ধ্রুবতারার প্রস্থান: নুরুল হোসেইন খান

নুরুল হোসেইন খান
নুরুল হোসেইন খান

অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন শেষে চৌধুরী এ কে এম আমিনুল হক অবসরে গেলে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন নুরুল হোসেইন খান। তখনকার দিনে আজকালের মতো ঘটা করে ফুলের তোড়া, ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে বরণ করার আতিশয্য না থাকলেও নতুন চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করে সালাম দেওয়ার রেওয়াজ ছিল, বিশেষ করে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের। আমি তখন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে কাজ করি উপপরিচালক (গবেষণা ও পরিসংখ্যান) হিসেবে। সাধারণত পদটিকে শাস্তিমূলক পদায়ন হিসেবে বিবেচিত হতো। আমি স্বেচ্ছায় ও বলতে গেলে খানিকটা তদবির করে পদটা পাই। এটি উচ্চ বা গুরুত্বপূর্ণ পদের কোনোটাই নয়। তাই নতুন চেয়ারম্যানকে বরণকারী দলের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম না আমি।

যাহোক, দুপুর না গড়াতেই ডাক পড়ল চেয়ারম্যান সাহেব সালাম দিয়েছেন। প্রথম দর্শনেই দুটো জিনিস লক্ষ করি। নতুন চেয়ারম্যান অত্যন্ত সুদর্শন। মাথার সামনে খানিকটা চুল না উঠলে বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি মনে হতো। দ্বিতীয়ত, তিনি অত্যন্ত মৃদুভাষী। কথা বলে বুঝতে পারলাম, তিনি আমার সম্পর্কে জানেন। আমিও তাঁর সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকস ছাত্র ছিলেন। কেবল পড়াশোনায় নয়, খেলাধুলা ও পাঠক্রমবহির্ভূত বিষয়েও। বিশ্ববিদ্যালয়ের নীল ব্লেজারধারীদের একজন। পাকিস্তান ট্যাক্সেশন সার্ভিসের সদস্য হলেও প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে ইকোনমিক পুলের অফিসার হিসেবে সচিবালয়ে চলে যান।

তিনি আমাকে তলব করার কারণ বললেন। আগামীকাল, অর্থসচিবের কক্ষে বিশ্বব্যাংকের কর সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হবে। আপনি আমার সঙ্গে যাবেন। আমি বললাম, বিষয়টি আয়কর অনুবিভাগ–সংশ্লিষ্ট। আমার বদলে আয়কর বিভাগ থেকে কাউকে নিলে ভালো হবে। তিনি বললেন, ‘আমি আয়কর বিভাগে ছিলাম। অতএব আপনিই যাবেন। সকাল ১০টায় আমার রুমে চলে আসবেন। আমরা বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করব। তারপর একসঙ্গে সভায় যাব।’

সভায় রওনা দিতে গিয়ে পদমর্যাদার পার্থক্যের কারণে আমি ড্রাইভারের পাশের সিটে বসি। তিনি বলেন, ‘ওখানে কেন? আমার পাশে এসে বসুন।’ এরপর থেকে যখনই সভায় গিয়েছি, তাঁর গাড়িতে, পাশের সিটে বসে গেছি। ফলে দাপ্তরিক বিষয় ছাড়াও নানা কথা হতো। তাঁর জীবনাচরণ সম্পর্কে জানতে পেরেছি। একদিন মন্ত্রিসভার বৈঠকের জন্য কিছু নথি নিয়ে তাঁর সঙ্গে যাই। সন্ধ্যায় ফেরার পথে আমাকে মহাখালী নামিয়ে তিনি নিজেও নেমে পড়েন এবং ড্রাইভারকে বলেন, গাড়ি পরিবহন পুলে নিয়ে বন্ধ করতে। তিনি গুলশান এলাকায় থাকতেন। আমি বললাম, ‘বাসায় যাবেন কী করে?’ স্যার বললেন, ‘হেঁটে যাব। আজ সারা দিন হাঁটা হয়নি।’ এমন সুশৃঙ্খল ছিল তাঁর জীবনযাপন।

আমার জন্য একবার তাঁকে বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছিল। আমি এ সময় সিঙ্গাপুর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার জন্য অফার লেটার পেয়েছি। স্যারকে বললাম। তিনি বললেন, নথি পাঠানোর আগে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করবেন। কয়েক দিন পর শেরেবাংলা নগরে অর্থমন্ত্রীর সম্মেলনকক্ষে সভা। স্যার বললেন, আজ সভাশেষে আপনার সামনেই বিষয়টা নিয়ে কথা বলব। অর্থমন্ত্রীকে বহিঃ বাংলাদেশ ছুটির কথাটা বলতেই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুমি কোন সালে বিদেশ থেকে দেশে ফিরছ?’ আমি বললাম, ১৯৮৯ সাল।’ ‘এখন এটা কোন সাল?’ আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, ‘১৯৯১ সাল।’ ‘এরপর তিনি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন। এটা কি টি-স্টল নাকি? এক পেয়ালা চা খাইবা আর বাইর হইয়া যাবা?’ আমার পর এবার চেয়ারম্যান স্যারের পালা। ‘তুমি এ রকম বাজে প্রপোজাল আমার কাছে আর কখনো আনবা না।’ উল্লেখ্য, অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়ে স্যারের সহপাঠী ছিলেন। ফেরার পথে একই গাড়িতে, আমি ছুটি না হওয়ায় যতটা না আশাহত হয়েছিলাম, তার চেয়ে বেশি মনঃক্ষুণ্ন হয়েছিলাম আমার জন্য, আমার সামনে স্যারকে বকা শুনতে হলো দেখে। আমি কী বলব ভাবছি, তখন স্যারই আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, সুযোগটা হাতছাড়া করবেন না। পরে অবশ্য অর্থমন্ত্রী নিজে একদিন আমাকে তাঁর দপ্তরে ডেকে নিয়ে আমার বহিঃ বাংলাদেশ ছুটি মঞ্জুরের ব্যবস্থা করেন।

আপাতদৃষ্টে তাঁকে নরম মনে হলেও সিদ্ধান্ত গ্রহণ বিষয়ে তিনি ছিলেন অবিচল ও প্রভাবমুক্ত। একদিন আমাকে ডেকে বললেন, ‘আপনাকে বিশ্বব্যাংকের ঋণচুক্তি আলোচনার জন্য ওয়াশিংটন যেতে হবে।’ তখন সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন ও বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ ছিল সীমিত। খিচুড়ি রান্নার প্রশিক্ষণে বিদেশ যাওয়া হতো না! তাই আমি তাঁকে বললাম, ‘আমি গেলে আয়কর অনুবিভাগে আমার সহকর্মীরা মনঃক্ষুণ্ন হবেন। তা ছাড়া চুক্তি হলে বিষয়গুলো আয়কর অনুবিভাগের কর্মকর্তাদের বাস্তবায়ন করতে হবে।’ তিনি বললেন, ‘দলনেতা অর্থসচিব নাসিমুদ্দিন আহমদ আপনাকে আলোচনায় চান এবং আমিও মনে করি আপনি গেলে ভালো হবে। আমি পুনরায় আয়কর অনুবিভাগের কর্মকর্তাদের অসন্তোষের কথা বলি।’ তিনি বললেন, ‘সেটা আমি দেখব। আমাদের আলোচনা সফল হয়। সরকার আয়কর ব্যবস্থায় প্রভূত সংস্কার আনে। সর্বোচ্চ করহার ৫৫ থেকে ৩০ শতাংশে ও করস্তর ৯টি থেকে ৫টিতে নামিয়ে আনা হয়।

বাংলাদেশের প্রশাসন বিষয়ে কথা উঠলে কেবল সিএসপি অফিসারদের গুণগান করা হয়। অথচ অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশে বাণিজ্য উদারীকরণ, কর ও শুল্ক ব্যবস্থার সংস্কার ও ভ্যাট প্রবর্তন এগুলোর প্রায় সবই হয় চৌধুরী এ কে এম আমিনুল হক ও নুরুল হোসেইন খানের সময়। সুদক্ষ ও উচ্চ মানবিক গুণসম্পন্ন এঁরা কেউই সিএসপি অফিসার ছিলেন না। আসলেই প্রচারবিমুখ এই কর্মকর্তাদের সম্পর্কে কেউ জানেন না। তাঁদের সঙ্গে কাজ না করলে আমি নিজেও জানতাম না।

নুরুল হোসেইন খান অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ, খাদ্য ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব ছাড়াও ইস্টার্ন কমার্শিয়াল ব্যাংক ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের যথাক্রমে প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও সাধারণ সদস্য ছিলেন।

পরিশেষে, সদ্য প্রয়াত সাবেক সচিব, প্রচারবিমুখ, সুদক্ষ, সৎ ও সজ্জন নুরুল হোসেইন খানের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন ও তাঁর আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।

মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান: সাবেক সচিব