স্মরণ

ইতিহাসে নিজস্ব জায়গা করে নিয়েছেন জিয়া

জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর ৪০ বছর পর মনে হচ্ছে দল হিসেবে বিএনপি টগবগে যৌবনে উপনীত না হয়ে অকালবার্ধক্যে উপনীত হয়েছে
জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর ৪০ বছর পর মনে হচ্ছে দল হিসেবে বিএনপি টগবগে যৌবনে উপনীত না হয়ে অকালবার্ধক্যে উপনীত হয়েছে

জিয়াউর রহমানকে দেশের রাজনীতির ইতিহাসে নানাভাবে চিত্রায়িত করা হয়। ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে সার্কিট হাউসে সেনাবাহিনীর একদল বিপথগামী সদস্যদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার ও জেড ফোর্সের অধিনায়ক ছিলেন তিনি। ইতিহাসের তর্ক, বিতর্ক, সমালোচনা, নিন্দামন্দ ও নানা ঘটনার বাঁক পেরিয়ে তিনি একসময় রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। সমালোচকেরা বলে থাকেন, তিনি ক্ষমতা দখল করেছিলেন। ক্ষমতা দখল করুন বা সময়ই তাঁকে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসুক না কেন, বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে দেশের ইতিহাসে নিজস্ব অবস্থান তৈরি করে নিয়েছেন জিয়াউর রহমান, যা তাঁর অনেক সমালোচনাকে আড়াল করে দিয়েছে।

সমালোচকেরা অবশ্য জিয়াউর রহমানকে সামরিক শাসক হিসেবেই বিবেচনা করেন। তিনি সামরিক উর্দি পরেই ক্ষমতায় এসেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জিয়াউর রহমানের পরিচয় যতটা না সামরিক শাসক হিসেবে, এর পাশাপাশি বিএনপি তাঁকে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ও বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তক হিসেবেও গণ্য করে। ক্ষমতায় আসার কিছুদিনের মধ্যেই তিনি সামরিক শাসকের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসার উদ্যোগ নিলেন। রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠন করে রাজনীতির মাঠে নামলেন। এ হিসেবে বিএনপিকে কিংস পার্টি বলা যায়। রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা নিয়ে বিএনপির পথচলা শুরু হয়েছিল। সাধারণত শাসকের ক্ষমতা থেকে বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গে এ ধরনের কিংস পার্টিগুলোর বিলুপ্তি ঘটে। কিন্তু না, সবাইকে অবাক করে দিয়ে জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বিএনপি টিকে রইল।

এর মূল কারণ হচ্ছে জিয়াউর রহমান কিছু কৌশল ও নীতির প্রয়োগ করেছিলেন। রাজনীতিতে বড় চমকটি হচ্ছে জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে তাঁর নতুন অবস্থান। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ নামে নতুন এক রাজনৈতিক ধারণার প্রবর্তন ও সূচনা করেন তিনি। বহুমুখী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে বিভিন্ন নীতি ও পরিকল্পনার মাধ্যমে তিনি রাজনীতির মাঠ দখলে সক্রিয় হন। প্রথমেই প্রশাসন ও আমলাতন্ত্রকে ঢেলে সাজানো হয়। এরপর সামরিক বাহিনীকে শক্তিশালী করা হয়। প্রশাসন ও সামরিক বাহিনীকে পুরো নিয়ন্ত্রণে এনে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে অনেকটা পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলোর আদলে বাস্তবায়ন করা হয়। এর একটি দিক ছিল সামাজিক অংশগ্রহণ ও অপরদিকে সামরিক প্রশিক্ষণ। তবে রাশিয়ার জার বা জাপানের মেইজি সাম্রাজ্যের মতো আমলানির্ভর ছিল না বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ বাস্তবায়নে প্রত্যক্ষভাবে জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করেছিলেন জিয়া। খাল খনন, গণশিক্ষা, গ্রাম সরকার, ভিডিপির মতো বিভিন্ন কর্মসূচিতে নাগরিকদের সরাসরি যুক্ত করা হয়েছে। গ্রাম বা গণমানুষকে ভিত্তি করে বিভিন্ন কর্মসূচি প্রণয়ন করা হয়েছে।

জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী ধারণার বিভিন্ন পরিকল্পনার মধ্যে একধরনের গণভিত্তিক কর্মসূচি লক্ষ করা যায়। এমনকি কৃষিজমির আল বা বিভাজনও তুলে দেওয়ার কথা জিয়া বলেছিলেন। অনেকেই মনে করেন, দেশে কৃষি খাতে যৌথ খামার পদ্ধতি শুরু করার পরিকল্পনা হয়তো ছিল জিয়ার। জিয়া সরাসরিই কৃষি সমবায়ের কথা উল্লেখ করেছিলেন। এ ক্ষেত্রে উদার অর্থনীতির সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক কৃষিব্যবস্থার সমন্বয়ের চিন্তাও থাকতে পারে। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে একধরনের মিশ্র ব্যবস্থা বলা যেতে পারে। তৃণমূলে গণভিত্তিক উৎপাদন ও শাসনব্যবস্থা প্রয়োগের চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়। তৃণমূল থেকে মতামত তৈরি করে কেন্দ্রে সিদ্ধান্ত প্রণয়নের প্রবণতা ছিল ওই সময়। এসবের পাশাপাশি নিয়ন্ত্রিত বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করা হয়েছে। যেমন আগে সেচ ও কৃষি যন্ত্রের খাত পুরোপুরি সরকার নিয়ন্ত্রণ করত। কিন্তু জিয়ার আমলে কৃষিতে খাতে বেসরকারি উদ্যোগকে স্বাগত জানানো হয়। সেচের জন্য গ্রামে গ্রামে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দল গড়ে ওঠে। একজন সেচযন্ত্র কিনে অন্যদের চাষের জমিতে পানি সরবরাহ করত। এ ধরনের গণভিত্তিক উৎপাদন প্রক্রিয়া সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে দেখা যায়। তবে ওই সময়ের সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে সবকিছু সরকারি নিয়ন্ত্রণে ছিল।

কিন্তু জিয়াউর রহমান সরকারি পর্যবেক্ষণ বজায় রেখে স্থানীয় জনসাধারণের হাতে এসব ছেড়ে দেন। যে কারণে পুঁজিবাদের চরম মুনাফামুখী আচরণ বা সমাজতন্ত্রের অতি কঠোর কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ থেকে সরে এসে বাংলাদেশ পশ্চিম ইউরোপ ঘরানার নতুন একটি মডেল তৈরি করতে পেরেছিল ওই সময়ের জন্য। নতুন ধারার এই অর্থনৈতিক কাঠামোর কারণে দেশের শিল্প ও কৃষি খাতে পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। জনসাধারণ সরাসরি এ পরিবর্তনের সুফল ভোগ করেছিল। কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সমাজ থেকে শিক্ষিত নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণির সৃষ্টি হতে থাকে। ১৯৪৭-এর আগে বা পাকিস্তান আমলে পিছিয়ে থাকা গ্রামীণ জনগোষ্ঠী নগরমুখী হতে থাকে। কৃষকের ছেলে আর কৃষিতে নিয়োজিত না হয়ে অফিস-আদালত, মিল-কলকারখানাতে নিজের কর্মের সংস্থান খোঁজে নেয়। এর ফলে নতুন নতুন পেশা ও নাগরিক জীবনের বিকাশ ঘটতে থাকে।

জিয়াউর রহমানের শাসনামলকে দুই ভাগে আলোচনা করা যায়। একটি হচ্ছে তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান ও নীতিকৌশল। অপরটি হচ্ছে বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচি। তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে কঠোরভাবে সমালোচনা করেন অনেকেই। অভিযোগ করা হয়, তিনি ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার করেছেন। স্বাধীনতাবিরোধীদের রাজনীতি করার সুযোগ দিয়েছেন। নিজের দলেও কয়েকজনকে নিয়েছিলেন। কর্নেল তাহেরের মৃত্যুদণ্ডসহ প্রতিপক্ষকে শক্ত হাতে দমন করেছেন। কিন্তু আবার তিনি রাজনীতির দুয়ার সবার জন্য উন্মুক্তও করে দিয়েছিলেন। গণমাধ্যমকে স্বাভাবিকভাবে কাজ করার সুযোগ দিয়েছিলেন। রাজনীতির পাশাপাশি তিনি সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অগ্রগতিকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তাঁর সময়ে একুশে ও স্বাধীনতা পদক প্রদান করা শুরু হয়। জাতীয় লোকসংগীত উৎসব, জাতীয় নাট্যোৎসব, জাতীয় বার্ষিক চারুকলা প্রদর্শনী, বেতার-টিভির সম্প্রসারণ, টিভির রঙিন সম্প্রচার, জাতীয় শিশু-কিশোর পুরস্কার প্রবর্তন, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার শুরু করা, চলচ্চিত্রের জন্য অনুদান তহবিল গঠন, ফিল্ম ইনস্টিটিউট ও আর্কাইভ চালু করা, আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজন করা হয়। মেয়েদের স্কুল ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হয়।

মূলত সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মসূচি দিয়ে জিয়াউর রহমান তাঁর রাজনৈতিক সমালোচনা, ব্যর্থতা, সীমাবদ্ধতাকে ছাপিয়ে গিয়েছেন। যে কারণে তাঁর বিভিন্ন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়ে বিতর্ক থাকলেও গণমানুষের মধ্যে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। এতে বিএনপিরও একটি জনভিত্তি তৈরি হয়ে যায়। কিন্তু বিএনপি পরবর্তী সময়ে এই অবস্থান আর ধরে রাখতে পারেনি। গণসম্পৃক্ত কোনো কর্মসূচিতে বিএনপিকে এখন আর দেখা যায় না। জিয়াউর রহমানের বিএনপির যে গতিশীলতা ছিল, ক্ষিপ্রতা ছিল, কৌশল অবলম্বনে দক্ষতা ছিল, পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে কুশলী ছিল, তড়িৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণে আগ্রহী ছিল, তা বর্তমান বিএনপিতে পুরোপুরি অনুপস্থিত।

বর্তমান বিএনপিকে দেখলে মনে হয় উদ্দেশ্যবিহীন এক রাজনীতির গোলকধাঁধার মধ্যে আছে দলটি। জরাগ্রস্ত, বার্ধক্যে উপনীত এক দলে পরিণত হয়েছে বিএনপি। বর্তমান বিএনপির সিদ্ধান্ত গ্রহণে বছরের পর বছর লেগে যায়। চট্টগ্রাম নগর ছাত্রদলের পূর্ণাঙ্গ কমিটি করতে এখন সাত বছর লাগে। কমিটি যখন পূর্ণাঙ্গ করা হলো, তখন দেখা যাচ্ছে শীর্ষ নেতাদের অনেকেরই বয়স ৫০ পেরিয়ে গিয়েছে অথবা ৫০ ছুঁই ছুঁই। যদিও পরে ওই কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়। কিন্তু একটি কমিটি পূর্ণাঙ্গ করতে সাত বছর লাগল কেন? ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বেও অছাত্র, বয়স্ক ও কয়েক সন্তানের পিতাদের উপস্থিতি কয়েক বছর আগেও ছিল। ঠাট্টা-মশকরা করে অনেকেই বলে থাকেন, বাবা-ছেলে একসঙ্গে ছাত্রদল করে।

ছাত্রদলের উদাহরণ দিয়েই বিএনপির বর্তমান সাংগঠনিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যায়। কর্মীরা এই ভাই সেই ভাইয়ের রাজনীতি করে। বিভিন্ন ভাইয়ের সিন্ডিকেট সব ঠিক করে দেয়। এতে দলটির বিভিন্ন নেতা ও ভাইদের লাভ হচ্ছে। কিন্তু ক্ষতি হচ্ছে বিএনপির। তাই শক্তিশালী জনভিত্তি থাকার পরও জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর ৪০ বছর পর দল হিসেবে বিএনপি টগবগে যৌবনে উপনীত না হয়ে মনে হচ্ছে অকালবার্ধক্যে উপনীত হয়েছে।

ড. মারুফ মল্লিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক