ড. আবুল খায়ের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে শহীদ হন। ২০ দিন পর মিরপুরের বধ্যভূমিতে তাঁর লাশ পাওয়া যায়। শহীদ বুদ্ধিজীবি দিবস উপলক্ষে তাঁর স্মরণে লিখেছেন মেয়ে হোমায়রা ইয়াসমীন
১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশে পালিত হয় বিজয় দিবস, যার প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায় আরও আগ থেকে। কিন্তু আমার বা আমার মতো যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা আনতে পিতৃ–মাতৃহীন হয়েছি, তাদের মনে ডিসেম্বর মানে বিষাদমাখা মাস। আমি ব্যক্তিগতভাবে এই ডিসেম্বর মাস থেকে পালিয়ে বেড়াতে চাই। মনে হয়, যদি নভেম্বরের পর জানুয়ারি মাস আসত, তবে বোধ হয় সেটাই ভালো হতো।
আমার বাবা যখন শহীদ হন, তখন আমার বয়স ছিল তিন বছর। তাই আমার স্মৃতিতে বাবা হলো মানুষের থেকে শোনা কথা। এ শোনা কথার স্মৃতির ঝুলি নিয়েই আমি বড় হয়েছি এবং বাবা সম্পর্কে একটা বিমূর্ত ধারণা করেছি। আমি আমার স্মৃতিতে বাবাকে শিক্ষার প্রতি আগ্রহী একজন অনন্য ব্যক্তি হিসেবে দেখি। উনি বরিশালের একটি স্কুল থেকে এসএসসি পাস করে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ও মাস্টার্স করে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় বার্কলে ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্স ও পিএইচডি করেন। অসম্ভব মেধাবী ছিলেন আমার বাবা, যিনি মাত্র সাড়ে তিন বছরে পিএইচডি সম্পন্ন করেন।
আমার বাবা দেশকে ভালোবাসতেন। দেশের মানুষকে ভালোবাসতেন। আমেরিকায় পিএইচডি করাকালে উনার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু থেকে জানতে পারি যে, পিএইচডির গবেষণাকাজে আমার বাবার সঙ্গে প্রচুর আমেরিকান কংগ্রেসম্যানদের যোগাযোগ ছিল। কারণ, ওনার পিএইচডির থিসিস ছিল ‘আমেরিকান ফরেন পলিসি ফর ইন্দো–পাকিস্তান সাবকন্টিনেন্ট’। তাই উনি যদি চাইতেন, তাহলে আমেরিকায় বসবাস করা ওনার জন্য তেমন কঠিন কিছু হতো না। কিন্তু উনি সে সুযোগ গ্রহণ করেননি। দেশের প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি দায়িত্ববোধ থেকেই সব সময় কাজ করে গিয়েছেন।
এখানে উল্লেখ্য, স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে একবার পাকিস্তানি সেনারা আমার বাবাকে গ্রেপ্তার করে। তখন আমেরিকান কংগ্রেসম্যানদের সহায়তায় তিনি ছাড়া পান এবং তাঁকে দেশ ছেড়ে আমেরিকায় চলে যাওয়ার জন্য বলা হয়। কিন্তু আব্বা সেটাতে রাজি হননি। আব্বার অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী আব্বাকে ভারতে যাওয়ারও অনুরোধ করেন। কিন্তু তাতেও রাজি হননি। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি কোনো অন্যায় করিনি, যদি মরতে হয়, তবে এ দেশের মাটিতেই মরব।’ দেশের প্রতি উনার অপরিসীম ভালোবাসা ছিল।
এই বিশাল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন বাবা পেয়েও আমি বড় হয়েছি বাবা ছাড়া। বাবা যে কারও রোলমডেল হতে পারে, আমার ক্ষেত্রে সেটা হয়েছে—এটা অ্যাবস্ট্রাক্ট কনসেপ্ট নিয়ে। তাই স্বাভাবিকভাবেই আমার বড় হওয়াটা অন্য আর দশজন ছেলেমেয়ের থেকে ভিন্ন। এসবই আমার ব্যক্তিগত দুঃখ। কিন্তু কষ্ট লাগে যখন দেখি, যে স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য আমার বাবা আত্মত্যাগ করেছেন, সেই রাষ্ট্র আজ স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও সঠিকভাবে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রস্তুত করতে পারেনি। ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী দিবসে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শিক্ষকদের একটা তালিকা প্রকাশ করা হয়। যেখানে অনেকের শিক্ষকের নাম দেখা যায় না, ধীরে ধীরে বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাচ্ছে সেসব নাম।
প্রতিবছর ১৪ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সমাধিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়। কিন্তু আমরা শহীদ বুদ্ধিজীবীর সন্তানেরা মনে করি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বা দেশের গবেষকেরা তাঁদের গবেষণার মাধ্যমে তাঁদের শহীদ হওয়ার পেছনের আসল কারণ বের করতে পারলে সেটা হবে তাঁদের প্রতি আসল শ্রদ্ধা নিবেদন।
আমার মনে প্রশ্ন জাগে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এত শিক্ষকের মধ্যে কেন গুটিকয়েক শিক্ষককে হত্যার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়? তাঁদের কী কী কর্মকাণ্ড পাকিস্তান সরকারের অন্তরায় ছিল? এই প্রশ্নগুলো আমার মতো নিশ্চয়ই অনেকের মনে উদয় হয়। এগুলোর উত্তর আমাদের গবেষণার মাধ্যমে উদ্ঘাটন করলেই তাঁদের আত্মত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হবে বলে আমি মনে করি।
হোমায়রা ইয়াসমীন শহীদ বুদ্ধিজীবী আবুল খায়েরের মেয়ে