ঢাকাসহ পুরো বাংলাদেশকে সবুজে, শ্যামলে, সৌন্দর্যে, জীববৈচিত্র্যে ভরিয়ে তোলার স্বপ্ন দেখতেন প্রকৃতিবিদ ও লেখক দ্বিজেন শর্মা। কীভাবে এই স্বপ্ন পূরণ হতে পারে, সে সম্পর্কে তিনি অনেক কথা লিখে গেছেন তাঁর বই, প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও পত্রপত্রিকার কলামে (এসব বিষয়ে তাঁর দুটি বিখ্যাত বই শ্যামলী নিসর্গ ও কুরচি তোমার লাগি)।
এসব বিষয়ে অনেক খুঁটিনাটি প্রায়োগিক কথাবার্তা পাওয়া যায় তাঁর লেখায়। আমাদের প্রিয় রাজধানী ঢাকায় এবং সারা দেশের শহরগুলোতে কোন জায়গায় কোন প্রজাতির গাছ লাগানো উচিত, কোথায় কোন প্রজাতির গাছ লাগানো উচিত নয়, এসব বিষয়েও তিনি অনেক কথা বলে গেছেন।
কিন্তু আমরা তাঁর মূল্যবান পরামর্শগুলো গ্রাহ্য করিনি। বলা যায়, তাই ঢাকা আজ ধূসর এবং এই ধূসরতা ছড়িয়ে পড়ছে ঢাকা শহর ছাড়িয়ে অন্যান্য শহরে।
দ্বিজেন শর্মা স্বপ্নের শ্যামলী নিসর্গ বাস্তবে রূপায়ণে বরাবরই আশাবাদী ছিলেন। আমরা যদি এখনো তাঁর পরামর্শ ও দিকনির্দেশনাগুলো বাস্তবায়নে মনোযোগী হই, তবে আমাদের শহর শ্যামলে, সৌন্দর্যে, জীববৈচিত্র্যে ভরপুর হতে পারে। আজ তাঁর ৯২তম জন্মদিনে আমরা তাঁকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সঙ্গে স্মরণ করার পাশাপাশি আবার একটু খুঁজে দেখতে চাই তাঁর সেই অমৃত-ভান্ডারের খানিকটা অংশ, প্রধানত তাঁর নিজের বর্ণনায়।
দ্বিজেন শর্মা বলেছেন, চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে শহর-নগর-বন্দরের প্রসার, নতুন রাস্তা, কারখানা, ব্রিজ, স্টেশন, বাড়িঘরের ক্রমাগত বৃদ্ধির ফলে আমাদের স্বাভাবিক নিসর্গ পরিবর্তনের মুখোমুখি হচ্ছে। কৃষিজমি, জলাশয় ইত্যাদির ব্যবহার বদল হচ্ছে।
ঢাকাসহ আমাদের অন্য শহরগুলোতেও একক বাড়ির জায়গা দখল করে নিচ্ছে বহুতল ভবন। পরিবেশ চেতনা বাড়লেও গাছগাছড়া লাগানোর স্থানাভাব প্রকট। ফ্ল্যাটবাড়ির বারান্দা বা ছাদে টবে-লাগানো ফুলের বাগান হচ্ছে, কিন্তু তাতে উদ্যানের চাহিদা মিটবে না। আমাদের পার্ক, উন্মুক্ত স্থান, রাজপথগুলোকে সুরম্য উদ্যানে রূপান্তর করে সর্বজনীন সৌন্দর্য-ক্ষুধা মেটাতে হবে।
প্রকৃতির আপন বিন্যাসে আজকের মন আর তুষ্ট নয়। আপন মনের মাধুরীতে তাকে ঢেলে সাজানো কালের অনমনীয় দাবি। ব্যক্তিজীবন কিংবা সমাজ-কল্পনায় অর্থনৈতিক লাভ ও সচ্ছলতা একক লক্ষ্য হয়ে উঠলে তা প্রাচুর্য আনলেও স্বস্তি হারিয়ে যাবে। মনে রাখা উচিত, দেশের নিসর্গ রচনায় একে সুন্দরতর, উপভোগ্যতর করার প্রয়াস অপব্যয় কিংবা বিলাস নয়, প্রয়োজন। সুষম মানস-গঠন, শিক্ষা ও সৃজনশীলতার জন্য তা অপরিহার্য।
আমাদের দেশ জীবনন্দনতত্ত্বের অজস্র আকর্ষী উপাদানে সমৃদ্ধ। শাল-দেবদারুর রাজসিক সৌন্দর্য, সেগুন-তেঁতুল-তালের বলিষ্ঠ গ্রথন, বিলাতি ঝাউয়ের মর্মর, নাগকেশর-ছাতিমের উদ্ভ্রান্ত সুগন্ধি, কুর্চি-শজনের শুভ্রতা, কৃষ্ণচূড়া, পলাশ, শিমুলের উচ্ছ্বল বর্ণচ্ছটা, পদ্ম-শাপলার ললিত লাবণ্য, কাশমঞ্জরির অবারিত উচ্ছ্বাস, বটের নিশ্ছিদ্র ছায়া আমাদের নিসর্গ শিল্পীর প্রিয় রং ও রেখা, আকার ও অলংকার।
বাঙালি একান্ত আপন শেফালি, ছাতিম, কুর্চি, কামিনী, পলাশ, বিলাতি ঝাউ, কনকচাঁপা, মুচকুন্দ, স্বর্ণচাঁপা, হিজল, গামারি, কাঞ্চন, অশোক, মহুয়া, কাঞ্চি, শিশু, আমলকী, তমাল ইত্যাদি শহরের উপযুক্ত স্থানে লাগানো জরুরি।
তেলশুর, পাদাউক, বুদ্ধ নারকেল, কুসুম, বট, অশ্বত্থ, তেঁতুল, কনকচূড়া, জারুল, সোনালু, দেবদারু ইত্যাদির সঙ্গে আমাদের অন্যতম রূপসী তরু নাগেশ্বর, শাল, বকুল, শিরীষের স্থান হওয়া দরকার। তা ছাড়া আমাদের পাহাড়ে জঙ্গলে আছে দুলিচাঁপা, রামডালু, পুন্নাগ, গুলাল, উদাল, নাগকেশর, পালাম; যেগুলো বাগানে লাগানো শুধু সৌন্দর্য ও বৈশিষ্ট্যের জন্যই নয়, ওদের বিলুপ্তি ঠেকানোর জন্যও আবশ্যক। আমাদের শহরের বাগানে এখনো ট্যাবেবুইয়া, লিগনাম ভিটি, গুল্গুল, ক্লুভিল নেই; এগুলো লাগানো আবশ্যক।
বহুমুখী বিবেচনা ছাড়া শহরে বৃক্ষরোপণে সাফল্য অসম্ভব। গাছপালার আকার, আয়তন, বর্ণ ও প্রস্ফুটনের সঙ্গে শহরের বিভিন্ন এলাকার বৈশিষ্ট্য এবং শহরবাসীর রুচি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যচেতনা অবশ্যই বিবেচ্য। ঢাকার বৃক্ষরোপণে প্রাউডলক পরিকল্পনা উল্লেখ্য, গাছের প্রজাতি নির্বাচন ও সেগুলোর বিন্যাসে তার পদ্ধতি আমাদের ভবিষ্যৎ কার্যক্রমের ভিত্তি।
পথ শহরের ফুসফুস, লাখ লাখ মানুষের স্বাস্থ্যের সঙ্গে এর সম্পর্ক নিবিড়। বাড়িঘর-যানবাহন আকীর্ণ এই কৃত্রিম সমাবেশের মাঝখানে ছায়াঘন প্রশান্ত রাস্তা কর্মক্লান্ত মানুষের কাছে স্বস্তির আশ্বাস। তাই এতে অর্থব্যয়ে সংকোচ নিষ্প্রয়োজন; বরং পথই একমাত্র স্থান, যার আয়েশ ও সৌন্দর্য শহরের সর্বাধিকসংখ্যক মানুষকে স্পর্শ করে। শহরের জনকল্যাণমূলক কাজের মধ্যে ছায়াঘন পথের প্রথম স্থান অবশ্যপ্রাপ্য। অথচ আমাদের শহর পথ সংকীর্ণ, বৃক্ষহীন। ফুটপাত হতাশাব্যঞ্জক এবং পথের পাশে ঘাসবিছানো জায়গা অনুপস্থিত।
পথের দুপাশে অর্থকরী ফলের গাছ কিংবা বিদেশি গাছ না লাগানোই ভালো। বিদেশি গাছ স্থানীয় নিসর্গের সঙ্গে সু-অভিযোজিত হয় না এবং ক্ষেত্রবিশেষে দুর্বল ও রোগগ্রস্ত হয়ে পড়ে। আমাদের পুরোনো রাস্তার বৃক্ষরোপণে যে শিল্পরুচি ও বিবেচনা ছিল, ইদানীং তার অভাব চোখে পড়ে।
শহরে ফুলের গাছের মাঝে কৃষ্ণচূড়া লাগানোর আধিপত্য লক্ষণীয়। গাছটি সুন্দর বটে, তবে সে জন্য বিস্তৃত সবুজ পটভূমি চাই, অন্যথা অনেক ক্ষেত্রেই সে বেমানান। কৃষ্ণচূড়ার কাণ্ড ও শাখা-প্রশাখা তেমন শক্ত নয়। ঝড়ে এই গাছ সহজেই ভেঙে পড়ে। পথপাশের জন্য এই গাছ উপযুক্ত নয়। বিস্তৃত অঙ্গন, বাড়ির সীমানা, লেকের পাড়ে লাগানো যেতে পারে।
শহরে মেহগনি ও আকাশমণি রোপণ এখনই বন্ধ করা জরুরি এবং ছোট গাছগুলো তুলে ফেলা আবশ্যক। সড়ক-বিভাজিকা বা আইল্যান্ডে ঝুল দেবদারুর বদলে দেশি দেবদারু অধিক নির্ভরযোগ্য। তা ছাড়া তাল, খেজুর, চীনা পাম লাগানো যেতে পারে। বেশি জায়গা ও আশপাশ মুক্ত থাকলে তেমন আইল্যান্ডে বট-অশ্বত্থ লাগানো যায়।
‘নগর-বৃক্ষের দেখভাল’ প্রবন্ধে দ্বিজেন শর্মা লিখেছেন, ‘মতিঝিলের বর্তমান শাপলা চত্বরে এই ভাস্কর্যটি নির্মাণের আগে সেখানে একটি বটগাছ লাগানোর কথাও লিখেছিলাম যাতে চারিদিকের সুউচ্চ কৃত্রিম কাঠামোর মাঝখানে একটি বিশাল সবুজ ক্যানোপি গড়ে ওঠে এবং ওই ভবনগুলো সবুজের মধ্যে কিছুটা হলেও প্রাণের স্পর্শ পায়।’
শহরে বৃক্ষরোপণে পাখিদের খাদ্য ও বাসস্থানের সংকুলানের ব্যাপারটিও বিবেচনায় নেওয়া জরুরি। পাখির জন্য শহরে শিমুল, পলাশ, মান্দার, বট-পাকুড়, বুনোজাম ইত্যাদি লাগানো প্রয়োজন।
দ্বিজেন শর্মার দিকনির্দেশনাসমূহ অনুসরণ করলে তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হবে। ঢাকা শহর সবুজে, সৌন্দর্যে, বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ হবে।
তুগলক আজাদ স্থপতি
shamannayarchitects@gmail.com