ডা. মোহাম্মদ শফীর কোলে লেখিকা
ডা. মোহাম্মদ শফীর কোলে লেখিকা

শেষ...আর ফিরে এলেন না আমাদের বাবা

মার্চ জাতীয়ভাবে আমাদের কাছে ভীষণ তাৎপর্যপূর্ণ মাস। এ মাস এলেই প্রতিবছর শিশুর চিক্কুর, ছোট ছোট স্মৃতি ঘুরপাক খায়। জীবনে কাজ যতই থাকুক, এ তারিখ এলে ছোট্ট ছোট্ট স্মৃতি মনের গহিনে হেঁটে বেড়ায়।

আমার বাবা চট্টগ্রামের দন্তচিকিৎসক ডা. মোহাম্মদ শফী। আমরা তখন থাকি শহরের এনায়েতবাজার এলাকার বাটালী রোডে। মনে পড়ে, একদিন বাবা আমার বড় একটা শোকেসের ওপর রাখা রেডিও শুনছিলেন। বেশ বড় রেডিও বর্তমানে এমন সাইজের টিভি থাকে অনেকেরই ঘরে। আমরা ছোটরা চেয়ার টেনে তাতে উঠে দেখতাম।

সেদিন আব্বা চেম্বার থেকে বেরিয়ে এসে রেডিও ছাড়লেন কিছু একটা শুনতে! দেখলাম বাবা মাথা নিচু করে দুই হাতের ওপর মাথা রেখে কী যেন মনোযোগ দিয়ে শুনছেন। আমি দৌড়ে গিয়ে বাবার দুই পায়ের ফাঁক দিয়ে আসা–যাওয়া করে খেলছিলাম। আমি খেলছি, বাবা মনোযোগ দিয়ে রেডিও শুনছেন। পরে জানতে পেরেছি, ওটাই ছিল ৭ মার্চের মহাকাব্যিক ভাষণ, মহান নেতার বজ্রকণ্ঠের স্বাধীনতার ডাক।

তারপর এল সেই ২৫ মার্চের ভয়াল কালরাত্রি। মশারির ভেতর শুয়েছি, ঘুমাইনি তখনো, হঠাৎ ভয়ংকর আওয়াজ! কিসের আওয়াজ, তা–ও বুঝি না। আব্বা ছুটে গিয়ে বিছানা থেকে সবাইকে নামিয়ে খাটের নিচে ঢুকিয়ে দিচ্ছিলেন। ছোটাছুটি করে অন্যদেরও মেঝেতে নামালেন। রাতভর ভয়াবহ আগুনের গোলার আওয়াজে আমরা ছোটরা ভয়ে–আতঙ্কে কাঁপছি, কাঁদছি, বড়দের শঙ্কাভরা চোখমুখ আমি ভুলিনি আজও। তখনো যুদ্ধ ও তার বিভীষিকা বোঝার বয়স হয়নি আমার। আগামী দিনগুলোতে কী অপেক্ষা করছে, তা–ও অনুমান করতে পারিনি।

পরদিন থেকেই দেখেছি, বাসায় আব্বা, আম্মা (মুশতারী শফি), বেলাল মোহাম্মদ কাকু, এহসান মামা, আলমগীর মামা, কাসেম মামা, ফারুক ভাই—সবাই লুকিয়ে বা আড়ালে কী সব বলছে। এদিকে বাসায় মেহমান ভরে গিয়েছিল আর বেশ কয়েক দিন আগে থেকেই তাতে ছোটদের কী আনন্দ! রাতে দেখলাম, লাইট জ্বালাচ্ছে না, নাকি কারেন্ট নেই, তা–ও বুঝিনি তখন। তবে হ্যারিকেনের আলোয় সবাই গোল হয়ে বসে ছোট্ট একটা রেডিও চালিয়ে বড়রা কী সব শুনছে আর লিখছে, তা দেখতাম। আমি ছোট, হ্যারিকেনের সঙ্গে খুব একটা পরিচয় ছিল না বলেই ওই শান্ত আলোতে আব্বা–আম্মা মামাকে আমি গভীরভাবে দেখছি আড়াল থেকে।

অনেক পরে জেনেছি, বেলাল কাকুরা চলে গিয়েছিলেন কালুরঘাটে রেডিও সেন্টারে আর আম্মা, আব্বা ও মামা দেশি-বিদেশি রেডিও শুনে নিউজ তৈরি করতেন, পরে সেগুলো প্রচারের জন্য কালুরঘাটে পাঠাতেন আলমগীর মামাকে দিয়ে।

একটু বড় হয়ে জেনেছিলাম, আব্বা–আম্মা ও বেলাল কাকুদের ফিসফিস করে আলোচনাগুলো ছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র সৃষ্টির চিন্তাভাবনা।

এখন ভেবে অবাক লাগে যে ছোট্ট আমিসহ আমার ভাইবোনরা তখন কত কীর্তিমান মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিলাম! বড় হওয়ার পর থেকে এই অনুভূতি আমাকে গর্বিত করে, বলিষ্ঠ করে, আনন্দ দেয়।

এরপর এল ২৭ মার্চ। পরে জেনেছি, দুই ট্রাকভর্তি কী সব এল, আমরা ছোটরা কী খুশি! যেন আমাদের জন্য কার্টনভর্তি চকলেট, বিস্কুট বা খেলনা এসেছে। আম্মা তা–ই বোঝালেন। আমি এমনিতেই আব্বার কাছে ঘেঁষে ঘেঁষে থাকতাম, আব্বার কাছে প্রায় ঘুমাতাম, তখন থেকে প্রতিদিন ঘুমাচ্ছি।

আব্বা রাতে এশার নামাজ পড়ে দেরি করে ঘুমাতে আসতেন। আমিও আব্বার সঙ্গে নামাজে ওঠাবস করতাম আব্বাকে অনুসরণ করে। তারপর আব্বার কোলে শুয়ে আদর নিতাম। আব্বার তসবিহ পড়া শেষ হলে আমাকে কোল থেকে নামিয়ে পাশে শোয়াতেন। আর আমি আব্বার নরম–ঠান্ডা বুকে মুখটা গুঁজে আরাম নিতে নিতে ঘুমিয়ে যেতাম। বড় হয়ে জেনেছি, দুটি ট্রাকভর্তি ছিল গোলাবারুদ আর অস্ত্র, যা আব্বা–মামাকে দিয়ে আবারও ট্রাকে তুলে পাকিস্তানিরা নিয়ে গেল ৭ এপ্রিল।

এবার এল আমাদের সব হারানোর দিন ৭ এপ্রিল। এদিন আমাদের পুরো পরিবারটি তছনছ হয়ে গেল। আমাদের বাড়ি ঘেরাও করল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। আমাদের লুকোনো হলো আম্মার ড্রেসিংরুমে। সবাই চুপচাপ বসে আছি। হঠাৎ একজন হানাদার দরজাটা খুলে ফেলল। আমরা ভয়ার্ত চোখে তাকে দেখি, সে মৃদু হাসল, কিচ্ছু না বলে দরজা বন্ধ করে দিল। বেঁচে গেলাম আমরা বাচ্চারা।

হঠাৎ দেখলাম দরজাটা হাট করে খুলে দিল। জানলাম, পাকিস্তানিরা বাসা থেকে চলে গেছে। আব্বা ক্লান্ত হয়ে মাটিতে বসে খাটে হেলান দিয়ে দুই হাত দুই পাশে ছড়িয়ে দিলেন। বড় আপার কাছ থেকে পানি খেতে চাইলেন। আমি আর ধৈর্য রাখতে না পেরে হামা দিয়ে আব্বার কাছে গেলাম, জড়িয়ে ধরে চুমু খেলাম। আব্বাও আদর করে বললেন, ‘ওই ড্রেসিংরুমেই থাকো মা।’ ফিরে এলাম হামা দিয়ে। তার কিছুক্ষণ পরেই পোড়া গন্ধ পাই। সবাই বলছে, আগুন দিয়েছে ওরা পাশের বাড়িটায়। কী চিৎকার তাদের! সঙ্গে শুরু হলো আমাদেরও কান্না।

দেখলাম, মিনু খালা, বড় আপা কোরআন শরিফ পড়ছে আর কাঁদছে। হঠাৎ আব্বা দরজায় দাঁড়িয়ে পর্দা দিয়ে নিজের দীর্ঘ শরীরটা একটু ঢেকে বললেন, ‘ডল, তোমাকেও ওরা ডাকছে।’ সঙ্গে সঙ্গে আরও তীব্র আর্তনাদ! তার মানে তারা যায়নি তখনো, সদর দরজা হাট করে খোলা ছিল। আম্মাকে ডাকছে বলার সঙ্গে সঙ্গে মিনু খালা ফিট হয়ে গেলেন। আম্মা খালাকে পানির ঝাপটা দিয়ে, মুখে হালকা চড় দিয়ে জাগালেন।

বললেন, ‘মিনু আপা, আপনার কাছে দিয়ে গেলাম বাচ্চাদের, ফিরোজের সঙ্গে ওদেরও দেখবেন নিশ্চয়ই।’ শোনার সঙ্গে সঙ্গে খালা আবারও ফিট। আম্মা আর ফিরে তাকালেন না। আপাসহ আমাদের সবাইকে একটু আদর করেই বেরিয়ে গেলেন, সঙ্গে আব্বা আর একমাত্র মামা এহসান। ভাবি এখন, কতটা যন্ত্রণা হচ্ছিল তখন আব্বা–আম্মার। বড় আপা তখন বোঝাচ্ছে, ‘কাঁদে না, আম্মা–আব্বা দুজনেই চলে আসবে, শুধু আল্লাহ আল্লাহ বলো।’ তারপর দৌড়ে গিয়ে খালাকে পানির ছিটা দিয়ে ডাকতে ডাকতে জাগাল। এদিকে ঘর ভরে যাচ্ছে ধোঁয়ায়। সব জানালা বন্ধ করল আপা–ভাইয়েরা। আর মনে নেই...

হঠাৎ শুনি কলিং বেল। দেখি আম্মা! আম্মা ফিরে এসেছে। দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম, জিজ্ঞেস করলাম, ‘আব্বু কোথায় বলো।’ বলল, একটু পরেই আসবে।

এদিকে ৬ এপ্রিল ধীরে ধীরে বাসা খালি হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু কারণ বুঝতে পারছিলাম না। পরে জেনেছিলাম, আমাদের বাসা যে ঘেরাও করা হবে, সেটা শহরের অনেকেই জানত। কী দুর্ভাগ্য, আমাদের তারা কেউ জানাল না।

যা–ই হোক, ৭ এপ্রিল প্রায় দুপুর নাগাদ আবারও বেল বাজল। চমকে দেখি, আব্বা ফিরে এসেছেন! কী শান্তি সবার। আব্বা বলেছিলেন, তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সার্কিট হাউসে। সেখানে তখন পাকিস্তানি জেনারেল বেগ ছিল আব্বার পেশেন্ট। আব্বাকে দেখামাত্র বলল, ‘ও তো আমার ডাক্তার, ওকে নিয়ে এসেছ কেন? ওকে ছেড়ে দাও।’ আব্বা ছাড়া পেলেন। তবে পরে বুঝতে পেরেছি, সবটাই ছিল নাটক।

তাড়াতাড়ি আম্মা টেবিলে খাবার দিলেন। আমরা সবাই আব্বাকে নিয়ে খেতে বসেছি। আব্বা হয়তো দু–তিনবার মুখে ভাত তুলেছিলেন, এমন সময় আবারও বেল। আরও একদল পাকিস্তানি হানাদার এসে বলল, আব্বাকে যেতে হবে। খাবার ছেড়ে উঠে হাত ধুয়ে ইশারায় সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন আব্বা। শেষ...আর ফিরে এলেন না আমাদের বাবা।

ঠিক সেই মুহূর্তে বুঝিনি, বাবাকে আর পাব না। সন্ধ্যা গড়াতেই আমি আব্বা কখন আসবে, জিজ্ঞেস করছি সবাইকে। আপা (বড় বোন ইয়াসমিন) আমাকে বারবার বোঝায়, ‘তুমি ঘুমাও, চলে আসবে।’ আমার সে কী কান্না, যদিও আমি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতাম। আপা আমাকে নিয়ে আব্বার বিছানায় শোয়ায় আর আদর করতে করতে ঘুম পাড়িয়ে দেয়।

ভোর অন্ধকারে আমাকে জাগিয়ে তুলল আপা, সঙ্গে সঙ্গে আমার জিজ্ঞাসা—আব্বা কোথায়, আসেনি? আপা মুখ চেপে ধরেই বলল, ‘একদম চুপ থাকো আপু, আমরা আব্বার কাছেই যাচ্ছি।’ আমিও সুবোধ শিশুর মতো চুপ থাকলাম। একটা জাঙ্গিয়ার জায়গায় দুটো পরাচ্ছে, একটা ফ্রকের জায়গায় দুটো পরাচ্ছে। আমিও বলেছি, দুটো কেন পরাচ্ছ! ও বলল—চুপ। বাইরে শয়তানরা আছে, কথা বলা যাবে না।

তারপর শুরু হলো আমাদের দিগ্‌ভ্রান্তের মতো এদিক থেকে ওদিক ছোটা। সেদিন থেকেই আমরা বাড়িহারা হলাম। হলাম শিশু শরণার্থী। প্রথম দুই জায়গায় আশ্রয় না পেয়ে আমিসহ ছোট্টদের বাধ্য হয়ে রাখা হলো কবরস্থানের লাশ রাখার ঘরে। তখন বুঝিনি, কোথায় আছি আমরা। বড় ভাইয়েরা বারবার বলছিল, সবাই লম্বা হয়ে শুয়ে থাকো, কেউ এলে নিশ্বাস বন্ধ করে রাখবে। জিন্দা লাশ হয়ে শুয়ে ছিলাম আমরা, আর শুনতে পাচ্ছিলাম, লাশ রাখার ঘরের ছাদে মিলিটারির পায়ের শব্দ। খটখট বুটের আওয়াজ এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যাচ্ছে। মাঝেমধ্যে খ্যাঁক খ্যাঁক করে কাশি দিচ্ছে, কফ ফেলছে তারা। আমরা ভয়ে ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিলাম। মনে মনে ভাবছিলাম, আলমগীর মামা কখন আসবেন আমাদের নিতে।

বেশ পরে মামা এলেন আর আমাদের চুপচাপ ধীরে ধীরে বের করে রাস্তায় নেমে গেলেন। সেখান থেকে অপরিচিত এক বাসায় গিয়ে আম্মাদের পেলাম। কিন্তু বেশিক্ষণ ছিলাম না আম্মার সঙ্গে। ওখান থেকে আবার আমাদের নেওয়া হলো ছোট খালার বাসায়। আম্মা কোথায়, আমরা জানি না। কয়েক দিন পর হঠাৎ আলমগীর মামা এলেন আমাদের নিতে। এবার ছেড়ে এলাম বড় বোনকে (ইয়াসমিন)। আব্বা কোথায়? আম্মা কোথায়—কিচ্ছু জানি না। এখন থেকে আপাও জানবে না, আমরা ছয় ভাইবোন কোথায়।

পরে জেনেছি, আম্মা চিঠি লিখে মিনতি করেছেন আপাকে খালা–খালুর কাছে রাখতে। কারণ, ও গায়েগতরে বড় হয়ে উঠছিল। অজানার উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার আগে আপা আবারও দুটো করে কাপড় পরিয়ে দিল আর হাতে গুঁজে দিল একটা করে কাগজ। বলল, ‘এটা দোয়া, সঙ্গে রেখো। ইনশা আল্লাহ, তোমরা আম্মার কাছে পৌঁছে যাবে। সাবধানে যেয়ো, মামার কথা শুনো।’ আমরা ছোট তিনজন মনে হয় বুঝিনি, আপাকে দীর্ঘদিন দেখতে পাব না। কাঁদতাম, তবে না বুঝে। শুরু হলো আমাদের শিশু শরণার্থীদের নতুন জীবন।

যুদ্ধ শিখিয়েছে অনেক কিছু—পথ চলতে, দৌড়াতে শিখিয়েছে; নীরবে কাঁদতে শিখিয়েছে; মায়ের কষ্ট বুঝতে শিখিয়েছে; সব মেনে নিতে শিখিয়েছে; লাইন ধরে বাথরুমে যেতে শিখিয়েছে; বাথরুমে খেলা যায় না শিখিয়েছে; বিনা সাবানে মাসের পর মাস গোসল করতে শিখিয়েছে; না খেয়ে থাকতে পারা শিখিয়েছে; কথায় কথায় কোনো আবদার করা যায় না, তা–ও শিখিয়েছে...শেখার শেষ ছিল না আমাদের, যুদ্ধ শেষে বাবা–মামাকে ফিরে পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে শিখিয়েছে। আরও কত! তাই তো প্রথম স্কুলে ক্লাস ওয়ান পড়তে হয়নি, সরাসরি ক্লাস টুতে। ৯ মাসের যুদ্ধ একটা ছোট্ট শরণার্থীকে এক ধাক্কায় দুই বছরের বড় করে দিল আর চেতনায় করে দিল আরও বড়!

(আব্বা, তুমি আর মামা ৭ এপ্রিল চলে গেলে, আমাদের করে গেলে অসহায় ছোট ছোট শিশু–কিশোর শরণার্থী। হ্যাঁ বাবা, তোমাকে হারিয়ে পদে পদে হোঁচট খেতে খেতে অনেক কিছু শিখেছি, তোমাকে ছাড়া থাকতে পারাও শিখেছি। এই ছিল আমাদের ভাগ্যে)

  • রুমানা শফী ডা. মোহাম্মদ শফীর মেয়ে