এক অজপাড়াগাঁয়ে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ক্ষেত্ররূপে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন প্রগতি ক্লাব, যার মাধ্যমে রানীশংকৈলের সাংস্কৃতিক বিপ্লব একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। নফিজ উদ্দীন আহমেদ সমাজসচেতন মানুষ ছিলেন। ৬০–এর দশকেও তিনি ঠাকুরগাঁও সুগার মিলের কর্মকর্তাদের  আলোচনা করে ইক্ষু ক্রয় কেন্দ্রকে পুরোনো সেন্টার থেকে বর্তমান স্থানে আনেন এবং বেশ কিছু মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেন।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের পর নফিজ উদ্দীন আহমেদ সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন এবং এপ্রিল মাসের শুরু থেকেই সংগ্রাম পরিষদের কমিটি তাদের কাজ শুরু করে। সংগ্রাম কমিটি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য স্থানীয় যুবকদের ট্রেনিং দিতে শুরু করে। ফলে খুব সহজেই নফিজ উদ্দীন আহমেদ স্থানীয় রাজাকারদের নজরে চলে আসেন। দিনটি ছিল মঙ্গলবার, ১১ মে ১৯৭১। বাড়ির পাশে জয়কলির হাটে নফিজ উদ্দীন আহমেদ তাঁর বড় মেয়েকে নিয়ে বাজার করেন মুক্তিযোদ্ধা ও প্রশিক্ষণার্থীদের খাবার রান্না করার জন্য। পথে দুই পাকিস্তানি সৈনিক ও পেশকারের সঙ্গে তাঁর কথা হয়। একপর্যায় পেশকার বলেন, ‘মুসলমান হামারা দোস্ত। তুমাহারা কুছ নেহি হোগা। তুম আচ্ছা আদমি।’

সেদিন সন্ধ্যায় অনেকের সঙ্গে নফিজ উদ্দীনের বড় ভাই তসলিম উদ্দীন বাসায় আসেন। তসলিম উদ্দীন বলেন, ‘নফিজ তুমি সরে যাও। তুমি এখন পাকিস্তানিদের টার্গেট।’ উত্তরে নফিজ উদ্দীন বলেন, ‘আমি যেখানেই যাই, ওরা আমাকে খুঁজে বের করবে। আর আমি আমার বাড়ি ছেড়ে, স্কুল ছেড়ে, জেলা ফেলে আর সংগ্রাম কমিটির কাজ ফেলে পালাতে পারব না।’ সবাইকে বিপদে ফেলে তিনি পালাননি। ১১ মে ফজরের আজানের আগেই চারটি জিপগাড়িতে করে পাকিস্তানি সেনারা রানীশংকৈলে আসে এবং নফিজ উদ্দীনের বাড়ি ঘেরাও করে।

নফিজ উদ্দীন টের পেলেও পরিবারের ওপর অত্যাচার হবে ভেবে পালিয়ে যাননি। এরপর দুই পাকিস্তানি সৈনিক তাঁর দুই হাত ও চোখ বেঁধে লুঙ্গি-গেঞ্জি পরা অবস্থায় গাড়িতে ওঠায়। চোখ বাঁধা অবস্থায় হাঁটতে গিয়ে তিনি পড়ে গেলে পাকিস্তানি আর্মির এক সদস্য তাঁকে জোরে লাথি দেন। গাড়িতে করে তাঁকে নেওয়া হয় কোতোয়ালি থানায়। সেখানে তাঁকে অমানবিক নির্যাতন করা হয়। দুপুরের দিকে আবদুর রশীদ নামে পীরগঞ্জ থানার এক দারোগা নফিজ উদ্দীনের ভাইদের জানান যে পেশকার ও স্থানীয় চেয়ারম্যান ছাড়া আর কেউ নফিজ উদ্দীনকে ছাড়াতে পারবেন না।

সেদিন বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পরিবারের সবাই এবং গ্রামের অনেক ব্যক্তি পেশকারের বাড়িতে আহাজারি করেও সুপারিশের জন্য তাঁকে থানায় নিতে পারেননি। ১২ মে ১৯৭১, গভীর রাতে নফিজ উদ্দীন আহমেদকে পীরগঞ্জ থানা থেকে দিনাজপুরে নেওয়ার সময় কাঞ্চন ব্রিজে গুলি করে হত্যা করে লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেয় পাকিস্তানি সৈন্যরা। প্রত্যক্ষদর্শী তৎকালীন দারোগা আবদুর রশীদ পরদিন এ শোকসংবাদ তাঁর বাড়িতে পৌঁছে দেন। ১৯৭২ সালের ১২ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শহীদ নফিজ উদ্দীনের আত্মত্যাগ ও সংগ্রামকে স্বীকৃতি দিয়ে একটি সম্মাননাপত্র ও দুই হাজার টাকার চেক প্রদান করেন। নফিজ উদ্দীন আহমেদের নাম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের দলিলের গেজেটভুক্ত হলেও শহীদ বুদ্ধিজীবীর তালিকায় তাঁর নাম নেই।

২.

মো. বেলাল হোসেনের জন্ম আনুমানিক ১৯৪৩ সালে দিনাজপুরের মুন্সিপাড়ায়। তাঁর ডাকনাম ছিল বেলু। পিতা আবদুর রহমান ছিলেন অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট। মা সালেহা খাতুন ছিলেন গৃহিণী। বাবা সরকারি চাকরিজীবী হওয়ার কারণে বেলাল হোসেন ও তাঁর পরিবারকে বিভিন্ন জায়গায় বাবার সঙ্গে বদলি হতে হতো। বেলাল হোসেন বগুড়া জিলা স্কুল থেকে ১৯৫৮ সালে মাধ্যমিক পাস করেন। ১৯৬০ সালে কুষ্টিয়া হাইস্কুল থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। সেখানে প্রাণিবিদ্যা বিভাগে পরিদর্শক পদে কিছুদিন চাকরি করেন। ১৯৬৯ সালে বেলাল হোসেন করাচিতে যান এমএসসি পড়ার জন্য। কিন্তু সেখানে তিনি খাপ খাওয়াতে পারেননি। পরে তিনি পাকিস্তানের সিন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়ে যান এবং সেখান থেকে এমএসসি সম্পন্ন করেন।

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বেলাল হোসেন সিন্ধু থেকে তাঁর বাসায় ফিরে আসেন। পরিবারের সবার সঙ্গে বেলাল হোসেন তাঁর নানার বাসা তৎকালীন ঠাকুরগাঁও মহকুমার রুহিয়ার কানিকাশালগাঁওতে আশ্রয় নেন। ১৯৭১ সালের ১৪ আগস্ট বেলাল হোসেনের তৎকালীন ঠাকুরগাঁও বিডি কলেজে (বর্তমান ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজ) যোগদানের কথা ছিল। কিন্তু ৯ আগস্ট পরিবারের আরও ৫ জনের সঙ্গে বেলাল হোসেনকে পাকিস্তানি সেনারা ধরে নিয়ে যায়। ১০ আগস্ট পর্যন্ত পাকিস্তানি সৈন্যরা তাঁদের ওপর নির্মম অত্যাচার চালায় এবং ওই দিনই হাত, পা, চোখ বেঁধে গুলি করে ৬ জনকে হত্যা করে একসঙ্গে মাটিচাপা দেওয়া হয়।

পরে ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি শহীদদের লাশ শনাক্ত করে মর্যাদার সঙ্গে নুরুল ইসলামের রামনাথ হাটস্থ বাসভবনের সামনে আবার সমাধিস্থ করা হয়। বেলাল হোসেনসহ এই গণহত্যায় শহীদ হওয়া অপর পাঁচ ব্যক্তিও এখন পর্যন্ত শহীদের স্বীকৃতি পাননি। পারিবারিকভাবে শহীদদের দাফনের জায়গাটি পাকা করা হলেও সেটিও এখন সময়ের বিবর্তনে ধ্বংসপ্রায়।

ফারজানা হক
প্রভাষক, রত্নাই বগুলাবাড়ি স্কুল অ্যান্ড কলেজ, বালিয়াডাঙ্গী, ঠাকুরগাঁও
গবেষক, ১৯৭১: গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর, খুলনা
ই–মেইল: farzanasarna07@gmail.com