পশ্চিমবঙ্গ ও ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতা ও সিপিআইএম দল থেকে রাজ্যের শেষ মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য চলে গেলেন গত বৃহস্পতিবার। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। তাঁর সমসাময়িক নেতাদের মধ্যে রয়ে গেলেন বুদ্ধদেবের থেকে বছর ছয়েকের বড় বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের জন্ম কলকাতার এমন এক পরিবারে, যেখানে বামপন্থার হাওয়া ছিল তাঁর জন্মের অনেক আগে থেকেই। তাঁর কাকা ছিলেন বামপন্থী কবি ও লেখক সুকান্ত ভট্টাচার্য। তৎকালীন প্রেসিডেন্সি কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা নিয়ে পড়াশোনা শেষ করে কিছুদিন একটি স্কুলে পড়ান বুদ্ধদেব। কিন্তু সেটা কিছুদিনই। প্রায় সেই সময়ই ১৯৬৪ সালে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া (সিপিআই) ভেঙে সিপিআইএম (কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া মার্ক্সিস্ট) গঠনের দুই বছরের মধ্যে সিপিআইএমের সদস্যপদ নেন বুদ্ধদেব। সর্বক্ষণের কর্মী হন ১৯৬৮ সালে। এরপর দ্রুত উত্থান দলে—’৭১-এ রাজ্য কমিটি, ’৮৪-তে কেন্দ্রীয় কমিটি হয়ে ২০০১ সালে সর্বোচ্চ পলিটব্যুরো সদস্য হন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।
কমিউনিস্ট আন্দোলনের পাশাপাশি ভারতের সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি দায়বদ্ধ ছিলেন বুদ্ধদেব, যে কারণে তিনি নির্বাচনেও দাঁড়ান এবং ১৯৭৭ সালে, যে বছরে বামফ্রন্ট পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসে, সেই বছরে উত্তর কলকাতার কাশীপুর থেকে বিধানসভা নির্বাচনে যেতেন বুদ্ধদেব। এরপর ১৯৮৭ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত পরপর পাঁচবার জেতেন দক্ষিণ কলকাতার যাদবপুর আসন থেকে। মন্ত্রী হিসেবে রাজ্যের বিভিন্ন দপ্তর সামলানোর পর পশ্চিমবঙ্গের সপ্তম মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে জ্যোতি বসুর জায়গায় শপথ নেন ২০০০ সালের ৬ নভেম্বর।
বুদ্ধদেবের নেতৃত্বে ২০০৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের বিপুল জয় আসে। এককভাবে সিপিআইএম ২৯৪ আসনের মধ্যে ১৭৬টি আসন পায়, বামফ্রন্ট পায় ২৩৫ আসন। বিরোধীরা প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। তৃণমূল কংগ্রেস পেয়েছিল ৩০ ও কংগ্রেস ২১টি আসন।
অনেকটা শেখ হাসিনার পতন যেমন ২০২৪-এর আগস্ট মাসের নির্বাচনে বিপুল বিজয়ের ছয় মাসের মধ্যেই শুরু হয়, বুদ্ধদেবেরও যেন প্রায় তা-ই। ২০০৬ সালের ১১ মে নির্বাচনে বিপুল জয়ের পর ১৮ মে টাটা সংস্থার চেয়ারম্যান রতন টাকা পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার সিঙ্গুরে ছোট গাড়ি তৈরির কারখানা স্থাপনের ঘোষণা করেন। ওই দিনই মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন বুদ্ধদেব, যিনি কৃষির ওপর ভিত্তি করে শিল্পায়নের স্লোগানে সেবারে সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন পেয়েছিলেন।
এ ঘোষণার এক সপ্তাহের মধ্যে সিঙ্গুরে শুরু হয় কৃষক আন্দোলন। গোড়ার দিকে সেই আন্দোলনের হাল ধরার মতো কোনো বড় নেতা-নেত্রী বা দল ছিল না। নির্বাচনে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার পরে হতাশ হয়ে কিছুদিনের জন্য সে সময় অন্তরালে ছিলেন প্রধান বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু ঠিক দুই মাস পর, ২০০৬ সালের জুলাই মাসে মমতা বুঝতে পারেন যে সিঙ্গুরে কৃষিজমি অধিগ্রহণের আন্দোলন দানা বাঁধছে। রাতারাতি তিনি সেখানে চলে যান। জুলাইয়ের ১৮ তারিখ টাটার কারখানার জন্য চিহ্নিত জমিতে ধানের বীজ রোপণ করেন মমতা। সেখানে কৃষিজমি রক্ষার আন্দোলন ধীরে ধীরে ব্যাপক আকার ধারণ করে।
পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে উত্থান শুরু হয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের, আর ভাঙন শুরু হয় বামফ্রন্টের। অবশেষে ২০১১ সালের মে মাসে বামফ্রন্টকে হারিয়ে ক্ষমতায় আসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কংগ্রেস জোট। এই হারের জন্য সিপিআইএমসহ পশ্চিমবঙ্গ ও ভারতের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের বড় অংশ প্রধানত দায়ী করেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে।
কিন্তু সত্যিই কতটা দায়ী ছিলেন বুদ্ধদেব?
বুদ্ধদেব যেটা চেয়েছিলেন, তা তিনি বারবার বলেছেন। একাধিক সাক্ষাৎকারে নির্বাচনে হারার আগে এবং পরে তিনি বলেছেন, শুধু কৃষির ওপর ভিত্তি করে একটি জাতি, সমাজ বা দেশ এগোতে পারে না, প্রয়োজন শিল্পের এবং শিল্পায়নের। সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী উত্তর বা পশ্চিম ইউরোপ, চীন থেকে যুক্তরাষ্ট্র কোথাওই এই তত্ত্ব ভুল প্রমাণিত হয়নি, বক্তব্য ছিল বুদ্ধদেবের। তাঁর এই বক্তব্যকে মেনেও নিয়েছিল তাঁর দল, তাঁর রাজ্য এবং দেশের মানুষও। নতুন স্বপ্ন ও আশা তিনি দেখিয়েছিলেন, পশ্চিমবঙ্গ ও এখনকার বাঙালিকে।
কিন্তু পরবর্তী সময়ে নানা বিশ্লেষণের মাধ্যমে বামপন্থী ও অবামপন্থী পর্যবেক্ষক ও অর্থনীতিবিদেরা দেখিয়েছেন যে বুদ্ধদেবের উদ্দেশ্য মহৎ থাকলেও তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অনেক সমস্যা ছিল। রাজ্যের এক সাবেক অর্থমন্ত্রী পরবর্তী সময়ে এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘সে সময়ে টাটা কোম্পানিকে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছিল যে তারা সিঙ্গুরের উর্বর জমি না নিয়ে যদি আরেকটু দূরে মেদিনীপুরের খড়গপুরে বা অন্য কোনো অঞ্চলে অনুর্বর জমি নেয়, তাহলে তা দিতে সুবিধা হয়। এর কারণ, উর্বর জমি মানুষ স্বাভাবিক কারণেই চট করে ছাড়তে চান না। এ ক্ষেত্রেও চাননি। কিন্তু এটা টাটাদের বোঝানো যায়নি। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যও বোঝাতে পারেননি।’ পরবর্তী সময়ে কৃষিজমি রক্ষার আরেকটি বড় আন্দোলন শুরু হয় দক্ষিণবঙ্গের নন্দীগ্রামে। বেশ কিছু মানুষ মারা যায় এবং অব্যাহত থাকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্থান। এসবের জেরেই বিদায় নিতে হয় বামফ্রন্টকে।
তবে বামফ্রন্টের পতনের জন্য শুধুই কি দায়ী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য? এখন অনেকেই বলেন যে, না, তা নয়। ২০১১ সালে পরাজয়ের আগে ৩৪ বছর ক্ষমতায় ছিল সিপিআইএম নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট। ভূমিসংস্কার আন্দোলন এবং আংশিকভাবে কৃষকদের মধ্যে জমির কাগজপত্র বণ্টনের পাশাপাশি একাধিক এমন কাজ বামফ্রন্ট করেছিল, যার ফল এখনো রাজ্যের মানুষ ভোগ করছেন। সে সময়ও দুর্নীতি থাকলেও এখনকার মতো ব্যাপক পরিমাণে ছিল না বলেও অনেকেই মনে করেন।
কিন্তু বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে একটা বড় ধরনের প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার হাওয়া তৈরি হয়েছিল। বামফ্রন্টের ভেতরেই সে সময় ও এখনো অনেকে মনে করেন, যে আদর্শের ওপর ভিত্তি করে সিপিআইএম ও বামফ্রন্ট ক্ষমতায় এসেছিল, সেই আদর্শগুলোকে পরবর্তী সময়ে, বিশেষত বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের শাসনকালে, চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। যেমন বামপন্থী শ্রমিক সংগঠনগুলোকে শিল্পের স্বার্থে দুর্বল করা হয়েছে, শিল্পের স্বার্থেই জমি নেওয়ার প্রযোজনা আঘাত করা হয়েছে কৃষক সংগঠনগুলোকে এবং সবচেয়ে বড় কথা, সংখ্যালঘু মুসলমানবিরোধী এমন মন্তব্য করা হয়েছে, যার কারণে পশ্চিমবঙ্গের এক-তৃতীয়াংশ ভোট বামফ্রন্টের দিক থেকে রাতারাতি চলে গিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেসের দিকে। এটা সম্ভবত সবচেয়ে বড় ধাক্কা।
২০০২ সালে কলকাতায় আমেরিকান সেন্টারের ওপর জঙ্গি হামলা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য পরোক্ষভাবে মাদ্রাসার বিরুদ্ধে এমন কিছু মন্তব্য করেন, যে কথা আজও পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানেরা ভুলতে পারেননি। ঘটনাটি পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের বিপুলভাবে সিপিআইএম-বিরোধী করে তোলে। এরপর আরও কয়েকটি ঘটনায় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ব্যক্তিগত স্তরে মুসলমান সমাজের কাছে অত্যন্ত অপ্রিয় হয়ে ওঠেন, যার সুবিধা নির্বাচনে পেয়ে যায় তৃণমূল কংগ্রেস।
বুদ্ধদেবের কার্যকালে সিপিআইএম এবং বামফ্রন্টের চূড়ান্ত সাফল্য যেমন এসেছে, এসেছে ব্যর্থতাও। কিন্তু একটা কথা কেউ কখনো তাঁর সম্পর্কে বলতে পারেননি যে তিনি দুর্নীতিগ্রস্ত। তাঁর চরম বিরোধীরাও বারবার বলেছেন, ‘আর যা-ই বলা যাক, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে দুর্নীতিগ্রস্ত মুখ্যমন্ত্রী বলা যাবে না।’
সারা জীবন ছোট একটি ফ্ল্যাটে থেকেছেন, সাধারণ জীবন যাপন করেছেন, সাধারণ খাবারদাবার খেয়েছেন এবং সাধারণের সঙ্গে মিশেছেন। শখ বলতে ছিল, সিগারেট খাওয়া, সিনেমা দেখা ও বই পড়া। দক্ষিণ আমেরিকার সাহিত্যিকদের একাধিক বইয়ের অনুবাদও করেছিলেন। হয়তো এই সাধারণ জীবনযাপনের কারণেই বর্ষার কলকাতায় বুদ্ধদেবের প্রয়াণে আবেগে আপ্লুত হয়েছেন বামপন্থী কর্মীর পাশাপাশি সাধারণ মানুষও।
শেষের দুটি শখ থাকলেও স্বাস্থ্যহানির কারণে সিগারেট ছাড়তে হয়েছিল বহু আগেই। ইদানীং আর সিনেমাও দেখতে পারতেন না, কার্যত তাঁর দ্বিতীয় অফিস নন্দনের সরকারি প্রেক্ষাগৃহেও যেতে পারতেন না। বই ও সংবাদপত্র পড়তেও অসুবিধা হতো। তবে রাজনীতিতে উৎসাহ হারাননি বলেই নির্বাচনের আগে ও পরে পুরোনো নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি নতুনদের সঙ্গেও দেখা করতেন। পরামর্শ দিতেন। এখন থেকে তা-ও আর দিতে পারবেন না পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।
শুভজিৎ বাগচী প্রথম আলোর কলকাতার সংবাদদাতা