দুটি মৃত্যু: দেশের ক্ষতি, দশের ক্ষতি

সৈয়দ আবুল মকসুদ ও খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ
সৈয়দ আবুল মকসুদ ও খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ

মিয়ানমারের সেনাশাসনের ও ভবিষ্যৎ কথিত গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে আজকের লেখার বিষয়টি নির্ধারণ করেছিলাম। কারণ, রোহিঙ্গা সংকটের কারণে বিষয়টি আমাদের কাছে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু লেখায় ছেদ পড়ল দুটি মৃত্যু সংবাদে। প্রথমজন সৈয়দ আবুল মকসুদ এবং দ্বিতীয়জন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ইব্রাহিম খালেদ। তাঁদের মৃত্যু সংবাদ লেখার বিষয়ের চিন্তাকে এলোমেলো করে দিল। বিষয়ের ওপর মনোনিবেশ করতে পারছিলাম না। দুজনই আমার পরিচিত এবং নাগরিক সমাজের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। প্রথমেই তাঁদের আত্মার প্রতি নম্র ও ভালোবাসায় সিক্ত শ্রদ্ধা জানাচ্ছি (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।

সৈয়দ আবুল মকসুদের সঙ্গে আমার নৈকট্য প্রায় দুই দশকের ওপর। তিনি নাগরিক সমাজের অত্যন্ত সম্মানিত সদস্য ছিলেন। প্রথম আলোতে তাঁর লেখা কলাম পড়ায় আমার আসক্তি হয়েছিল। তিনি বাংলাদেশের অতীত, চলমান-রাজনীতি, দেশের নির্বাচনব্যবস্থা এবং সমাজের অসামঞ্জস্য বিষয়গুলো চমৎকার ভাষায়, প্রাঞ্জল ভাষায় লিখতেন। মাঝেমধ্যে দেখা হলে জিজ্ঞাসা করতেন তাঁর লেখা পড়েছি কি না। প্রয়োজনেই তিনি ফোন করে নির্বাচন বিষয়ে খুঁটিনাটি জেনে নিতেন।

সৈয়দ আবুল মকসুদ সাহেবের সঙ্গে ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে বহুবার একসঙ্গে উপস্থিতও থেকেছি। তাঁর সঙ্গে প্রথম দিকে কিছুটা পরিচয় থাকলেও অন্তরঙ্গ হওয়ার সুযোগ হয় ২০০৮ সালে। ওই বছর আমি এবং নির্বাচন কমিশনার সহুল হোসাইন ২০০৮ নেপালের নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে গিয়েছিলাম। একই ফ্লাইটে তিনিও ছিলেন। ওই নির্বাচন নিয়ে আমরা অনেক আলোচনা করেছি। এরপর নির্বাচনী সংস্কার নিয়ে নির্বাচন কমিশনের আয়োজিত বৈঠকে নাগরিক সমাজের একজন হিসেবে একাধিকবার তিনি যোগ দিয়েছেন এবং সেখানে তিনি অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

নির্বাচন কমিশনের সুবাদে সৈয়দ আবুল মকসুদের সঙ্গে আমার নৈকট্য আরও বাড়ে। সুজন-এর একজন সক্রিয় সদস্য হিসেবে বিভিন্ন সেমিনারে দেওয়া তাঁর নম্র অথচ দৃঢ় বক্তব্য শুনেছি। তাঁর বক্তব্য ভালো লাগত। তিনি সরাসরি কথা বলতেন। কখনো উত্তেজিত হতে দেখিনি তাঁকে। তাঁর পোশাকের কারণেই তিনি আমার কাছে একেবারে আলাদা এবং সাদা মনের মানুষ ছিলেন। তিনি গান্ধী ও মাওলানা ভাসানীকে আদর্শ মনে করতেন। একদিন আমি জানতে চেয়েছিলাম, তিনি কবে থেকে প্রচলিত পোশাক বাদ দিয়েছিলেন? বলেছিলেন, ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ইরাকের বিরুদ্ধে অনৈতিক যুদ্ধ বাধানোর প্রতিবাদ হিসেবে কাফনের কাপড় পরেছিলেন। সেই থেকে মনে মনে ভেবেছেন, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তাঁর এই সরব ও নীরব প্রতিবাদ আমরণ চলবে। তিনি তাঁর কথা রেখেছেন।

সৈয়দ আবুল মকসুদ সাহেবের গুণের ফর্দ অনেক বড়। অত্যন্ত প্রথিতযশা সাহিত্যিক ও কলাম লেখকের লেখা আর দেখব না। হঠাৎ করেই হারিয়ে গেলেন। তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। আমাদের জীবদ্দশায় এ রকম সাদাসিধে, ভদ্র-নম্র সৈয়দ আবুল মকসুদ সাহেবের মতো দ্বিতীয় ব্যক্তি আর দেখব না।

সৈয়দ আবুল মকসুদ বহু গুণের অধিকারী এবং নিজ গুণে দেশের এবং সমাজে সৎমানুষ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি যে ধরনের সাধারণ সাদামাটা জীবন যাপন করতেন তা হয়তো অনেকে ধারণাও করতে পারেন না। এ ধরনের মানুষ এ দেশে বিরল। এমনই একজন মানুষকে আমরা হারালাম। দেশ, জাতি, সমাজ এবং সাহিত্য জগতের অপূরণীয় ক্ষতি হলো। তথাপি মৃত্যুতে কারও হাত নেই, বিশেষ করে এ ধরনের মৃত্যুতে। আমি কায়মনোবাক্যে দোয়া করছি, আল্লাহ তাঁকে বেহেশত নসিব করুন এবং তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারকে এই অপূরণীয় ক্ষতি সওয়ার শক্তি দিন।

দ্বিতীয় অপূরণীয় ক্ষতিটি হলো সৈয়দ আবুল মকসুদ সাহেবের মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা ব্যবধানে চিকিৎসারত অবস্থায় বাংলাদেশের প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের মৃত্যুতে। তিনি প্রায় এক মাস যাবৎ করোনা-পরবর্তী সমস্যার জটিলতায় ভুগছিলেন। তিনিও বাংলাদেশের নাগরিক সমাজের একজন সুপরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন। তিনি অত্যন্ত সহজ ও স্পষ্ট ভাষায় অর্থনীতির চিত্র নিয়ে গণমাধ্যমে পরামর্শমূলক বক্তব্য দিতেন। তাঁর আলোচনায় উপকৃত হতাম। পত্রপত্রিকায় তাঁর মন্তব্য এবং লেখায় সব সময়ই দিকনির্দেশনামূলক আলোচনা থাকত। তিনি ব্যাংকিং জগতে অত্যন্ত সুপরিচিত ও সমাদৃত ছিলেন। অবসরের পরও কর্মজীবন পালন করে গেছেন। বহু ব্যাংকের পর্ষদে তিনি কাজ করেছেন। শুধু ব্যাংকিং জগতেই নয়, সামাজিক জগতেও বেশ অবদান রেখেছেন।

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ সাহেবের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ঘটে ২০০৭-০৮ এ নির্বাচন কমিশনে থাকাকালে। বিশেষ করে নির্বাচনী আইন সংস্কারের সময় তাঁর পরামর্শ যথেষ্ট কাজে লেগেছে। নির্বাচনী আইনে অর্থ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে তাঁর পরামর্শ আমাদের জন্য বেশ মূল্যবান প্রমাণিত হয়েছিল। আরও পরে ২০০৮-০৯-এর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নতুন আইনের খুঁটিনাটি বিষয়, নতুন আচরণবিধি ও ছবিযুক্ত ভোটার তালিকার বিভিন্ন দিক নিয়ে বিটিভিতে আলোচনার সঞ্চালক ছিলেন তিনি। ওই আলোচনায় এককভাবে থাকতেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। এই প্রোগ্রামের মাধ্যমে সাধারণ জনগণ, প্রার্থী এবং ভোটাররা যথেষ্ট উপকৃত হয়েছিলেন এবং নির্বাচন কমিশনে জনগণের জবাবদিহির জায়গা তৈরি হয়েছিল। বাংলাদেশে এ ধরনের প্রোগ্রাম পরে আর হয়নি। তাঁর এই অবদানের জন্য আমরা যথেষ্ট কৃতজ্ঞ ছিলাম।

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের মতো বিরল প্রতিভার মানুষের চলে যাওয়া দেশের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। আমরা তাঁর আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। আল্লাহ এমন সাদা মনের মানুষটিকে বেহেশতে যেন জায়গা করে দেন, সেই দোয়া করছি। এ ধরনের মানুষদের প্রতিনিয়ত পাওয়া যায় না। তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি।

আমাদের দেশে এমনিতেই নাগরিক সমাজের পরিসর অত্যন্ত ছোট। এর মধ্যে সৈয়দ আবুল মকসুদ ও খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ সাহেবদের মৃত্যু নাগরিক সমাজকে আরও সংকুচিত করল। এঁদের মতো ব্যক্তিত্বরা আগামী প্রজন্মের পথিকৃৎ হয়ে থাকবেন।

ড. এম সাখাওয়াত হোসেন নির্বাচন বিশ্লেষক, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং এসআইপিজির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (এনএসইউ)

ই–মেইল: hhintlbd@yahoo.com