মানুষের জীবন খুবই অনিশ্চয়তায় পরিপূর্ণ। আগামীকাল জীবনে কী ঘটবে অথবা কেমন অনুভব করব, এটুকুও বুঝতে আমরা অসহায়ভাবে ব্যর্থ। তবে আমাদের জীবনে একটি বিষয় একেবারে শতভাগ নিশ্চিত, আর তা হলো মৃত্যু। মৃত্যু শুধু নিশ্চিতই নয়, বরং জীবনের অস্তিত্বের মতোই এক ধ্রুবসত্য। মৃত্যু এমনই এক অবধারিত গন্তব্য, যাকে হয়তো সাময়িকভাবে ভুলে থাকা যায়, কিন্তু সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করা যায় না। শতসহস্র অনিশ্চয়তার মধ্যে অবিচল দাঁড়িয়ে থাকা নিশ্চয়তার নামই মৃত্যু।
মৃত্যুকে যদিও অস্বীকার করা যায় না, তবে কখনো কখনো কিছু মানুষ মৃত্যুকে ছাপিয়ে যেতে পারে। শুনতে যা-ই মনে হোক, মৃত্যুকে পরাভূত করার হিসাবটা কিন্তু একেবারে জটিল নয়। এ কথা ব্যাখ্যাতীতভাবে সত্য যে মৃত্যুর মূল কাজই হলো পৃথিবীর মঞ্চ থেকে চিরতরে আমাদের প্রস্থান নিশ্চিত করা। মৃত্যু এতটাই দৃঢ়ভাবে আমাদের এই বিদায়কে মঞ্চস্থ করে যে পৃথিবীর বুকে আমরাও কোনো একদিন উন্নত মস্তকে নিজ নিজ অবস্থানে রাজত্ব করেছি, তা এই পৃথিবী একেবারেই ভুলে যায়। তবে হ্যাঁ, কারও কারও ক্ষেত্রে চিরাচরিত এই প্রথার ব্যত্যয় ঘটে। আপাতদৃষ্টিতে তাঁদের মৃত্যু হয় ঠিকই, তবে সে মৃত্যু এই পৃথিবীর বুকে তাঁদের বিস্মৃতি নিশ্চিত করতে পারে না। আমাদের স্যার ফজলে হাসান আবেদ ছিলেন সেই কিছু বিরল মানুষের একজন।
স্যার আবেদ এমন একজন মানবসত্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন যে তাঁর অনুপস্থিতি বিল গেটসকে যেভাবে পীড়িত করে, ঠিক একইভাবে পীড়িত করে বাংলাদেশের অজপাড়াগাঁয়ের ব্র্যাক অফিসে কর্মরত কোনো নাম না জানা রাঁধুনিকেও। একজন মানুষের পক্ষে একটি বিশেষ শ্রেণির কাছে প্রিয় হয়ে ওঠা খুব একটা অস্বাভাবিক কিছু নয়; রাজনৈতিক ব্যক্তিদের আমরা প্রায়ই এ রকম অবস্থানে দেখি। কিন্তু একজন মানুষ যখন সব মানুষের কাছে বস্তুনিষ্ঠভাবে আপন হয়ে ওঠে, তখন বুঝতে হবে, সেই মানুষটি সর্বতোভাবে সার্বজনীনতায় পরিপূর্ণ।
স্যার আবেদের মধ্যে এমন কী ছিল? যাঁরা তাঁর সঙ্গে একটিবারের জন্যও সাক্ষাতের সুযোগ পেয়েছেন, তাঁরা প্রত্যেকেই আমার সঙ্গে একটি বিষয়ে দ্বিধাহীনভাবে একমত হবেন যে স্যার আবেদ জাতি, ধর্ম, বর্ণনির্বিশেষে তাঁর আশপাশের মানুষের ভেতর থেকে তাদের সবচেয়ে ইতিবাচক দিকটি প্রস্ফুটিত করে আনতে পারতেন। প্রতিটি মানুষেরই এটি একটি সহজাত ধর্ম যে তারা ইতিবাচকতা ভালোবাসে। এ কথা সত্য যে আত্মজীবনে আমরা সবাই ইতিবাচক নই, তবে এমন একটি মানুষও খুঁজে পাওয়া দুষ্কর, যে ইতিবাচক ব্যক্তির সান্নিধ্য ভালোবাসে না। স্যার আবেদের প্রতি সবার এই নিঃশর্ত অনুরাগও মূলত এ কারণেই; তিনি ছিলেন দুর্নিবার জীবনীশক্তি ও ইতিবাচকতায় পরিপূর্ণ একজন মানুষ।
২০১৮ সালের একটা গল্প বলছি। তখন আমি মাস তিনেক হলো ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে যোগ দিয়েছি। কুষ্টিয়াতে আমাদের বেশ পুরোনো একটি বাড়ি আছে, আর সেখানে আমার প্রায়ই যাওয়া হয়। প্রকৃতপক্ষে শহরের নিদারুণ চাওয়া-পাওয়া থেকে একটু অবকাশযাপনের অপচেষ্টা। কেউ কেউ অবশ্য মাঝেমধ্যে একে নিছক ছেলেমিপনা বা বাতুলতা হিসেবেও আখ্যায়িত করে ফেলেন। যা-ই হোক, কুষ্টিয়ায় একজন মধ্যবয়সী নারী অনেক বছর ধরেই আমাদের বাড়ির সার্বিক তত্ত্বাবধানে নিয়োজিত ছিলেন এবং তাঁর কাছে আমরা প্রায় সন্তানতুল্যই ছিলাম। আমার অকস্মাৎ উপস্থিতিতে তিনি খুশিও হতেন, আবার একটু বিচলিতও হতেন। এমন অবস্থায় একবার এক সপ্তাহান্তে কোনো রকম পূর্বপরিকল্পনা ছাড়াই কুষ্টিয়ার বাড়িতে হাজির হই।
সহস্র অভিযোগ-অনুযোগের পর তিনি যখন শুনলেন আমি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছি, তখন তিনি আমার দিকে একটু অবাক হয়েই তাকালেন। আমি তাঁকে ব্র্যাক এনজিও এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যকার আন্তঃঅনুষঙ্গকে বোঝানোর পর তিনি বেশ ভালোভাবেই আশ্বস্ত হলেন। কারণ, ব্র্যাকের ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পের সঙ্গে তাঁর অনেক বছরের জানাশোনা। এতে বিস্ময়ের তেমন কিছু নেই, তবে এরপর তিনি বললেন, ‘আবেদ ভাই’ আর ‘ভাবি’ নাকি একবার তাঁর গ্রামে গিয়েছিলেন। বাড়ির উঠোনে বসে সবার সঙ্গে অনেক গল্প করেছিলেন। আমিও বেশ আনন্দের সঙ্গেই তাঁকে বললাম ‘আমিও তো আপনার “আবেদ ভাবির” ডিপার্টমেন্টেই কাজ করি।’
কী বিস্ময়কর এক সন্ধিক্ষণ! যেন দুজন পরিচিত মানুষ হঠাৎ নিজেদের মধ্যে নিছক কাকতালীয়ভাবে নিকটতম কোনো আত্মীয়ের অস্তিত্ব আবিষ্কার করে ফেলেছেন। সামাজিক অবস্থান, জানাশোনা, পছন্দ বা অপছন্দ, অনাসক্তি বা কৌতূহল—সবকিছুতেই পরম বৈসাদৃশ্য বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও দুজন মানুষকে এভাবে একই দৃশ্যে মঞ্চস্থ করতে পারাটা মনে হয় একমাত্র স্যার আবেদই পারতেন।
সাম্প্রতিক কালে দেশে ও বিদেশে আজকের তরুণসমাজ অনুপ্রেরণা পেতেও ভালোবাসে, দিতেও ভালোবাসে। এ জন্যই বিভিন্ন অনুপ্রেরণামূলক সম্ভাষণ (মোটিভেশনাল স্পিচ) আমাদের সমসাময়িক যুগে বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ। শুধু প্রসিদ্ধই নয়, বরং কখনো কখনো নিছক অর্থের বিনিময়ে অনুপ্রেরণার এই প্রকাশ্য বিপণন আমাদের বিস্মিতও করে। সবিশেষ অনুযোগ ও অভিমানের সঙ্গেই বলছি, আমাদের অগ্রজদের মধ্যে স্যার আবেদের মতো এমন অনেকেই রয়েছেন, যাঁদের ক্ষুদ্রতম আত্মোৎসর্গও আগামী কয়েক শ বছর আমাদের অনুপ্রাণিত করতে এবং অনুপ্রাণিত রাখতে সক্ষম ছিল। কিন্তু বিস্মৃতির মহাসাগরে বারবার অবগাহনের যে ঐতিহ্য আমরা ভালোবেসে লালন করি, তা-ই আমাদের বিপথগামিতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আর এ জন্যই পরম গ্লানি নিয়ে বলতে হয় যে স্যার আবেদের সব অবদান আর অনুদানকে কোনো একদিন সম্পূর্ণরূপে ভুলে যাওয়া আমাদের এ জাতির পক্ষে একেবারে অসম্ভব নয় এবং এর নজির আমাদের ইতিহাসেও রয়েছে। আমাদের এই আত্মসর্বস্ব বিস্মৃতিতে স্যার আবেদের আদৌ কিছু যায় আসে কি না জানি না, তবে এই আত্মঘাতী বিস্মৃতির কারণে আমরাই যে পরিশেষে ক্ষতিগ্রস্ত হব, সে বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই। একটি প্রজন্মের সঙ্গে তৎপরবর্তী প্রজন্মের যোগসূত্রটি অনেকটা রিলে রেসের মতো। এক প্রজন্ম প্রাণপণ ছুটে চলার পর একসময় রেসের লাঠিটাকে পরের প্রজন্মের কাছে হস্তান্তর করে। স্যার আবেদের পক্ষে যতকাল সম্ভব ছিল তিনি ছুটেছেন, বিরামহীনভাবে ছুটেছেন। তাঁর সেই রেসের লাঠিটা এখন আমাদের তরুণদের হাতে।
বলা আবশ্যক যে আমাদের এই বহুধাবিভক্ত সমাজে গুণবান মানুষের অভাব নেই; কিন্তু তাদের অনেকেরই গুণপনা সমাজে তেমন প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে না। এদিক থেকে স্যার আবেদ একটি উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। তিনি শুধু গুণী ছিলেন না, গুণগ্রাহীও ছিলেন। তিনি মানুষের গুণ এবং কর্মশক্তিকে একত্রিত করে একটি ইতিবাচক সৌন্দর্যের সৃষ্টি করতে পারতেন। এখানেই স্যার আবেদের কীর্তি এবং কৃতিত্ব, এখানেই তাঁর অনন্যতা।
স্যার আবেদের অসামান্য অর্জন, তাঁর নিঃস্বার্থ আত্মোৎসর্গ এবং তাঁর হৃদয়গ্রাহী আত্মোপলব্ধি, যা তিনি আমাদের জন্য রেখে গেছেন; এর কোনো কিছুই যেমন বিস্মৃত হওয়ার নয়, তেমনি এসব কেবল উদ্দেশ্যহীন স্মৃতিচারণার জন্যও নয়।
সন্দেহাতীতভাবে তাঁর জীবন এই জাতির অগ্রগামিতায় আমাদের তরুণদের জন্য অপরিহার্য এক পথনির্দেশনা। আমরা নৈরাশ্যবাদী নই, আমরা নেতিবাচকও নই; আমরা সর্বতোভাবে বিশ্বাস করি যে আমাদের ছেলেমেয়েরা তাদের তারুণ্যের বহ্নিশিখা নিয়ে অসামান্য গতিতে সামনে অগ্রসর হবে। আমরা বিশ্বাস করি, স্যার আবেদ কখনোই বিস্মৃত হবেন না; বরং আমাদের তরুণেরা এ জাতির আসন্ন ইতিহাসে শতসহস্র স্যার আবেদ রূপে নতুনভাবে অধিষ্ঠিত হবে।
ইমাম জাফর নূমানী জ্যেষ্ঠ প্রভাষক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়