শেখ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
শেখ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ

সর্বজনের জীবন ও সম্পদের লড়াইয়ের অসামান্য কারিগর

প্রকৌশলী শেখ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (৩১ জুলাই ১৯৩১—৯ আগস্ট ২০২৪) সম্পর্কে কথা বলতে গেলে ১৯৯৮ থেকে ক্রমে শক্তিশালী হওয়া ‘তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি’র আন্দোলন আর তা ছড়িয়ে পড়ার বিষয়গুলোই নানাভাবে আসতে থাকে। কারণ, এই আন্দোলনের সূত্রেই তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়।

আর এই আন্দোলনের নানা বিষয় নিয়ে অধ্যয়ন, অনুসন্ধান, গবেষণা, লেখালেখি, বিতর্ক; লিফলেট, বুকলেট, পোস্টার, বুলেটিন; এই আন্দোলনের নানা পর্বে মিছিল, লংমার্চ, ঘেরাও, স্লোগান; সারা দেশের নানা প্রান্ত সফর, পুলিশ, সন্ত্রাসী, মন্ত্রী ও ভাড়াটে গবেষক মোকাবিলা; ব্যক্তি গ্রুপ সংগঠন রাজনৈতিক দল নিয়ে অসংখ্য সভা—এসব নিয়েই তাঁর সঙ্গে ছিল আমার প্রতিদিনের সম্পর্ক। বাংলাদেশ আর এই দেশের মানুষের জীবন-মরণের বিষয় ঘিরে আমাদের উদ্বেগ, ক্রোধ, বেদনা, আনন্দ ও আশার অনেক কিছুই অভিন্ন ছিল।

’৯০ দশকের শেষ দিকে মার্কিন কোম্পানি বাংলাদেশের গ্যাস ভারতে রপ্তানির জন্য ব্যাপক তৎপরতা চালাতে থাকে। সিলেটের বিবিয়ানা তখন মার্কিন কোম্পানি ইউনোকলের হাতে। এর আগে অক্সিডেন্টাল সিলেটের শ্রীমঙ্গলের পাশে মাগুরছড়া গ্যাসফিল্ডে বড় আকারের দুর্ঘটনা ঘটায়। কোনো ক্ষতিপূরণ না দিয়ে ইউনোকলের কাছে ব্যবসা বিক্রি করে অক্সিডেন্টাল বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যায়।

পেট্রোবাংলা বা জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ছাড়া এটা হওয়ার কথা নয়। জ্বালানিসচিব তখন তৌফিক–ই–ইলাহী চৌধুরী। জ্বালানি মন্ত্রণালয়কে বহুজাতিক কোম্পানির আস্তানা বানানোর ক্ষেত্রে এই ব্যক্তির ভূমিকা যে অন্যতম, তা পরে আরও স্পষ্ট হয়েছে। ইউনোকলের কাছ থেকে শেভরন এখন ব্যবসা চালাচ্ছে। এতগুলো সরকার পার হলো, ক্ষতিপূরণ এখনো আদায় হয়নি।

সে সময় ‘গ্যাস রপ্তানি হলে বাংলাদেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে’ এ রকম প্রচারণায় মার্কিন দূতাবাসের সঙ্গে আরও যুক্ত হয়েছিল বিশ্বব্যাংক, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মন্ত্রী, আমলা, কনসালট্যান্ট ও কতিপয় সংবাদপত্র। লিখে, সেমিনারে ও সমাবেশে তথ্যযুক্তি দিয়ে এসব প্রচারণার মোকাবিলা ছিল তখন জরুরি কাজ।

২০০১ সালে ঢাকার ওসমানী উদ্যানে জাতীয় কমিটির প্রথম কনভেনশন হলো। ১০ সহস্রাধিক মানুষের উপস্থিতিতে অবিলম্বে গ্যাস রপ্তানির চক্রান্ত বন্ধ এবং জাতীয় স্বার্থবিরোধী পিএসসি চুক্তি বাতিল না করলে লংমার্চের কর্মসূচি ঘোষিত হলো—ঢাকা থেকে সিলেটের বিবিয়ানা। সেই যে শুরু হলো, তারপর লংমার্চ, রোডমার্চ নামে অনেকগুলো কর্মসূচি হয়েছে। ঢাকা-বিবিয়ানা (২০০২), ঢাকা-চট্টগ্রাম বন্দর (২০০২), ঢাকা-মোংলা (২০০৩), ঢাকা-টেংরাটিলা (২০০৫), ঢাকা-ফুলবাড়ী (২০০৬), ঢাকা-কক্সবাজার (২০০৯), ঢাকা-বড়পুকুরিয়া-ফুলবাড়ী (২০১০), ঢাকা-চট্টগ্রাম (২০১১), ঢাকা-সুনেত্র (২০১১), ঢাকা-সুন্দরবন (২০১৩), ঢাকা-সুন্দরবন (২০১৬)। সভা-সমাবেশ পদযাত্রা মিছিল অসংখ্য। এর মধ্যে সময় গেল প্রায় ১৫ বছর। মনে হয়নি কখনো যে শহীদুল্লাহ ভাইয়ের বয়স বেড়েছে। এসব কর্মসূচিতে পায়ে হাঁটার বড় অংশ থাকে, খাওয়া, বিশ্রাম ও ঘুম এগুলোরও অনিয়ম অনিশ্চয়তা থাকে। শহীদুল্লাহ ভাইকে এসবে কখনোই ক্লান্ত দেখিনি।

শহীদুল্লাহ ভাই নেই; কিন্তু এই দেশ এখানে থাকবে না, আত্মমর্যাদা ও মালিকানার লড়াই আরও বহু লড়াইয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এই দেশকে মানুষের সমাজে নিয়ে যাবে। বৈষম্য-নিপীড়নমুক্ত সাম্যের এক স্বাভাবিক জগতে মানুষ নিজেকে উন্মুক্ত করতে সক্ষম হবে। জীবন ও সম্পদের ওপর এই দেশের মানুষ তার পূর্ণ কর্তৃত্ব পাবে। শেখ মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে সেই সমাজ নির্মাণের চিন্তা ও লড়াইয়ের অসামান্য নেতা-সংগঠক-কারিগর হিসেবে অবশ্যই স্মরণ করতে হবে।           

স্বাধীন বিশেষজ্ঞদের মোকাবিলা এবং ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী হতে থাকা জনপ্রতিরোধে ২০০২ সালের মধ্যে গ্যাস রপ্তানির অপচেষ্টা দুর্বল হয়ে পড়ে। গ্যাস রপ্তানির চক্রান্ত দুর্বল হলেও ঝুঁকি থেকেই যায়। কারণ জ্বালানি সম্পদ বিষয়ে আমাদের মূল দাবিগুলোর মধ্যে অন্যতম ‘উৎপাদন বণ্টন চুক্তি বাতিল’ হয়নি। এই চুক্তি বাতিল না হওয়া পর্যন্ত ফাঁদ থেকে আমাদের নিষ্কৃতি নেই। রপ্তানির বিধান রেখে তাই এখনো চুক্তি হচ্ছে।

২০০২-০৩ সময়কালে চট্টগ্রাম বন্দর জালিয়াত মার্কিন কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়ার কয়েক বছরের চক্রান্ত নিয়ে আমাদের মনোযোগ দিতে হয়। গ্যাস রপ্তানি প্রকল্পে ব্যর্থ হওয়ার পর সরকার- বিশ্বব্যাংক-টাটা-ঠিকাদার গবেষকদের নতুন প্রস্তাবনা হাজির হয় টাটা প্রকল্প হিসেবে। ২০০৪ ও ২০০৫ সালে টাটার প্রকল্পগুলোকে মোকাবিলা করেও আমাদের অনেক কর্মসূচি নিতে হয়।

২০০৫ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে ফুলবাড়ীতে এশিয়া এনার্জি নামের একটি বিদেশি কোম্পানির উন্মুক্ত কয়লাখনি প্রকল্পের বিরুদ্ধে সেখানকার প্রতিবাদী জনগণ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। সরকারের কোনো দপ্তরেই ফুলবাড়ী কয়লা প্রকল্প নিয়ে কোনো কাগজপত্র পেলাম না, সরকারের কোনো সমীক্ষা বা মূল্যায়ন এমনকি কোনো সারসংক্ষেপও না। সরকারি দপ্তরে কাগজপত্র থাকে না, জনগণ কিছুই জানেন না; কিন্তু ঠিকই জনগণের জীবনসম্পদ নিয়ে ভয়াবহ চুক্তি হয়ে যায়!

শেষ পর্যন্ত এই প্রকল্প বোঝার জন্য এশিয়া এনার্জির সব দলিলপত্র পরীক্ষা করেই আমরা নিশ্চিত হলাম যে যেসব শর্তে এই প্রকল্প হতে যাচ্ছে এবং যে পদ্ধতিতে কয়লা তোলার প্রস্তাব দিয়েছে একটা বিদেশি কোম্পানি, তাতে আবাদি জমি, মাটি, পানি ও মানুষ সবই ধ্বংস হবে; কয়লা বা তার দামও বাংলাদেশ পাবে না। আমাদের অবস্থান নিশ্চিত হলো—ফুলবাড়ী কয়লা প্রকল্প বাতিল এবং জালিয়াত ভুঁইফোড় কোম্পানি এশিয়া এনার্জিকে বহিষ্কার করতে হবে।

এরপর আমরা শহীদুল্লাহ ভাইসহ কতবার ফুলবাড়ী গিয়েছি, তার সংখ্যা গণনা করা কঠিন হবে। এ ছাড়া একদিকে হামলা-মামলা ও হুমকি; অন্যদিকে অবিরাম তথ্য-যুক্তি-তাত্ত্বিক লড়াই চলল।

তথ্য, যুক্তি এবং সজাগ জনগণের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধে এশিয়া এনার্জি ফুলবাড়ী ত্যাগ করতে বাধ্য হয় ২০০৬ সালের ২৬ আগস্ট। ওই দিন এশিয়া এনার্জি ঘেরাও কর্মসূচি ছিল। চারদিকে পুলিশ, র‌্যাব ঘেরাও দিয়ে মানুষের ঢল ঠেকানোর চেষ্টা করলেও প্রায় ৮০ হাজার বাঙালি-ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষ জড়ো হন সেদিন।

শহীদুল্লাহ ভাই ও আমি দেখলাম, মানুষের মধ্যে প্রাণের প্রকাশ, যেন ঐক্য ও প্রতিরোধ সৃষ্টির উৎসব। গুলিতে ৩ জন তরুণ নিহত, ২০ জন গুলিবিদ্ধ, ২ শতাধিক জখম হওয়ার পরমুহূর্ত থেকে ৩০ আগস্ট ফুলবাড়ীসহ ছয়টি থানার মানুষের গণ-অভ্যুত্থান বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অসাধারণ পর্ব তৈরি করে। পুরো দেশ পাশে এসে দাঁড়ায়। ৩০ আগস্ট সারা দেশে হরতাল পালিত হয়। চারদলীয় জোট সরকার সারা দেশে উন্মুক্ত পদ্ধতি নিষিদ্ধ এবং এশিয়া এনার্জিকে বহিষ্কারের দাবি মেনে চুক্তি স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়।

এরপর সদ্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০০৯ সালে কনোকো ফিলিপসের সঙ্গে চুক্তি বাতিলের জন্য পেট্রোবাংলা ঘেরাও, ২০১১ সালে একই দাবিতে হরতাল কর্মসূচিতেও ব্যাপক দমন-পীড়নের শিকার হই আমরা। এ সময় আবার সুন্দরবনবিনাশী রামপাল প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। তখন থেকে এই প্রকল্প বাতিল করে সুন্দরবন বাঁচানোর আন্দোলনই আমাদের প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়ায়। গবেষণা, মিছিল, সভা-সমাবেশ, দুটি লংমার্চ এমনকি হরতাল পর্যন্ত করতে হয়।

স্বৈরতন্ত্রী সরকার বিপুল জনমত ও বিশেষজ্ঞ মত অগ্রাহ্য করে সুন্দরবনবিনাশী রামপালসহ নানা তৎপরতা শুরু করে। আমাদের আরও অনেক হামলা ও হুমকি মোকাবিলা করতে হয়। আরও যোগ হয় চীনের একাধিক কয়লা ও রাশিয়ার পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প। বিশাল ঋণ এবং ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে বাংলাদেশ! আমরা পাল্টা মহাপরিকল্পনা দিলাম ২০১৭ সালে। অসুস্থ হওয়ার আগপর্যন্ত এসব বিষয়ে কথা ও প্রতিবাদ কর্মসূচিতে শহীদুল্লাহ ভাই সরব ছিলেন।   

শহীদুল্লাহ ভাইয়ের জীবনের অভিজ্ঞতা বিশাল ও বৈচিত্র্যময়—রেকর্ড নম্বর পেয়ে পরীক্ষায় অসাধারণ কৃতিত্ব, প্রকৌশলী হিসেবে দেশ-বিদেশে সফর ও বিরল সাফল্য, গোপন বিপ্লবী পার্টির ইশতেহার ছাপিয়ে পৌঁছে দেওয়ার সময় গ্রেপ্তার, মুক্তিযুদ্ধে দুই ভাইকে হারানো, পেশাগত ক্ষেত্রে সহকর্মীদের সঙ্গে ঐক্য-সংঘাত এবং বিপ্লবী রাজনীতির সার্বক্ষণিক সহযোগীর ভূমিকা পালন। বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় তিনি ছিলেন আজীবন সংগ্রামী, দেশের শাসক-শোষক এবং মার্কিন-ভারতসহ সব সাম্রাজ্যবাদী-আধিপত্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন আপসহীন।

শহীদুল্লাহ ভাই নেই; কিন্তু এই দেশ এখানে থাকবে না, আত্মমর্যাদা ও মালিকানার লড়াই আরও বহু লড়াইয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এই দেশকে মানুষের সমাজে নিয়ে যাবে। বৈষম্য-নিপীড়নমুক্ত সাম্যের এক স্বাভাবিক জগতে মানুষ নিজেকে উন্মুক্ত করতে সক্ষম হবে। জীবন ও সম্পদের ওপর এই দেশের মানুষ তার পূর্ণ কর্তৃত্ব পাবে। শেখ মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে সেই সমাজ নির্মাণের চিন্তা ও লড়াইয়ের অসামান্য নেতা-সংগঠক-কারিগর হিসেবে অবশ্যই স্মরণ করতে হবে।           

  • আনু মুহাম্মদ শিক্ষক, লেখক এবং ত্রৈমাসিক জার্নাল সর্বজনকথার সম্পাদক