সাদি মহম্মদ
সাদি মহম্মদ

সাদি মহম্মদ কেন পদকের জন্য আত্মহত্যা করতে যাবেন

তখন আমি বানারসে। বানারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি, উত্তর প্রদেশ, ভারত। এমএফএ করছিলাম। এক অসাধারণ মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল বানারস হিন্দু ইউনিভার্সিটিতে। মহানায়েক। তাঁর পুরো নামটা এখন আর ঠিক মনে করতে পারি না। কী যেন মহানায়েক। ছেলেটি ল ডিপার্টমেন্টে পড়তেন। আমাদের ভিজ্যুয়াল আর্টস ফ্যাকাল্টিতে প্রায়ই আসতেন। বিনোদ সিং স্যারের সঙ্গে ভাস্কর্য বিভাগে বেশির ভাগ সময় বসে আড্ডা দিতেন।

বিনোদ সিং স্যার ছিলেন আরেকজন অসাধারণ মানুষ। অধিকাংশ সময় ছাত্রদের নিয়ে ডিপার্টমেন্টের বিভিন্ন জায়গা, ফ্যাকাল্টির বিভিন্ন জায়গা পরিষ্কার করতেন এবং গাছ লাগাতে খুব পছন্দ করতেন। মহানায়েকজিও গাছ খুব পছন্দ করতেন। ইউনিভার্সিটিতে প্রায় তিন হাজার গাছের চারা লাগিয়েছিলেন এই মহানায়েকজি। তাঁর এই কৃতিত্বের পুরস্কারস্বরূপ উপাচার্য থেকে ‘গ্রিন বয়’ উপাধি দিয়েছিলেন।

একদিন বিনোদ সিং স্যার, মহানায়েকজি এবং আরও কয়েকজন ছাত্র মিলে পাথরের ওপর বসে সবাই আড্ডা দিচ্ছিলেন। কাজে বিরতি দিয়ে আমিও সেখানে যোগ দিলাম। তখন স্বাচ্ছন্দ্যে হিন্দি বলতে শিখিনি, তাই শুনতাম বেশি, বলতাম কম।

মহানায়েক জি বলছেন, ‘স্যার আমি ল ডিপার্টমেন্টের ছাত্র হলেও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটা ফ্যাকাল্টিতে আমি খুব যাই। আপনাদের ভিজ্যুয়াল আর্টস ফ্যাকাল্টিতে আসি। মিউজিক ফ্যাকাল্টি আর অ্যাগ্রিকালচার ফ্যাকাল্টিতে যাই। এই যে আপনাদের এখানের ছাত্ররা পাথর কাটছে সারা দিন ধরে কষ্ট করে, তারপর একটা অবয়ব দিচ্ছে, একটা মূর্তি বানাচ্ছে, এর মধ্যে একটা সৃষ্টির আনন্দ আছে স্যার। আবার মিউজিক ফ্যাকাল্টিতে যখন যাই তখন দেখি, ওরা গান বাঁধে সুর দেয়, গান গায়, শত হতাশার মধ্যেও একটা সৃষ্টির আনন্দ আছে। আবার অ্যাগ্রিকালচার ফ্যাকাল্টিতে যখন যাই, তখন দেখি গবেষণা করছে, বীজ বপন করছে, অঙ্কুরিত হচ্ছে, গাছ হচ্ছে, ফুল হচ্ছে, ফল হচ্ছে—সবকিছু মিলিয়ে একধরনের আনন্দ এই শিক্ষার মধ্যে আছে। হতাশা কমবেশি সবারই আছে। হতাশা থাকবেই, তারপরও এই কাজের যে আনন্দ স্যার, এটা আপনাদের এই তিনটা ফ্যাকাল্টিতে আমি পাই।’

ক্যাম্পাসে মাঝেমধ্যেই দেখা হতো মহানায়েকজির সঙ্গে। কখনো কখনো সকালবেলা সুইমিংপুলে, চায়ের দোকানে, গঙ্গার ঘাটে। এক কথা দুকথা হতে হতে একধরনের বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল আমার মহানায়েকজির সঙ্গে। মাঝে মাঝে আমার ইন্টারন্যাশনাল হোস্টেলে আসতেন। একসঙ্গে ডাইনিংয়ে খেতাম। সময় থাকলে আড্ডা হতো এখানে–সেখানে।

২০০০ সাল। সে বছর ‘ভারত রত্ন’ উপাধি দেওয়া হলো সানাই বাদক ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খাঁ এবং কণ্ঠশিল্পী লতা মঙ্গেশকরকে। সেই সময় প্রথম মহানায়েকজির কাছেই জানলাম ভারতের সবচেয়ে বড় তিনটি উপাধির নাম—ভারতরত্ন, পদ্মবিভূষণ ও পদ্মশ্রী।

আমি মহানায়েকজিকে প্রশ্ন করেছিলাম, ‘আচ্ছা, রবীন্দ্রনাথকে কি ভারত সরকার ভারতরত্ন উপাধি দিয়েছে?’

মহানায়েকজি বলেছিলেন, ‘দেখুন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং মহাত্মা গান্ধী—তাঁরা এতই বড় মানুষ যে তাঁদেরকে যত বড় উপাধিই দেওয়া হোক না কেন, উপাধি ছোট হয়ে যাবে আর মানুষ বড় হয়ে যাবে। মানুষকে উপাধি দেওয়া হয় কেন? ছোট মানুষকে উপাধি দিয়ে বড় করার জন্য? কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বা মহাত্মা গান্ধী এতই বড় মানুষ যে তাঁর নামের আগে যত বড় উপাধি আপনি দেন, মানুষের চাইতে উপাধি ছোট হয়ে যাবে।’

আমি মনে করি, বাংলাদেশের ‘স্বাধীনতা পদক’ অথবা ‘একুশে পদক’–এর চেয়ে শিল্পী সাদি মহম্মদের ওজন অনেক ভারী। সাদি মহম্মদের মতো শিল্পীর পদকের প্রয়োজন হয় না। পৃথিবীতে অনেক বড় বড় মানুষ আছেন, যাঁরা জীবনে কোনো পদক পাননি; তাই বলে তাঁরা তো তাঁদের কাজ থামিয়ে দেননি। আবার অনেক বড় মানুষ পদক প্রত্যাখ্যান করেছেন, সে উদাহরণও পৃথিবীতে অনেক আছে।

অনেক দিন পর মনে পড়ল বানারসের কথা। মনে পড়ল আমার মহানায়েক নামে ছাত্রজীবনের এক বন্ধুর কথা। জানি না এখন তিনি কোথায় আছেন, কী করছেন।

কয়েকদিন আগে আমাদের দেশের একজন প্রবীণ এবং গুণী শিল্পী মারা গেলেন। সাদি মহম্মদ, তিনি আত্মহত্যা করেছেন। গণমাধ্যমে দেখলাম, তাঁর ছাত্র-ছাত্রী, শুভাকাঙ্ক্ষী, পরিবারের সদস্যরা এই আত্মহত্যার পেছনে দায়ী করছেন সাদির রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি বা সম্মাননা না পাওয়াকে। তাঁকে একুশে পদক দেওয়া হয়নি—এই অভিমানে নাকি শিল্পী আত্মহত্যা করেছেন।

দেশের বড় বড় শিল্পী, সাংবাদিক এবং মুক্তবুদ্ধির মানুষ যাঁরা আছেন, অনুগ্রহ করে আমার মতো এই ক্ষুদ্র লেখককে ক্ষমা করবেন। এই অভিযোগটা আমি মানতে পারি না।

আমি মনে করি, বাংলাদেশের ‘স্বাধীনতা পদক’ অথবা ‘একুশে পদক’–এর চেয়ে শিল্পী সাদি মহম্মদের ওজন অনেক ভারী। সাদি মহম্মদের মতো শিল্পীর পদকের প্রয়োজন হয় না। পৃথিবীতে অনেক বড় বড় মানুষ আছেন, যাঁরা জীবনে কোনো পদক পাননি; তাই বলে তাঁরা তো তাঁদের কাজ থামিয়ে দেননি। আবার অনেক বড় মানুষ পদক প্রত্যাখ্যান করেছেন, সে উদাহরণও পৃথিবীতে অনেক আছে।

তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, সাদি মহম্মদের মতো একজন প্রবীণ মানুষ, এত বড় মাপের একজন শিল্পী, যিনি রবীন্দ্রনাথ নিয়ে চর্চা করেন, তিনি কেন আত্মহত্যা করলেন?

আমরা জানি না। কারণ, তিনি কোনো নোট লিখে যাননি। শিল্পীরা অভিমানী হন, সেটা আমরা জানি। কিন্তু এই অভিমানের অর্থ কি আত্মহনন? মানতে পারি না। তাঁর জীবনে কষ্ট ছিল, দুঃখ ছিল, বেদনা ছিল, প্রিয়জন হারানোর কষ্ট, চোখের সামনে পিতাকে খুন হতে দেখার কষ্ট, ভগ্নিবিয়োগ, মাতৃবিয়োগ সব শুনেছি, সব জেনেছি। আমার মনে হয় না এই মহান শিল্পী বিয়োগবেদনায় আত্মহত্যা করেছেন।

শিল্পী কেন আত্মহত্যা করেছেন—এই গবেষণার দায়িত্ব আমাকে কেউ দেয়নি অথবা এই গবেষণার অধিকারও আমার নেই। তারপরও গুণীজনদের কাছে জোড় হাত করে ক্ষমা প্রার্থনাপূর্বক একটা কথা বলতে চাই, একটা নৌকা কেন ভেসে যায়? যখন তার নোঙর থাকে না অথবা নোঙরের সঙ্গে বাঁধা কাছি ছিঁড়ে যায়। আমার ধারণা, এই মহান শিল্পীর নোঙর ছিল না।

আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহ দহন লাগে
তবুও শান্তি, তবুও আনন্দ, তবুও অনন্ত জাগে।

রবীন্দ্রনাথের এমনই হাজার কথার মাঝেই তো শিল্পীর বাস। তারপরও কেন?

প্রিয় পাঠক, অনুগ্রহ করে ক্ষমা করবেন। এত বড় লেখার অবতারণা করলাম এই কারণে যে মিডিয়াতে এই কথা শুনতে আর ভালো লাগে না যে একুশে পদক দেওয়া হয়নি, তাই শিল্পী সাদি মহম্মদ আত্মহত্যা করেছেন। পদক পাওয়ার জন্য কেউ গান গায় না, পদক পাওয়ার জন্য কেউ কবিতা লেখে না, পদক পাওয়ার জন্য কেউ ছবি আঁকে না, পদক পাওয়ার জন্য কেউ যুদ্ধ করে না। এতে শিল্পীকে ছোট করা হয়। শিল্পী অনেক অভিমান নিয়ে, দুঃখ, ক্ষোভ, রাগ, বেদনা নিয়ে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। আমরা তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি।

বাংলার মানুষের অন্তরে শিল্পী সাদি মহম্মদ বেঁচে থাকবেন। উনি আত্মহত্যা করেননি, উনি মৃত্যুর সঙ্গে সমঝোতা করেছেন মাত্র। শিল্পীরা কখনো আত্মহত্যা করতে পারেন না।

  • রতন সরকার সহযোগী অধ্যাপক, চারু ও কারুকলা বিভাগ, ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ