সমাজসংস্কার ও বাঙালির বিশ্বায়নে ভক্তিবেদান্ত স্বামী

ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ
ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ

যুগে যুগে বাংলায় সমাজসংস্কার ও সংস্কৃতি সুরক্ষায় প্রথিতযশা ব্যক্তিগণ বিভিন্নভাবে অবদান রেখেছেন। কুসংস্কার ও অপসংস্কৃতির করাল গ্রাস থেকে মুক্ত করে যাঁরা জরাজীর্ণ সমাজব্যবস্থায় নবযৌবন দান করেছেন, তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই সাহিত্যিক ও সমাজসংস্কারক। আধ্যাত্মিক প্রচারক হিসেবে যাঁরা সমগ্র বিশ্বে সমাজসংস্কার ও বাঙালি সংস্কৃতির প্রচার করেছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন কৃষ্ণকৃপাশ্রীমূর্তি শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ। যে পাশ্চাত্যবাসীর সংস্কৃতি সমগ্র বিশ্ববাসী অনুকরণ করে, তাঁদের তিনি বাঙালি সংস্কৃতি ও আদর্শের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে জীবনধারা পরিবর্তনে উদ্বুদ্ধ করেছেন।

১৯৬৫ সালে ৭০ বছর বয়সে পাশ্চাত্যবাসীর মধ্যে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা প্রচারের লক্ষ্যে আমেরিকায় পাড়ি জমান ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী আমেরিকায় তখন হিপ্পি আন্দোলন শুরু হয়েছে। এলএসডির নেশায় দিশাহীন যুবক-যুবতীরা যথেচ্ছাচারে রত।

সে সময় স্বামী প্রভুপাদ নিউইয়র্কের টমকিনস স্কয়ার পার্কে প্রথম প্রচারকার্য শুরু করেন। সেখানকার লক্ষ্যভ্রষ্ট যুবক-যুবতীরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাঁর অমৃতময় কথা শ্রবণ করতে থাকেন। ধীরে ধীরে তাঁরা তাঁদের বদভ্যাসগুলো থেকে সরে আসতে শুরু করে। স্বামী প্রভুপাদ তাঁদের নিয়ে সাপ্তাহিক অধিবেশন শুরু করেন। ধীরে ধীরে আমেরিকানরা বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকেন। বাংলা সাহিত্যের অনন্য গ্রন্থ শ্রীল কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী বিরচিত ‘শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত’র ইংরেজি ভাষা রচনার মাধ্যমে তিনি পাশ্চাত্যবাসীদের বাংলা ভাষা শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করেন। তাঁর অনুপ্রেরণায় আজ পৃথিবীজুড়ে বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষ বাংলা ভাষা শিখতে প্রয়াসী হচ্ছেন। শ্রীল প্রভুপাদের অনবদ্য অবদান তাঁর গ্রন্থাবলি। তিনি ৭০টির বেশি গ্রন্থ রচনা করেন।

বর্তমান বিশ্ব আধুনিক প্রযুক্তির উৎকর্ষের ক্ষতিকর প্রভাব ইতিমধ্যে উপলব্ধি করছে। সে জন্যই টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রায় পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সুরক্ষাকে এতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ১৯৬৬ সাল থেকেই শ্রীল প্রভুপাদ তাঁর বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতার দ্বারা আধুনিক সভ্যতার ক্ষতিকর প্রভাব বুঝতে পেরেছিলেন। সে জন্য তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার সুবিস্তৃত ভূমিতে ইকোভিলেজ প্রতিষ্ঠা করেন, যা তিনি বিশ্ববাসীকে একটি মডেল হিসেবে দেখিয়েছেন।

২০১৭ সালে জাতিসংঘের অঙ্গসংস্থা ইউএনডব্লিউটিও কর্তৃক ইসকনের ইকোভিলেজ প্রকল্পকে বিশেষ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। দরিদ্র ও নিপীড়িত মানুষের জন্য শ্রী প্রভুপাদ নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তার মধ্যে বিনা মূল্যে খাদ্য বিতরণ ও চিকিৎসা প্রদান কর্মসূচি অন্যতম।

শ্রীচৈতন্যদেবের অহিংস নীতি ও সাম্রাজ্যবাদের আদর্শে প্রতিষ্ঠিত তাঁর সংস্থায় শ্বেতাঙ্গ, ধনী-দরিদ্র, নারী-পুরুষনির্বিশেষে সবাই যুক্ত হতে পারেন। তিনি বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দার্শনিক, বিজ্ঞানী ও বরেণ্য ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে বৈদিক দর্শন ও সংস্কৃতি প্রসঙ্গে মতবিনিময় করেন। তৎকালীন জনপ্রিয় ব্যান্ড বিটলসের স্বনামধন্য তারকা জর্জ হ্যারিসন, বিখ্যাত ফোর্ড কোম্পানির উত্তরাধিকারী আলফ্রেড ফোর্ডসহ বহু বরেণ্য ব্যক্তি তাঁর আদর্শের অনুসারী হন।

শ্রীল প্রভুপাদের প্রতি কৃতজ্ঞতাবশত জর্জ হ্যারিসন যুক্তরাজ্যের লন্ডনে অবস্থিত নিজের বাড়িটি আধ্যাত্মিক অনুশীলনের জন্য দান করেন। প্রভুপাদের নামানুসারে এর নামকরণ করা হয় ভক্তিবেদান্ত মেনর। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সাহায্যার্থে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাডিসন গার্ডেন স্কয়ারে আয়োজিত কনসার্ট ফর বাংলাদেশে জর্জ হ্যারিসনের অংশগ্রহণেও শ্রীল প্রভুপাদের অনুপ্রেরণা ছিল।

১৮৯৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন শ্রীল ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ। ছাত্রাবস্থায় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত এই মহান ব্যক্তি পরবর্তীকালে বিশ্বব্যাপী বাঙালি সংস্কৃতি প্রসারে অন্যতম পথিকৃৎ হিসেবে খ্যাত হন। শ্রীল প্রভুপাদের ১২৫তম জন্মবার্ষিকের এ শুভলগ্নে তাঁর প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা।

অক্ষয় লীলামাধব দাস লেখক ও গবেষক