শ্রদ্ধাঞ্জলি

বেগম রোকেয়াকে স্মরণ করি

বেগম রোকেয়া
বেগম রোকেয়া

১০০ বছর আগে বেগম রোকেয়া এমন দুনিয়ার এক স্বপ্ন দেখেছিলেন যার অনেক কিছুই আজ বাস্তব। রোকেয়া স্বপ্ন দেখেছিলেন, মমতা আর মানবিকতাভিত্তিক এক সমাজ যেখানে কোনো অপরাধ নেই, নেই কলুষতা। তার জন্য যে তিল তিল শ্রমে তাঁকে এগোতে হয়েছে তা হয়তো কিছুটা গল্পের মতোই শোনাবে আজকের কিশোরী-তরুণীদের কাছে।

বেগম রোকেয়ার ১৯০৫ সালের উপন্যাস সুলতানাজ ড্রিমে এমন এক নারীস্থানের কথা বলা হয়েছে যেখানে সবকিছুর নেতৃত্বে আছেন নারীরা। বিশেষ করে মেধাবী একদল নারী বিজ্ঞানীর কারণে রাজ্যটি হয়ে উঠেছে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর এক জগৎ। এই মহান বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন উড়ন্ত গাড়ি, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ও আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণের সকল কৌশল। সৌরশক্তি ব্যবহারে দক্ষতা ও স্বয়ংক্রিয় কৃষিব্যবস্থার কারণে এখানে মনুষ্যশ্রমের কোনো প্রয়োজন নেই।

১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর এক জমিদার বংশে জন্ম গ্রহণ করেন বেগম রোকেয়া। সেসময় মেয়েরা পড়াশোনায় ছিল অনেক পিছিয়ে। তবে বেগম রোকেয়ার বড় ভাই চাননি তাঁর বোন পিছিয়ে থাকুক। বাড়িতে ভাইয়ের কাছেই বোন রোকেয়ার লেখাপড়া শুরু।

বিয়ের পর উদারমনা স্বামী ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন কাছেই শুরু হয় তাঁর আসল লেখাপড়া। স্বামীর কাছ থেকে উর্দু ও ইংরেজিতেও খুব ভালো দক্ষতা অর্জন করলেন। তাঁর সাহিত্যচর্চার সূত্রপাতও স্বামীর অনুপ্রেরণায়। ১৯০২ সালে ‘পিপাসা’ নামে একটি বাংলা গদ্য রচনার মধ্য দিয়ে শুরু হয় তাঁর লেখক জীবন।

১৯০৯ সালের ১ অক্টোবর ভাগলপুরে বেগম রোকেয়া প্রতিষ্ঠা করেন ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’। একটা বেঞ্চ, পাঁচজন ছাত্রী। কিন্তু মুসলিম নারীদের পড়াশোনাকে রীতিমতো অবজ্ঞার চোখে দেখা হতো সেসময়কার সমাজে। তাই নিলেন বোরকা পরে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্রী সংগ্রহের উদ্যোগও। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হাল ছাড়তে বাধ্য হলেন। চলে এলেন কলকাতায়। তখন তাঁর বয়স ৩০ বছর।

কলকাতায় স্বজনহীন, পরিচিতহীন শহরে নতুন করে শুরু করলেন সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুলের কার্যক্রম। এবার অবস্থা একটু ভালো হলো। দুটো বেঞ্চ আর আটজন ছাত্রী। একজন নারী- কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি নেই, বাড়ির বাইরে কাজ করার অভিজ্ঞতা নেই, নতুন শহরে নেই কোনো চেনা পরিচিত মানুষ! এভাবেই তিনি এগিয়ে গেলেন।

সামাজিক প্রতিকূলতা ছাড়াও অর্থনৈতিক প্রতিকূলতার মুখেও তাকে পড়তে হয়। তাই ১৯১৬ সালে প্রতিষ্ঠা করলেন আনজুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম নামে ইসলামী নারী সমিতি। আজকের মহিলা সমিতি এরই রূপান্তর। এ সংগঠন করতে গিয়েও তাঁকে অনেক প্রতিকূলতা সইতে হয়েছে। কিন্তু সব ধরনের প্রতিকূলতার মুখেই তিনি ছিলেন অবিচল।

তিনি তাঁর সহকর্মীদের বলেছিলেন, ‘যদি সমাজের কাজ করিতে চাও, তবে গায়ের চামড়াকে এতখানি পুরু করিয়া লইতে হইবে যেন নিন্দা-গ্লানি উপেক্ষা অপমান কিছুতেই তাহাকে আঘাত করিতে না পারে। মাথার খুলিকে এমন মজবুত করিয়া লইতে হইবে যেন ঝড়ঝঞ্ঝা বজ্র বিদ্যুৎ সকলেই তাহাতে প্রতিহত হইয়া ফিরিয়া আসে।’

একজন মানুষের মৃত্যু কর্মময় মৃত্যু কীভাবে হতে পারে তার প্রমাণও হচ্ছেন বেগম রোকেয়া। মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত তিনি স্কুলে কাজ করেছেন। তাঁর অভ্যাস ছিল প্রতিদিন তিনি রাতের বেলায় লিখতেন। মৃত্যুর দিন রাতেও তাই করেছেন। আর সে অবস্থায়ই একসময় ঢলে পড়লেন মৃত্যুর কোলে টেবিলের ওপর মাথা রেখে। সকালবেলা কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে দরজা খুলে দেখা গেল যে তিনি আর ইহলোকে নাই। মনে রাখার বিষয় হলো তাঁর জন্ম ও মৃত্যু একই দিনে, ৯ ডিসেম্বর।

তার সবশেষ অসমাপ্ত লেখা ছিল নারীর অধিকার শিরোনামে। এ থেকেই বোঝা যায় যে, নারীদের উন্নতি ও অগ্রগতির জন্য নিয়ে কতটা ব্যাকুল ছিলেন তিনি। প্রতি বছরের মতো আজও নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে বেগম রোকেয়া দিবস পালিত হচ্ছে। নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া স্মরণীয় ও বরণীয় হোক যুগ-যুগান্তর।

মো. আনোয়ার হোসেন
শিক্ষার্থী, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় রংপুর