সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন: মাকে নিয়ে যত স্মৃতি

সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন
সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন


বিশ্ব মানচিত্র, হাজার বছর আগের বিলুপ্ত কত সভ্যতার কথা, আকাশের তারা, গ্রহ, নক্ষত্র, নীহারিকা, ছায়াপথ, আমাদের সবচেয়ে কাছের গ্যালাক্সির নাম অ্যান্ড্রোমিডা, যার দূরত্ব প্রায় ২৫ লাখ আলোকবর্ষ। পিরামিডের কথা। মিসর, ব্যাবিলন এমন কত দেশ-শহরের নাম। দক্ষিণ আমেরিকার পেরুর গুহায় পাওয়া অজানা সভ্যতার কথা। স্রষ্টার বিশালত্ব। মানবতার সাধনায় স্রষ্টার অস্তিত্ব অনুভব করা সম্ভব। এই পৃথিবীতে আমাদের আগমন তখনই অর্থপূর্ণ হয়, যখন আমরা পবিত্র অন্তরে মানব প্রেমে ব্রতী হই। গড় গড় করে বলে চলতেন বিজ্ঞানের আবিষ্কারের কাহিনি। বই যখন পড়তেন, মনে হতো মণিমুক্তা গাঁথছেন। ছড়িয়ে দেবেন আরও অনেকের মধ্যে। বাচিকশিল্পীর মতো মনের বাঁধন খুলে একের পর এক কবিতার ছন্দ তুলতেন। রেডিও অথবা রেকর্ড প্লেয়ারে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময় বাজত একের পর এক গান। যতন করে রাখা থাকত প্রিয় একটা গিটার। গিটারের তারে আঙুলের স্পর্শে যখন সুরের মূর্ছনা ছড়িয়ে পড়ত, মুখটাকে দেখে মনে হতো দীপ্তিময় আলো। জাদুকরের মতো ৫/৬টি কমলালেবু অথবা একই মাপের বল নিয়ে দুই হাতের নিপুণ চর্চায় ছুড়তে থাকতেন ওপরের দিকে। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতাম। প্রাণোচ্ছল একজন মানুষ। অন্য কারও বেদনাকে নিজের বেদনা ভেবে পরিত্রাণের চেষ্টা ছিল সর্বদা। নিজের আনন্দ ভাগ করে নিতেন অন্যের সঙ্গে সব সময়। পৃথিবী ছেড়ে একদিন চলে যেতে হবে, কী এক অপার আনন্দ ছিল সেই ভাবনায়। মৃত্যু যখন শিয়রে, জানেন তিনি গান গাইতে বলেন ‘ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু’, গান গাইতে গাইতে বলেন,‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।/ তবু শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে...’।

সময় কি দ্রুত চলে যায়। তিনি আমাদের ছেড়ে স্রষ্টার অনন্তলোকে ফিরে গেছেন সাত বছর আজ। আমি বলছি আমাদের আম্মা সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনের কথা। তিনি বই যেমন পড়তেন, টুকিটাকি লিখতেনও বেশ। মুক্তিযুদ্ধ, আমাদের সংগ্রাম, স্বাধীনতা—এসব নিয়ে একান্ত নিজস্ব অনুভূতি লিখতে শুরু করেছিলেন ১৯৭২ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে। নাম দিয়েছিলেন ‘উদয়ের পথে’। বছর দুই তাঁর কলম আর থামেনি। সময় পেলেই লিখতেন। পত্রিকায় ছাপাও হতো। তারপর লেখা বন্ধ করতে অনেকটাই বাধ্য হলেন (কেন, সে আরেক কাহিনি)। আব্বু (তাজউদ্দীন আহমদ) আম্মাকে বললেন, ‘তালাচাবি বন্ধ করে তোমার লেখা তুলে রাখো। বাংলাদেশের ৫০ বছর হলে তখন বই ছেপো।’ এরপর জীবনের কত রকম মোড় পরিবর্তন। ‘উদয়ের পথে’ থমকে রইল। কিন্তু প্রতিদিন না হলেও বিচ্ছিন্নভাবে কিছু না কিছু লিখে রাখতেন। আমি তাঁর সেই লেখার নাম দিয়েছিলাম ‘অধরা খাতা’।
১৯৭৫-এর আগস্ট এবং নভেম্বর আমাদের জীবনের সবকিছু ওলটপালট করে দেয়। নাবালক ৩ মেয়ে আর ১ ছেলেকে নিয়ে দেশের ভেতরেই শরণার্থীদের মতো অসহায়ভাবে এক-একটি দিন পার করা। সেই কঠিন সময়ে কিছু আত্মীয়স্বজন ছাড়া হাতে গোনা যাঁরা পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, আম্মা তাঁদের গভীর কৃতজ্ঞতায় স্মরণ করতেন। বিশেষভাবে আজ আমার মনে পড়ছে ব্যারিস্টার শওকত আলী খান এবং তাঁর স্ত্রী দানবীর আর পি সাহার কন্যা বিজয়া শওকতের কথা। আরও মনে পড়ে বেগম সুফিয়া কামাল ও মালেকা খালার কথা। আরও অনেকের নাম-চেহারা চোখে ভাসে। (আমার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কৃতজ্ঞতায় স্মরণে থাকবেন তাঁরা সবাই।)

আমি ’৭৫ সালে ক্লাস নাইনে পড়ি। ১৫ আগস্টের পর থেকে লেখাপড়া বিচ্ছিন্নপ্রায়। আব্বুকে কবর দেওয়া হলো ৫ নভেম্বর, বুধবার ১৯৭৫। আমার ফাইনাল পরীক্ষা ১৭ নভেম্বর থেকে। আমি কোথায়, আমরা কোথায়, বই-খাতা-কলম আমার সব বিচ্ছিন্ন। আম্মা শান্ত কণ্ঠে বললেন, যা পারি, যতটুকু পারি, পরীক্ষা দিতে। মধুবাগ, মগবাজারে আমার প্রিয় মানুষ আনার আপা এবং সাঈদ ভাইয়ের বাসায় থেকে পরীক্ষা দিলাম। কারণ, সেখান থেকে ভিকারুননিসা স্কুল কাছে ছিল। আম্মাকে সে সময় মনে হয়েছিল মা মুরগির মতো। নিজের ছোট ছোট ছানাদের মা মুরগি যেভাবে আগলে রাখে, আম্মাও তেমনি আমাদের ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে দিচ্ছেন। সেই সময় আমার স্কুলের প্রধান শিক্ষক, অন্য সব শিক্ষক, এমনকি আর্ট স্যার আমাকে যেভাবে মানসিক শক্তি জুগিয়েছিলেন, তা ভাষায় প্রকাশ করার সাধ্য আমার নেই।
আম্মার একটি উচ্চারণ সেই সময় প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছে আমার অন্তর-আত্মাকে। আম্মা জীবনের অনাকাঙ্ক্ষিত কিন্তু কঠিন সত্যের মুখোমুখি হয়েও নিজেকে ভেঙে পড়তে দেননি। নিজেকে যেমন সান্ত্বনা দিতেন, তেমনি আমাদেরও বলতেন, ‘আমি স্বামী হারিয়েছি। তোমরা তোমাদের আব্বুকে হারিয়েছ। কিন্তু ভেবে দেখো, দেশ কী হারাল। মাত্র ৫০ বছরের জীবনে তিনি যা দিয়েছেন তা সীমাহীন। কিন্তু আরও তো কত কিছু দেবার ছিল দেশকে! দেখো না, আমার কান্না থেমে গেছে। আমার অন্তর ভিজে থাক আমার চোখের পানিতে। তাজউদ্দীনের রেখে যাওয়া কর্ম থেকে মানুষ যদি দেশকে ভালোবাসতে শেখে, সেখানেই আমাদের পাওয়া।’

আম্মার অগাধ বিশ্বাস ছিল সৃষ্টিকর্তার প্রতি। কিন্তু লোকদেখানো কোনো বাড়াবাড়ি ছিল না তাঁর। ধর্মীয় সব বিষয় পালন করতেন একান্তে। আমাদের বাসায় অদ্ভুত একটা ব্যাপার ছিল, কোনো সময় পরনিন্দা, পরচর্চা করতেন না আম্মা। আম্মা এমনভাবে মানুষের গুণের কথা বলতেন যে মাঝেমধ্যে বিরক্তই হয়ে যেতাম। আমরা কিছু বলতে চাইলে আম্মা শুধু বলতেন, ‘ইগনোর করো। অন্যের যেটা খারাপ, সেটা তারই থাকবে। কেন নিজের সময় নষ্ট করতে হবে সেসব নিয়ে। তবে বৃহত্তর মানুষের ক্ষতি হয়, এমন কিছুতে সত্যি কথা বলতেই হবে। সেখানে আপস নয়।’ পরবর্তী জীবনে নানা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আমি আম্মাকে বলতাম, আম্মা আপনি ভীষণ ভুল করেছেন, ক্ষমা করো, ইগনোর করো— এই কথা বলে বলে। এই কথা বোঝার শক্তি তো বেশির ভাগ মানুষের নেই। দুষ্ট মানুষ তো ক্ষমা করাকে দুর্বলতা ভাবে। আম্মা বলতেন, ‘ধৈর্য ধরো। এর ফল নিশ্চয় পাবে। নিজের মনের শান্তির ওপরে আর তো কিছু নেই। কষ্ট পেলে চুপচাপ চোখ বন্ধ করে গভীরভাবে শ্বাস নাও, আল্লাহ শক্তি জোগাবে।’
২০০৩ সালের জুলাই মাসে স্ট্রোকে আক্রান্ত হলেন আম্মা। ডাক্তার দ্বীন মোহাম্মদ সাহেবের তত্ত্বাবধানে ধীরে ধীরে তিনি সেরে উঠতে থাকলেন। মুখের জড়ানো কথা স্পষ্ট হতে সময় লাগল বেশ। প্রতিদিন বই থেকে পড়ে শোনানো ছিল আমাদের কাজ। আমার মনে আছে, প্রায় সাত মাস পর যেদিন তিনি কলম ধরতে পারলেন, সে কী আনন্দ! কাঁপা কাঁপা অক্ষরে লিখলেন, ‘আমি লিখতে পারছি।’ হাতের লেখায় সন্তুষ্ট হতে পারেন না। চেষ্টা চলতে থাকে। মনোবল বাড়াতে আমি সেই ‘উদয়ের পথের’ বাকি অংশ লিখতে চেষ্টা করতে বলি। ভীষণ খুশি হয়ে যান শুনে। খাতা এনে দিই। কয়েক লাইন লিখে ক্লান্ত হয়ে পড়েন। চিন্তা এবং সেই চিন্তাকে অক্ষরে রূপ দিতে বেশ কষ্ট বোধ করতেন। তখন আমি শুরু করলাম টেপ রেকর্ডারে তাঁর কথাগুলো তুলে রাখতে। এর কিছুদিন পর আবার লিখতে শুরু করলেন। আবার থামলেন। দেশের অবস্থা যখন ক্রমেই তাঁর কল্পনার বাংলাদেশ থেকে দূরের মনে হতে থাকে, তখন অপার বেদনা তাঁর শারীরিক কষ্টকে ছাপিয়ে মনকে করতে থাকে ভারাক্রান্ত। প্রায় সময়ই অসুস্থ হয়ে পড়তেন। আর তাঁকে নিয়ে ছুটতাম ডাক্তার আর হাসপাতালে। যে মানুষটি পুরো জীবন তাঁর সব বেদনাকে ছোট ছোট আনন্দের আবরণে ঢেকে রাখতেন, তিনি পাগলপ্রায় হয়ে ওঠেন দেশ দেশ করে।

১৯৭৫-এর আগস্ট এবং নভেম্বরের নিষ্ঠুর ঘটনার মধ্য দিয়ে দেশে অবৈধ সামরিক শাসন কায়েম, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা হয়। আওয়ামী লীগের বহু নেতা-কর্মী কারাগারে অথবা দেশের বাইরে পলাতক এবং অনেক অংশই নিষ্ক্রিয়। আম্মা বসে থাকার মানুষ নন। ’৬০-এর দশকে ছয় দফা আন্দোলনের সময় বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দীন আহমদসহ বহু নেতা-কর্মী যখন কারাগারে বন্দী, জোহরা তাজউদ্দীন তখন আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে নিয়মিত রাজপথে। ১৯৬৮ সালে গঠিত রাজবন্দী সাহায্য কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন তিনি। টিয়ার গ্যাসের সঙ্গে আমার পরিচয় মাত্র ছয় বছর বয়সে, আম্মার মাধ্যমে। অতন্দ্র প্রহরীর মতো কর্তব্য পালনে ছিলেন দ্বিধাহীন। তিনি যোগাযোগ শুরু করেন দলীয় লোকজনের সঙ্গে। তাগিদ দিতেন তাঁদের কিছু করতেই হবে। দেশের চরম দুর্দিনে তাঁর ওপর দায়িত্ব এসে পড়ে আওয়ামী লীগের হাল ধরার। ১৯৭৭ সালে দলের আহ্বায়িকা নির্বাচিত হয়ে দেশের এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে দলকে সুসংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ করেন। সামরিক শাসনের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে তিনি সপরিবার বঙ্গবন্ধুকে হত্যার প্রতিবাদে গর্জে ওঠেন। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে তিনি অনন্য ভূমিকা পালন করেন। তাঁর রাজনৈতিক পরিপক্বতা, স্বচ্ছ চিন্তা এবং জ্ঞানের পরিধি রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে সুস্থ গণতান্ত্রিক ধারা বিকাশ প্রচেষ্টায় বিপুল জনগোষ্ঠীকে উজ্জীবিত করেছিল অতি সহজেই। সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন আমৃত্যু বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন। তিনি মহিলা পরিষদের সহসভানেত্রী ছিলেন। তিনি আফ্রো-এশিয়া গণসংহতি পরিষদের সহসভানেত্রী ছিলেন। এই পরিষদের বিভিন্ন সভা এবং সেমিনারে অংশ নিতে তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যান। অতি সহজেই তিনি মানুষের সঙ্গে মিশে যেতে পারতেন। আর্থিকভাবে অসচ্ছল, রোগাক্রান্ত মানুষের চিকিৎসাসেবায় তিনি ছিলেন নিবেদিত একজন মানুষ। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন লালন করেছেন আমৃত্যু।
আম্মার সেই ‘অধরা খাতায়’ ছোট ছোট খণ্ড লেখার একটি পাতায় লিখে রেখেছিলেন তাঁর ভালো লাগা কয়েকটি লাইন, যা এক অর্থে দেশের জন্য তাঁর প্রার্থনা।
প্রভু আমাদের মানুষ দাও
এ সময় দাবি করে
শক্তিশালী মন, মহান হৃদয়
সত্যিকার বিশ্বাস এবং প্রকৃত হাত।
সেই সব মানুষ দাও যাদের
হত্যা করতে পারবে না গভীর লোভ
সেই সব মানুষ দাও যাদের সম্মানবোধ আছে
সেই সব মানুষ দাও যারা মিথ্যা বলবে না
ন্যায়বিচারÑদেশকে শাসন করুক এবং
সৎসাহস আমাদের প্রয়োজন পূরণ করুক।
গিলবার্ট হল্যান্ড

সিমিন হোসেন রিমি জাতীয় সংসদের সদস্য, লেখক ও সমাজকর্মী।