শ্রদ্ধাঞ্জলি

বাবার কাছে খোলাচিঠি: সব থেকেও তুমি নেই...

আনিসুল হক
আনিসুল হক

আব্বু,
দেখতে দেখতে তুমি চলে যাওয়ার আজ ছয় বছর হলো। কীভাবে যে সময় চলে যাচ্ছে, চিন্তা করতেই অবাক লাগে। শত ব্যস্ততা, কিছু কষ্ট, কিছু হাসি এবং অনেক বৈচিত্র্যের মধ্যে খুব তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছে জীবন। আমার বয়সও চল্লিশ হয়ে গেল। তোমার রেখে যাওয়া মানুষগুলোও ক্রমাগত আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছে। গত মাসেই চলে গেলেন আমাদের সহকর্মী মেজর (অব.) জাভেদ। তুমি মারা যাওয়ার পর তিনি আমাদের চারপাশ থেকে আগলে রেখেছিলেন। ছায়া হয়ে আমাদের সঙ্গেই ছিলেন। আজ তিনিও নেই, নিজেকে আরও একা লাগছে।

ব্যবসাপাতি নিয়ে মনে হচ্ছে কঠিন সময়ের আর শেষই হবে না। সব গুছিয়ে উঠতে না উঠতে আরও অনেক সমস্যা এসে জুড়ে বসে! দেশের অর্থনীতি অনেক কঠিন সময় পার করছে। জিনিসপত্রের দাম মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। টিকে থাকাটাই যেন বড় দায়।

এবারও গার্মেন্টসের ন্যূনতম মজুরি নিয়ে বেশ আন্দোলন হলো। ফ্যাক্টরি পোড়ানো হলো, শ্রমিকও মারা গেলেন। মনে পড়ে গেল ২০০৬ সালের কথা। ঢাকা ইপিজেডের সামনে অনেক শ্রমিক রাস্তায় আন্দোলন করছেন। তখন শিল্প পুলিশ ছিল না।শ্রমিকদের সামনে যেতে কেউ সাহস করতে পারছিলেন না। তুমি বললে, ‘আমি শ্রমিক সামলাব, সবার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলব।’ তুমি কারও কথা না শুনে কয়েকজনকে নিয়ে পুলিশের ভ্যানের পেছনে চড়ে সেখানে গেলে। ইপিজেডের গেটের সামনে হাজারো বিক্ষুব্ধ শ্রমিক তোমাদের ঘিরে রেখেছেন। তোমার সাহসের কোনো কমতি নেই। ধৈর্যসহকারে শ্রমিকদের সুন্দর করে বোঝালে। সমস্যার অবসান হলো। দেশে প্রথম ন্যূনতম মজুরি বোর্ড হলো। তুমি ছিলে এর প্রধান। সবাইকে নিয়ে বসে সেবার প্রথম ন্যূনতম মজুরি ৯০০ টাকা থেকে ১ হাজার ৬০০ টাকা হয়েছিল। গার্মেন্টস মালিক-শ্রমিক সবাই মিলেই একটা সুন্দর সমাধানে পৌঁছানো গিয়েছিল।

তোমার শহর তুমি যেভাবে রেখে গিয়েছিলে, জানি না ঠিক সেভাবেই আছে কি না? এ বছর ডেঙ্গুতে আমরা রেকর্ড করেছি। মানুষের ডেঙ্গু হওয়া আর মারা যাওয়ার রেকর্ড। মশার জ্বালায় কোথাও শান্তিমতো বসতে পারি না। মনে হয় দিনের বেলাতেও মশারির নিচে বসে থাকি। তোমার করা সেই সুন্দর ফুটপাতগুলোর বেশ কিছু জায়গা ভেঙে গেছে। এত দিন বলতে গেলে কোনো রক্ষণাবেক্ষণই করা হয়নি। শুনেছি, কিছুদিনের মধ্যে ঠিক করা হবে। সেদিন মিরপুরে গেলাম, তোমার করা সুন্দর রাস্তাগুলো এখন আর অত সুন্দর নেই। অনেকেই রাস্তার বুক ফেড়ে, কেটে বিভিন্ন লাইন টেনেছে, অনেক জায়গা ভেঙে গেছে। আশা করি, এগুলোও ঠিক করা হবে।

যানজট প্রতিদিন খালি বাড়ছেই, সড়কে কোনো শৃঙ্খলাই আসছে না। তোমার স্বপ্নের ৫০০০ নতুন ঝকঝকে ইলেকট্রিক বাসের একটাও রাস্তায় নামেনি। এত দিন আশা ছিল যে আর কিছু না হোক অন্তত তোমার এই স্বপ্নটি পূরণের উদ্যোগ নেওয়া হবে। এখন মনে হয়, আর হয়তো এটাও হবে না। গাবতলীতে নতুন ট্রাক আর বাস টার্মিনালের কাজও শুরু হয়নি। তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ডের সামনে তোমার নামের রাস্তাটা মোটামুটি আবার দখল হয়ে গেছে। তুমি চেয়েছিলে, হাতিরঝিলের মতো আরও তিনটি জলাধার ও সুন্দর পার্ক তৈরি হবে। সেই ‘জল নিসর্গ’-এর কাজও শুরু হয়নি।

বাবা আনিসুল হক ও ছেলে নাভিদুল হক

কারওয়ান বাজার এখনো আগের জায়গাতেই আছে, ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থাতে। তুমি যেভাবে ব্যবসায়ীদের বুঝিয়েছিলে, কিছুদিনের জন্য হলেও তাঁদের সরে যেতে হবে। এখন তাঁরা নাকি কিছুই বুঝতে রাজি নন। তোমার করা পদচারী–সেতুগুলোতে নতুন বাতি লেগেছে। শহরেও নতুন এলইডি বাতি জ্বলছে। নতুন করে ঢাকা উত্তরের সঙ্গে যোগ হওয়া এলাকাগুলো গুলশান-বনানীর মতো সাজাতে চেয়েছিলে। পুরো পরিকল্পনাও করে দিয়ে গিয়েছিলে। শুনেছি, কাজ শুরু হয়েছে, কিন্তু কবে শেষ হবে এটা কেউ জানে না।

তোমার করা পার্কগুলো দেখলে মন ভরে যায়। প্রতিদিন হাজারো মানুষ পার্কগুলো ব্যবহার করছেন। পার্কগুলোতে কোথাও তোমার নাম নেই, কিন্তু শহরের প্রতিটি মানুষ জানেন তাঁদের জন্য এগুলো তোমার করা। তুমি গেঁথে আছ সাধারণ মানুষের মনের ভেতরে, আছ প্রতিদিন এসব মানুষের কথায়, তাঁদের প্রার্থনায়। এর চেয়ে বেশি একটা মানুষের জীবনে আর কীই–বা পাওয়ার থাকতে পারে।

আর আমরা তোমার পরিবার অনেক ভালো আছি। সবাই সুস্থ আছি। আজ আমেরিকার নিউইয়র্কে চাচ্চুরা, চাচিরা, ফুপা-ফুপি আর মা—সবাই একসঙ্গে হবে নাইমার (আমার চাচাতো বোন) নতুন বাড়িতে। চাচাতো–ফুফাতো ভাইরাও সবাই থাকবে, সবাই চুটিয়ে আড্ডা মারবে। প্রতিবারের মতো তোমার কথা হবে সবচেয়ে বেশি।

এদিকে তোমার নাতিরা বড় হয়ে যাচ্ছে। ওরা এত কথা বলে, এই পাঁচ–ছয় বছর বয়সে, প্রাপ্তবয়স্কদের মতো। ইহান তো অনর্গল ইংরেজি বলছে। আমি ঠিকমতো ইংরেজি বলতে পারতাম না বলে তুমি আমাকে কতই না বকাঝকা করতে। এখন চিন্তা করি, তুমি কতই না মজা পেতে ওদের সঙ্গে কথা বলতে। তোমার আড্ডা মারার নতুন দুজন মানুষ পেতে, আমাদের পরিবারের আড্ডা আরও বড় হতো।

তোমার নাতনিরাও বড় হয়ে যাচ্ছে। ওরাও নতুন নতুন কথা কম বলছে না। মা যে কত আনন্দ পাচ্ছে নাতি-নাতনিদের নিয়ে। কিন্তু একটু পরপরই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘তোর বাপ কিছুই দেখে যেতে পারল না।’ আমি জানি, সব তুমি দেখছ, আমাদের হাসি, কান্না, সুখ, বেদনার ভেতরেই তুমি আছ। কিন্তু সবচেয়ে বড় কষ্ট হচ্ছে, সব থেকেও তুমি নেই...।

  • নাভিদুল হক ব্যবস্থাপনা পরিচালক, মোহাম্মদী গ্রুপ, পরিচালক, বিজিএমইএ